ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

পর্ব-২

‘ভুল ধারণা থেকেই মাদকে ঝুঁকছে তরুণরা’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৫৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৩:৩৯, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

ডা. রাহেনুল ইসলাম

ডা. রাহেনুল ইসলাম

বর্তমানে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার। মাদকের সহজলভ্যতা ও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধার অভাবে এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ তরুণ। বিপুল এই জনগোষ্ঠী নেশায় ডুবে আছে। বর্তমানে এ সমস্যা শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নেই, মফস্বল ও গ্রামেও ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, তরুণ-বার্ধক্য নির্বিশেষে এটি ছড়িয়ে পড়ছে।

আমাদের দেশে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, মদ, ঘুম ও ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে পেথেডিন ও মরফিন সহজলভ্য। মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত এসবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এগুলো মস্তিস্কের বিশেষ বিশেষ স্থানকে উদ্দীপ্ত করে, যার ফলে সাময়িকভাবে তীব্র ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে। কিছুদিন ব্যবহারের পর সহনীয়তা তৈরি হয়, যার ফলে একই মাত্রায় আর আগের মতো ভাললাগা বোধ থাকে না। এজন্য মাদক-ব্যবহারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী আসক্তি তৈরি হয়।

মাদকাসক্তির ক্ষতিকারক দিক নিয়ে একুশে টিভি অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের পর্বে থাকছে ডা. রাহেনুল ইসলামের সাক্ষাৎকার তিনি কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরেছেন একুশে টিভি অনলাইনের রিপোর্টার মাহমুদুল হাসান

একুশে টিভি অনলাইন : মাদকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে, এর কারণ কী?  

রাহেনুল ইসলাম : দেখুন, অনেকে সিগারেট দিয়ে নেশার জগতে পা বাড়ায়। তাই সিগারেটকে আপাত নিরীহ মনে হলেও এটা মাদকের জগতে প্রবেশের মূল দ্বার হিসেবে কাজ করে। তাই ধূমপান হতে পারে মাদকাসক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। একটা পর্যায়ে শরীর ও মন এমনভাবে মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে যে, চিকিৎসা ছাড়া আর কোনোভাবেই মাদকমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না।

এছাড়া মাদকাসক্তির বড় কারণ এর সহজলভ্যতা, মাদকের প্রতি তরুণ প্রজন্মের কৌতুহল ও নিছক মজা করার প্রবণতা, মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রকৃত ধারণার অভাব। এছাড়া বাবা-মায়ের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং বন্ধুদের চাপ অন্যতম কারণ।

মাদক নিয়ে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতাও মাদকের জগতে ঠেলে দেয়। মানসিক সমস্যার কারণেও মাদকাসক্তি ঘটতে পারে। এছাড়া বেকারত্ব, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, ব্যবসায় ক্ষতি, পরীক্ষায় ফেল ইত্যাদি নানা কারণে তরুণ-তরুণীরা মাদকের কাছে আশ্রয় নেয়।

একুশে টিভি অনলাইন : মাদকাসক্তির লক্ষণ কি কি?

রাহেনুল ইসলাম : মাদকগ্রহণকারীদের কথা-বার্তা, আচরণ ও চিন্তাভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। তাদের চিন্তা-ভাবনা হয়ে উঠে বিক্ষিপ্ত, কোনো কিছুতে বেশিক্ষণ মনোসংযোগ করতে পারে না। ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়, সারারাত জেগে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং পরদিন দুপুর ২টা-৩টা পর্যন্ত ঘুমায়। মাদকাসক্তদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং পরিবারের অবাধ্য হয়ে উঠে। তাদের খিদে কমে যায়, বমিভাব দেখা দেয়। বাসায় ঠিকমত খায় না, গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে, কোনো কোনো দিন বাসায়ই ফিরে না। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়, পড়ালেখার মান কমে যায়, চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধবী তৈরি হয়, পুরনোদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। ঘন ঘন মোবাইলের সিম বদলায়। কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নানা ছুঁতোয় বাবা-মায়ের কাছে টাকা চায়, টাকা না পেলে রাগারাগি করে। শরীর ভেঙে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়।

তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, উপরের সবগুলো লক্ষণ একসঙ্গে যেমন সব মাদকাসক্তের মধ্যে থাকে না, তেমনি উপরের লক্ষণগুলো মাদকাসক্তি ছাড়াও ভিন্ন কারণে হতে পারে। তাই নিছক সন্দেহের বশে কাউকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত না করে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে মাদকাসক্তি নির্ণয় করা প্রয়োজন।

একুশে টিভি অনলাইন : বর্তমানে তরুণ মাদকসেবীদের অনেকেই ইয়াবার দিকে ঝুঁকছে। এর কারণ কি?

রাহেনুল ইসলাম : আপনি ঠিকই বলেছেন। বর্তমান সময়ে ইয়াবা খুবই আলোচিত একটি বিষয়। এটি মূলত ছাত্র-ছাত্রী, মডেলকন্যা, অভিনেত্রী, ও তরুণ-তরুণীর মধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা মনে করে, ইয়াবা খেলে দীর্ঘ সময় পড়ালেখা করা, স্লিম থাকা যায় এবং বেশি সময় যৌনক্ষমতা ধরে রাখা যায়। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই সাধারণত শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ও বিত্তশালী পরিবারের তরুণরা এর দিকে বেশি ঝুঁকছে। এই ট্যাবলেট খেলে খাবারের রুচি কমে যায়, ঘুম কমে যায়, না খেতে খেতে তারা রোগাটে হয়ে যায়। এ অবস্থাকে মনে করে স্লিম হওয়ার একটা উপায়। ব্যবহারে প্রাথমিক অবস্থায় যৌন উত্তেজনা কিছুটা বাড়ে। এরপর কমতে থাকে। বছরখানেক ব্যবহারের পর যৌন ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে যায়। চিকিৎসা নিয়ে কোনো লাভ হয় না। দীর্ঘদিন এই ট্যাবলেট খেলে দ্রুত কিডনি, লিভারসহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে মাদকসেবী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : মাদক সেবনের কারণে কি কি সমস্যা দেখা দেয়?

রাহেনুল ইসলাম :  মাদকাসক্তির কারণে স্নায়ুতন্ত্র, হৃদযন্ত্র, যকৃত, ফুসফুস, প্রজননতন্ত্র, কিডনি, পাকস্থলীসহ শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিরায় মাদক গ্রহণের কারণে হেপাটাইটিস বি, সি, যৌনবাহিত রোগ ও এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে। দীর্ঘসময় মাদক নিলে মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে নেশা গ্রহণকারী। মাদকের টাকা জোগাতে চুরি, ছিনতাই, দেহব্যবসা ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তারা। কেউবা সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়, চাকরিচ্যুত হতে হয় অনেককে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাদক গ্রহণ করতে না পারলে ‘উইথড্রয়াল’ সিনড্রোম দেখা যায়, এ সময় নানা রকম শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়া মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণতির কথা পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখতে পাই, মাদকাসক্ত ব্যক্তির হাতে তার পরিবারের নিকটজনের হত্যার চিত্র দেখতে পাই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : মাদকাসক্তির চিকিৎসা কিভাবে দেওয়া হয়?

রাহেনুর ইসলাম : মাদকাসক্তির চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়, মাদকাসক্তির ধরন নির্ণয় করা হয়। শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর তার ‘উইথড্রয়াল’ সিনড্রোম বা মাদক প্রত্যাহারজনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকর রাসায়নিক অংশগুলো বের করে দেওয়া হয়, এ ধাপটিকে বলা হয় ‘ডিটক্সিফিকেশন’। এসময় তার পুষ্টি নিশ্চিত করতে হয় ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। মাদকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন স্বীকৃত ওষুধ নির্দিষ্ট নিয়মে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা লাগতে পারে। পরবর্তী ধাপে তাকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাদকমুক্ত থাকার প্রেরণা দেওয়া হয়। আবার যাতে মাদক গ্রহণ না করে সে বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া হয়, ফের আসক্ত হওয়ার জন্য যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ রয়েছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আসক্ত হওয়ার আগে যোগ্যতা ও গুণাবলী ফিরিয়ে দেয়ার জন্যও পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মাদকাসক্তি চিকিৎসার ধাপগুলো বেশ দীর্ঘমেয়াদি। তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করাতে হয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : মাদক থেকে রক্ষায় পরিবারের কি কি করণীয় রয়েছে?

রাহেনুল ইসলাম : মাদক প্রতিরোধ করতে হলে সর্বপ্রথম পরিবারে মাদকমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সন্তানদের কার্যকলাপ এবং সঙ্গীদের ব্যাপারে খবর রাখতে হবে। পরিবারের মঙ্গলের জন্য একে অপরকে সময় দিতে হবে। সন্তানদের সামাজিক, মানসিক, লেখাপড়া সংক্রান্ত অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো যথাসম্ভব মেটাতে হবে, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দেওয়া যাবে না। পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন এবং সবাই মিলে সুন্দর সময় কাটাবেন। ‘গুড প্যারেন্টিং’ বিষয়ে বাবা-মাকে জ্ঞান নিতে হবে । সন্তানরা যেসব জায়গায় সবসময় যাওয়া-আসা করে সে জায়গাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের সব সদস্যই ড্রাগের ক্ষতিকারক বিষয়গুলো সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবেন। ধৈর্য ধরে সন্তানদের সব কথা শোনার জন্য অভিভাবকরা নিজেদের প্রস্তুত করবেন।

একুশে টিভি অনলাইন : মাদক প্রতিরোধে সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় কী কী?

রাহেনুল ইসলাম : মাদক প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় বিষয় হচ্ছে সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এছাড়া জনমত সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই ভয়াবহ সমস্যাটি মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রশাসনকে সর্বপ্রথম মাদকের উৎপাদন এবং এর অবৈধ ব্যবসা নির্মূল করতে হবে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে মাদকাসক্তির ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন এবং প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে এর কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে সাংগঠনিক দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ও কর্মসূচির ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকের কারণে দেশ পিছিয়ে পড়ছে। তাই দেশের এই বিপুল জনগোষ্ঠিকে যদি আমরা মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে দেশ দ্রুত সমৃদ্ধ হবে। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে হিসেবে গড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার মাধ্যমে আরও বেশি তরান্বিত হবে বলে আমি মনে করি।

এম/ডিডি/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি