ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

রাষ্ট্রীয় নৃশংসতায় মানবতার পরাজয় যেখানে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:১৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৩:৫৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গুলিবিদ্ধ হয়েও অনেকে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরে তাদেরকে পরে আগুনে পোড়ানো হয়। চোখের সামনে সন্তানকে হত্যা করা হয়। দা’য়ের এক কোপে বৃদ্ধ মা’কে জবাই করা হয়। চোখের সামনে এমন নির্মমতা দেখে অনেকে বাকরুদ্ধ। মানবতার যুক্তিতর্কে কোনো হিসেব মেলাতে পারেন না তারা। নিজ দেশে এমন নির্যাতন আর গণহত্যা দেখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম।  রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের যে বর্ণনা দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা তাতে দেশটিতে মানবতার ঘৃণ্য পরাজয় হয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দমনের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তাণ্ডব থেকে জীবন বাঁচাতে গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার সকালেও অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এ ছাড়া সীমানার নো-ম্যান্সল্যান্ডের মধ্যে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসার অপেক্ষায় রয়েছে।

বাংলাদেশে আশা এসব রোহিঙ্গাদের পরিবারকে গুলি করে, তরবারি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ঘর-বাড়ি। যারা কোনো জঙ্গলে লুকিয়ে বাঁচতে পেরেছেন তারাই আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা নিজামুর নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, আমার ২৪ বছরের পুরো সময়ে রাখাইনের খোলা আকাশের নিচে একজন বন্দির মতো ছিলাম। আমি মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেছি; আমার বাবা-মা ছিলেন। কিন্তু আমার জাতিগত পরিচয়ের কারণে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ ব্যাপকভাবে সীমিত করা হয়। সরকারি কাজে আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, রাজধানী ইয়াঙ্গুনে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বৈষম্যের সর্ব-নিকৃষ্ট বিষয়ে পরিণত হয়েছি আমি। আমার সঙ্গে এসব করা হয়েছে, কারণ আমি একজন রোহিঙ্গা- একজন রোহিঙ্গা মুসলিম।

তিনি আরো বলেন, কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিয়ত হত্যা করা হয়েছে। যাদের সব মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে গুলি চালিয়ে হত্যা, জোরপূর্বক ও পরিকল্পিত উপায়ে আমাদের গৃহহীন করা হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই বাড়ি-ঘর ধ্বংস করা হচ্ছে; আমরা একটি রাষ্ট্রের নৃশংসতা শিকার।

১২ বছর বয়সী জসিম ১৩ দিন আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে এলেও ছোট্ট জসিম বাবাকে রেখে এসেছেন রাখাইনে। এখনও জানে না তার বাবা কোথায় আছেন, কেমন আছেন।

রোহিঙ্গা শিশু জসিম জানায়, তার ভয়াবহ ১৩ দিনের কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার গল্প। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে তার মনে লুকিয়ে থাকা মিয়ানমারের নাগিরকত্ব পাওয়ার প্রত্যাশা আর আর্তনাদের কথা।

সে জানায়, এই সঙ্কটের আগে, আমি স্কুলে পড়াশোনা করছিলাম। আমার পছন্দের বিষয় ছিল ইংরেজি। কারণ আমি মনে করতাম যে, আমি যদি জানি কীভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়; তাহলে আমি বিশ্বের অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং তাদের কাছে আমার মতামত জানাতে পারব। আমি আশা করছি, আবারও আমি পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারব।

গ্রামে যখন ১০০ বা ২০০ সেনাবাহিনী আসে তখন আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল এবং লুকিয়ে ছিলাম। তারা আমাদের গুলি করেছিল এবং আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল- আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমরা জঙ্গলে লুকিয়েছিলাম। পরে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করি। এখানে আসতে প্রায় ১৩ দিন লেগে যায়, অনেক সময় আমরা জঙ্গলে থেমেছিলাম এবং বনের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

মোয়াজিন হোসেন তার সঙ্গে মা, স্ত্রী এবং তিন সন্তানও রয়েছে। তিনি মিয়ানমারে তুমব্রু রাইট গ্রামে তিনদিন না খেয়ে অবস্থান করেছিলেন। রাতে সীমানা পার হয়ে নো-ম্যান্সল্যান্ডে চলে আসেন। ভোরে এসে পৌঁছান কুতুপালংয়ে।

তিনি বলেন, গ্রামের অনেকেই এখানে এসেছে বলে জানতে পেরেছি। জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছি, শুকরিয়া। আশা করি এখানে একটা জায়গা হবেই। খাবারও মিলবে, আবার হত্যার ভয় নেই।

মিয়ানমারের কুসিডং উপজেলা থেকে এসেছেন রাহেনা। বৌদ্ধ মগরা স্বামীকে হত্যা করেছে ঈদের দু’দিন পর। পাশেই আরেক বৌদ্ধ বাড়তি পালিয়ে ছিলেন চারদিন। শনিবার রাতে রওনা দিয়ে রোববার বিকেলে বালুখালীতে এসে পৌঁছান। দুই সন্তান নিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছেন। এপারে এসে এক টুকরো পলিথিন কাগজও সাহায্য পেয়েছেন। এখন জায়গা খুঁজছেন সামান্য টঙঘর বানাতে। রাহেনার মতো অসংখ্য অসহায় রোহিঙ্গা ছুটে আসছে বাংলাদেশে।

এটা ছিল কঠিন যাত্রা, আমরা বড় পাহাড় ও কিছু ছোট নদী পাড়ি দিয়েছি। আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন সব সময় ভয় করছিলাম যে সেনাবাহিনী এই বুঝি আমাদের ঘিরে ফেলবে এবং বাংলাদেশে প্রবেশের আগে আমরা সতর্ক হয়েছিলাম। কারণ সেনাবাহিনী ভূমিতে ছোট্ট বোমা পুঁতে রেখেছে; আমরা যদি এটির উপর দিয়ে হেঁটে যাই তাহলে বিস্ফোরিত হবে।

এক রোহিঙ্গা জানান, শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি ২০১৫ সালে যখন সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয় এবং সেনাবাহিনীর অর্ধ-শতাব্দীর আধিপত্যের অবসান ঘটে, তখন রোহিঙ্গরা আশা করেছিল যে পরিবর্তন আসছে। আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল যে, গণগন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত এই নারী আমাদের হয়রানি ও নিপীড়নের অবসান করবেন। তিনি আমাদের দুঃখ-কষ্টকেও মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু তার নীরবতা দেখিয়েছে, সহিংসতায় তার ইন্ধন আছে।

এর আগে ২০১২ সালে মিয়ানমারে ভয়াবহ সহিংসতায় রাখাইনে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। অভ্যন্তরীণভাবে অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৬ সালেও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

গত শুক্রবার কক্সবাজারে ঢোকার পর টেকনাফের হোয়াইখ্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকায় একটি স্কুলে শনিবার রাত কেটেছে মংডুর তুলাতলী থেকে আসা মো. ফারুকের।

তিনি বলছেন, তাদের এলাকার হাজার দেড়েক মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী।

ফারুকের হিসেব, সেখানেই অন্তত আটশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যারা গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ছিলেন,  কিন্তু তাদেরকে পরে আগুনে পোড়ানো হয়। জীবন্ত মানুষসহ অনেক ঘরে আগুন দেয়া হয়। এর মধ্যে দুই একজন পুড়তে পুড়তে পালিয়ে বাংলাদেশ আসতেও পেরেছে বলেছে জানান তিনি।

কাউয়ার বিল থেকে এসে উখিয়ায় বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মো. ইউনূস। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নিজের চাচাকে খুন হতে দেখেছন তিনি।

ইউনূস জানান, সেনাবাহিনী এসে তার চাচাকে ঘর থেকে বের করে গাড়ির সঙ্গে বাঁধে। গাড়ি চালিয়ে আধা কিলোমিটারের মত টেনে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে গুলি করা হয়।

সত্তরোর্ধ্ব মোহাম্মদ সিদ্দিকের চার ছেলে এক মেয়ে। ডমরুর থামি থেকে বাংলাদেশে আসার পথে প্রায় ১৫দিন পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরতে হয়েছে তাকে।

উপার্যনক্ষম বড় দুই ছেলের মৃত্যু তিনি দেখেছেন নিজের চোখে। সেনাবাহিনী ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু বাপ-দাদার ভিটায় শয্যা হবে না- এ তিনি ভাবতেও পারছিলেন না।

তবে ঘরবাড়ি ছেড়ে অচেনা বাংলাদেশে আসার পথে তাকে বার বার পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছিল একমাত্র মেয়ের স্বামীর খোঁজে। নিজের মেয়ের দিকে তাকাতে পারছিলেন না তিনি।

সিদ্দিক জানান, মেয়ে জামাইয়ের মৃত্যু হয়েছে জানতে পারলেও এতটা পিছুটান থাকতে না। মেয়ে তার স্বামীকে ছাড়া আসতে চাইছিল না। তাই আসার পথে কোনো একটি নিরাপদ রোহিঙ্গা গ্রাম খুঁজেছিলেন, যেখানে থেকে যাওয়া যায়।

কিন্তু ১৫ দিন ঘোরাঘুরি করেও কোনো রোহিঙ্গা গ্রামকে নিরাপদ থাকতে দেখেননি এই বৃদ্ধ। শেষমেষ জনস্রোতে মিশে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশে।

দুই ছেলের মৃত্যু শোকের সঙ্গে এখন নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত সিদ্দিক। জীবনের সব সম্পদ আর সঞ্চয় এক দিনে হারিয়ে এই বয়সে তাকে অন্য দেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর খাবারের সন্ধানে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

সিদ্দিকের মেজ ছেলের বউ ফাতিমা স্বামীকে মরতে দেখেছেন চোখের সামনে। ঈদের সপ্তাহখানেক আগে দিনের কাজকর্ম সেরে ঘুমিয়েছিলেন তারা। রাতে হঠাৎ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পাড়ায় হানা দেয়।

ফাতিমা বলেন, বাড়িতে এসেই সেনাবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। শোয়া থেকে স্বামীকে তিনি উঠে বসতে এবং আবার গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেন। পরে ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরের সঙ্গে সীমান্তের পথ ধরেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে রাখাইন রাজ্যের মন্ডু উপজেলার মেরালা গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ এসেছেন দিলবাহার। চোখের সামনেই দেখেছেন, দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার মাকে জবাই করে হত্যা করেছে। চোখের সামনে মাকে জবাই করতে দেখে তিনি এখন অনেকটাই বাকরুদ্ধ।

ঈদের পাঁচদিন পর মেরালা গ্রামে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় বৌদ্ধ ও মিয়ানমারের সেনারা। গ্রামের অসংখ্য মানুষকে জবাই ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

দিলবাহার বলেন, বৃদ্ধ মা। হাঁটতে পারছিল না। হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের বাইরে আসতেই দা দিয়ে এক কোপে মায়ের গলা কাটল এক সেনা। মা আমার গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল। চিৎকার দেয়ারও সময় পাননি। মায়ের লাশটিও ছুঁতে পারি নাই।

ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি