ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

১ টাকায় খাবার পাচ্ছে পথশিশুরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৪০, ১২ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৪৬, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

"মানুষ মানুষের জন্য, জীবন-জীবনের জন্য; একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু"- প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পি ভূপেন হাজারিকার জনপ্রিয় এ গানটিতে ঠোঁট মেলায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়।

তবে গানটিতে ঠোঁট মেলালেও এর মর্মার্থের বাস্তবায়ন সমাজ জীবনে সবাই কী দেখাতে পারে? সবাই কী পারে অবহেলিত, সহায়-সম্বলহীন পথশিশুদের পাশে দাঁড়াতে? সবাই পারুক আর না পারুক খোদ রাজধানীতেই এমন মানবতাবাদীদের খোঁজ  মিলেছে। আর্তমানবতার সেবায় কয়েকজন বন্ধু মিলে এ কঠিন কাজটি স্বাচ্ছন্দ্যে করে যাচ্ছে। এ কাজে নেই কোনো রকম স্বার্থ বা অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া। সব ধরনের সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে কিছু যুবক ও যুবতীর এমন প্রশংসামূলক কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হচ্ছেন অনেকে। যা থেকে বাদ পড়েননি বেসরকারি চাকরিজীবী রায়হান (ছদ্মনাম)। হাতে গোনা কয়েকজন যুবক-যুবতীর সহানুভূতির এমন দৃশ্য দেখে রায়হান তাই গলা জড়িয়ে আসা ভারভার কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন  ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন-জীবনের জন্য; একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না।’

সপ্তাহ দুয়েক আগে মালিবাগ রেলগেটের নিকটবর্তী দূরপাল্লার গাড়ির একটি কাউন্টারে বসে ছিলেন রায়হান । সময় তখন দুপুর ১টা ছুঁই ছুঁই। কাউন্টারে ছিল তখন একাউন্টেন্ট,  রায়হান ও তার সঙ্গীনী। তিনজনের নীরব উপস্থিতিতে কাউন্টারটি ছিল বেশ নিরিবিলি। মাথার ওপরে ফ্যান চলছে। ফ্যানের ঝিরিঝিরি বাতাসে ক্লান্ত রায়হানের চোখে ঘুম ভর করছে। তবে কাউন্টারম্যানের ফোনালাপনে সে ঘুম আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। রায়হান সে সময় আধো জাগা, আধো ঘুম অবস্থায় বসে আছে। গাড়ীর অপেক্ষায় তার সময় কাটছে খুবই বিরক্তে। রায়হানের পাশে সঙ্গীনীও কী যেন ভাবনায় ডুবে আছে।

ঠিক এমনই একটি মুহুর্তে কাউন্টারের ভিতর কাঁচের গেট খুলে ৩ যুবকের প্রবেশ করে।তাদের একজনের হাতে একটি বক্স, অন্যজনের হাতে কয়েকটি ভিজিটিং কার্ড। তৃতীয় জনের কাছে কিছু না থাকলেও তার মুখে ছিল সুমিষ্ট ভাষা। জিন্স এবং টি শার্ট পরিহিত হয় যুবকদের প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলেন রায়হান। কারণ আগেই বলেছি, ভর দুপুরে কাউন্টারের ভিতরে তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ী চলাচল করলেও সেটা থামিয়ে বিপদের কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। রায়হান প্রথমে তিন যুবককে দেখে ভাবতে থাকেন কোনো অপরাধ সংক্রান্ত বিষয় না তো? তবে তার এ ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ ভেতরে ঢোকা খালি হাতের যুবকটির সুমিষ্ট ভাষায় রায়হান প্রমাণ পেয়েছিলেন যে, এরা আর যাই হোক অপরাধী নয়। রায়হান চোখ কচলাতে না কচলাতেই কানে স্পষ্ট শুনতে পেলেন তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, `স্যার, মানুষ মানুষের জন্য, যতটুকু পারেন পথশিশুদের পাশে দাঁড়ান।`

এ কথা বলতে না বলতে-ই আরেকজন এগিয়ে এসে একটি কার্ড ধরিয়ে দিল। অন্যজন কাছে এসে দাঁড়ালো তার বাক্স নিয়ে। দু’জনের দিকে একনজর তাকিয়ে কার্ডটিতে চোখ বুলানোর চেষ্টা করলেন রায়হান। যে কার্ডের একপাশে লেখা ছিল ‘খুকুমনি’ সমাজ কল্যাণ সংস্থা। অপর পাশে লেখা ছিল, ‘১ টাকায় খাবার’। অসহায় পথশিশু, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বস্তির শিশু- যাদের খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাদের জন্য আমাদের এই মহৎ উদ্যোগ। কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তির টাকায় চলে আমাদের কার্যক্রম। মাসিক কিংবা এককালীন অনুদান দিয়ে আপনিও অংশগ্রহণ করতে পারেন এই মহৎকাজে। আপনার ৫০, ১০০, ৫০০ বা ১০০০ টাকায় অনেকগুলো মানুষের ক্ষুধা নিবারণ হবে। অনুদান দিয়ে (মোবাইল নম্বর) এই নম্বরে টাকার পরিমাণ ম্যাসেজ করে জানাবেন।”

কার্ডটি পড়া শেষ করে-ই রায়হান আবারও ওই তিন যুবকের দিকে তাকালেন। দেখলেন যুবকগুলো অনেক সুদর্শন। হাসিমুখে তিনি জানতে চাইলেন তাদের পরিচয়। অতঃপর একে একে সবাই তাদের পরিচয় দিল। ওদের সবাই ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র। দুইজন অনার্স প্রথম বর্ষের। একজন তৃতীয় বর্ষের। তারা রায়হানকে জানায়, স্যার আমাদের ইচ্ছা হয়, পথশিশুদের জন্য কিছু করি। গরীবের জন্য ভালো কিছু করি। কিন্তু আমরা ছাত্র। কোনো আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় লেখাপড়ার পাশাপাশি যতটুকু সময় আমাদের হাতে থাকে, তা পথশিশুদের আহার যোগানোর কাজে লাগাই। টাকা না দান করতে পারলাম, সময় ও শ্রম তো দান করলাম। আমরা যখন চাকরি করবো, তখন আমরা হয়তো সময় দিতে পারবো না, কিন্তু অর্থ দিতে পারবো।

তাদের এ কথা শুনে রায়হানের চোখে পানি চলে আসলো। তিনি বলে উঠলেন, আহারে সবাই যদি পৃথিবীর এমন হতো! তবে পৃথিবীটা আরও বেশি মায়াবী ও মানবতাবাদী হতো। খুন-খারাবী থাকতো না। সবশেষে রায়হান তাদের বাক্সে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দান করলো। কিন্তু পরক্ষণেই রায়হান কাউন্টারম্যানের আচরণে অবাক হলো। কারণ রায়হানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর কাউন্টারম্যান তাদের ভ্রুক্ষেপই করছিল না। তার অপেক্ষায় প্রায় ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে ওই তিন যুবক। কাউন্টারম্যান ফোনে আলাপ করছিল। রায়হান বুঝতে পারছিল বড় কোনো প্রয়োজনে তিনি আলাপ করছেন না।

কাউন্টারম্যানের এমন আচরণ রায়হানকে খুব বেশি ব্যথিত করে। যতটা মুগ্ধ সে তিন যুবকের উদ্যোগে হয়েছিল, ততটায় যেন মন খারাপ হলো কাউন্টারম্যানের আচরণে। রায়হানের ইচ্ছা হচ্ছিল কাউন্টারম্যানকে তিনি বলবেন, টাকা না দেন বলে দেন, ওদের দাঁড় করে কেন রেখেছেন? এটা ঠিক নয়। কিন্তু সহধর্মিনীর বাঁধায় তা পারেন নি তিনি।

রায়হানের এ কথা শুনে ‘খুকুমনি’ নামক ওই সমাজ কল্যাণ সংস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানে নামে একুশে টেলিভিশন অনলাইন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে মানবিকতার এক অবাক করা চিত্র। মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটি অবহেলিত পথশিশুদের দিয়ে যাচ্ছে এক বেলা খাবার।শুধু কী খাবার! সঙ্গে এসব শিশুকে আলোকিত করতে দেওয়া হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষাও। শিক্ষা দেওয়ার জন্য নেয়া হচ্ছে না কোনো অর্থ। আর খাবারের জন্য যে ১ টাকা, তাও কিন্তু অবাক করা এক মানবিক যুক্তিতে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি উদ্যোক্তাদের ধারণা খাবার পুরো বিনামূল্যে না দিয়ে ১ টাকা রাখা হচ্ছে- পথশিশুদের বড় করে দেখার জন্য। অর্থাৎ নিতান্ত ১ টাকা দিয়ে খাবার কিনে নিলে তারা এটা ফ্রি বা বিনামূল্যে নিচ্ছে না, এটাই প্রমাণ হবে। যা পথশিশুদের সম্মান বাড়াবে। তাদের ভাবতে শেখাবে যে, তারা কারো করুণার পাত্র নয়। কারো দয়া বা দাক্ষিণ্য নিয়ে বড় হচ্ছে না। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে তারাও একদিন সমাজে বড় ও খ্যাতিমান হতে পারবেন।

পথশিশুদের এক বেলা খাবার দেওয়ার এ মহৎ কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থার চেয়ারম্যান আল-মানসুর রহমান বলেন, আমি ব্যাক্তি উদ্যোগে কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ২০১২ সালে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ব্লাড ব্যাংক তৈরি করি। সেখানে অনেক অসহায় মানুষের সেবা দেওয়ার সুযোগ পায়। আর সে সুযোগে আমি মানুষকে সহায়তা করে অনেক তৃপ্তি অনুভব করতে পারি। তখন ভাবতে থাকি আরও বড় পরিসরে কীভাবে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো যায়? সর্বশেষ ২০১৬ সালে ব্যক্তি অর্থায়নে পথশিশুদের খাবার দিতে শুরু করি। কিন্তু এক পর্যায়ে আমার অর্থের টানাপড়েন দেখা দেয়। তখন এ অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে আমি অন্যের সহায়তা খুঁজতে শুরু করি। এক পর্যায়ে আমি বেশ কয়েকজনের সহায়তা পাই। সেখান থেকে আমার এ কার্যক্রম আরও বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমার কার্যক্রমে ১৫ জন তাদের সময়, মেধা ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সবাই অনার্স পড়ুয়া কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের কাওরান বাজার রেলক্রসিংয়ের নিকটবর্তী ও দক্ষিণ গড়ান, বাসাবোতে ‘খুকুমনি’ নামে মোট দুটি স্কুল আছে। যেখানে আমরা শিক্ষা দিতে দুইজন শিক্ষিকা রেখেছি। যারা ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পাঠ দান করেন। ৫ থেকে ১০ বছরের শিশুরা এ শিক্ষা নিতে পারে। কারওয়ান বাজার স্কুলটিতে আমাদের দেড় শত ছাত্র-ছাত্রী আছে। যাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণ করে। পাঠদান শেষে তাদের ১ টাকায় খাবার পরিবেশন করা হয়। কারওয়ান বাজারে শুক্র ও শনিবার ছাড়া সবদিনই পাঠ দান করা হয়। আর দক্ষিণ গড়ান, বাসাবোর স্কুলটি শুধু শুক্রবার বন্ধ থাকে। এ স্কুলে মোট ছাত্র-ছাত্রী ২৫০ জন। যেখানে নিয়মিত ক্লাস করে ৮০ থেকে ৯০ জন।

তিনি আরও বলেন, আমার স্বপ্ন আছে আগামীতে রাজধানীর সর্বত্র পথশিশুদের এ খাবার নিশ্চিত করবো। ভবিষ্যতে স্কুলের সংখ্যা আরও বাড়াবো। এমনকি প্রতিষ্ঠান আরও বড় হলে আমি রাজধানীর অসহায় বৃদ্ধাদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাও করবো। 

আর্তমানবতার সেবায় গঠিত এ সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাকীমা খাতুন বলেন, আমরা সম্পূর্ণ আর্তমানবতার সেবায় এ কাজটি করে যাচ্ছি। চলতি ২০১৭ সালের মার্চে আমরা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছি। আশা করি, আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো। রাজধানীর কমলাপুর, শাহবাগের টিএসসি মোড় এলাকায় আমাদের স্বেচ্চাসেবকরা অর্থ সংগ্রহ করে। আমাদের সংগ্রহিত অর্থ আর কিছু পরিচিতজনদের দেওয়া অর্থে আমারা এ কাজ করে যাচ্ছি।

দক্ষিণ গড়ান, বাসাবো `খুকুমনি` স্কুলের শিক্ষিকা শামসুন নাহার বলেন, আমার যতটুকু বিদ্যা ও সামর্থ আছে, তা যে আমি পথশিশুদের মাঝে দিতে পারছি- এটাই বড়প্রাপ্তি। এখানে সময় ও শ্রম যতই যাক, সেটাকে আমি খুব গর্বের সঙ্গেই দেখি। আগামীতে এ স্কুলের কার্যক্রম আরও বাড়বে। দিনে দিনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, খুব শিগগিরই আমাদের স্কুলের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।

 

ডিডি/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি