ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সীতাকুন্ডের তিন সেচ-প্রকল্প ২৫ বছর ধরে ফাইলবন্দি

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৭:৫৪ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:২৩ পিএম, ২০ জুলাই ২০১৭ বৃহস্পতিবার

সীতাকুন্ডের কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে এমন তিনটি প্রস্তাবিত সেচ-প্রকল্প পঁচিশ বছর ধরে পানিসম্পদ-মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। সময়ের ব্যবধানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তন হলেও আলোর মুখ দেখেনি সেচ প্রকল্প তিনটি। ফলে এ এলাকার কৃষকদের দীর্ঘদিনের সেচ-সমস্যা রয়েই গেছে।

প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী। পরবর্তীতে পানিসম্পদমন্ত্রী হয়েও তিনি তার স্বপ্নের এ সেচ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান অর্থ ছাড় না দেয়ায় প্রকল্পত্রয় আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প তিনটির বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছিল তখন ৫ কোটি ১১লাখ টাকা ও ১৫শ মেট্রিক টন গম। বর্তমানে এর ব্যয় আরও বাড়বে। ১০ কোটি টাকা ব্যয় হলেও সীতাকুন্ডের অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি সেচ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।

শিল্পাঞ্চল সীতাকুন্ড কৃষিতেও সমৃদ্ধ একটি জনপদ হিসেবে পরিচিত। সীতাকুন্ডকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘সবজিজোন’ বলা হয়। চট্টগ্রামশহরসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে শাক-সবজি যোগানের ক্ষেত্রে সীতাকুন্ডের অবদান অনস্বীকার্য। এখানের কৃষকদের আয়ের উৎস জমির আইলে উৎপাদিত সীম। সীতাকুন্ডের সীম প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হয়। সীতাকুন্ডকে অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য স্থানেও সীম উৎপাদন শুরু হয়েছে।

সীতাকুন্ডের ভূগর্ভে পানির স্তর না থাকায় গভীর নলকূপ(সেচ) বসানোর সুযোগ নেই। ফলে সেচ সংকট এখানে তীব্র। চাষাধীন মাত্র ৫ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা রয়েছে। সেচ সংকটের কারণে তৃতীয় ফসল বোরো চাষ করা যাচ্ছে না বলেই বছরে এখানে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি হয়। অথচ চাষাধীন ১০০ ভাগ জমি সেচসুবিধার আওতায় আনা হলে সীতাকুন্ডের খাদ্য-চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি খাদ্যশস্য অন্যত্র সরবরাহের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

সীতাকুন্ডের সেচ সংকট দূরীকরণের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী এমপি এখানের খালের ওপর সেচ-প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সেচ-প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ অঞ্চলের প্রধান তিনটি খাল যথাক্রমে বোয়ালিয়া খাল, গুপ্তাখালি খাল ও নোনাছড়া খালকে সেচ-প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। প্রস্তাবিত এ তিন সেচ-প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো, দুই পাহাড়ের মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধনির্মাণ করে পানি সংরক্ষণাগার সৃষ্টি করা এবং আবাদি জমিতে সেচ প্রদান করে উচ্চফলনশীল ধানসহ অন্যান্য মৌসুমী ফসল উৎপাদন করা। তাছাড়া প্রস্তাবিত সেচপ্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে এলাকার পানি নিষ্কাশন, বণ্যা নিয়ন্ত্রণ ও মৎস্যচাষের ব্যাপক উন্নতি হবে বলে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বোয়ালিয়া সেচ-প্রকল্প

সীতাকুন্ড উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বোয়ালিয়াকুল এলাকায় প্রকল্পটির অবস্থান। এ প্রকল্পের উত্তরে পোল্ডার নম্বর ৬১/১, পূর্বে বিশাল পাহাড়, দক্ষিণে সোনাইছড়ি উপপ্রকল্প ও পোল্ডার নম্বর ৬১/১, সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে একটি প্রাকৃতিক জলস্রোত উৎপন্ন হয়ে বোয়ালিয়া খাল নাম নিয়ে পোল্ডার নম্বর ৬১/১ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে স্লুইচ ১৬ ও ১৬এ দ্বারা সন্দ্বীপ চ্যানেলে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়, সীতাকুন্ড পাহাড়ের যে স্থান থেকে বোয়ালিয়া খালের উৎপত্তি হয়েছে সেই উৎপত্তিস্থলে তিনদিক পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত বলে মাত্র একদিকে ৩০০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মাটির বাঁধ নির্মাণ করে পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১.৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকাবিশিষ্ট একটি পানি সংরক্ষণাগার বা রিজার্ভার তৈরি করা সম্ভব। যেখানে বর্ষাকালে পানি সংরক্ষণ করে শুষ্কমৌসুমে বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রক অবকাঠামো, চেক স্ট্রাকচার ও লো-লিফট পাম্পের মাধ্যমে ভাটির দিকে জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করা এবং সারা বছর মৎস্য চাষ করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত পানি সংরক্ষণাগারে মোটামুটি পানি ধারণক্ষমতা হবে ১১,২৫,০০০ ঘনমিটার (৩০ শতাংশ পানি অপচয় ধরে) যার দ্বারা প্রায় ৭৫০ হেক্টর উচ্চফলনশীল ধানের জমিতে সেচ প্রদান করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২০ হাজার লোক এবং ৩ হাজার পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে ।প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১কোটি ৮০ লাখ টাকা।

গুপ্তাখাল সেচ-প্রকল্প

এই প্রকল্পের উত্তরে সীতাকুন্ড উপজেলা সদর, পূর্বে সীতাকুন্ড পাহাড়, দক্ষিণে বোয়ালিয়া খাল সেচ-প্রকল্প ও পশ্চিমে পোল্ডার নম্বর ৬১/১। বাড়বকুন্ড পাহাড় থেকে একটি প্রাকৃতিক জলস্রোত উৎপন্ন হয়ে গুপ্তাখালী খাল নামে পোল্ডার নম্বর ৬১/১ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে স্লুইচ নম্বর ৫-৬ দ্বারা সন্দ্বীপ চ্যানেলে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাথমিক জরিপে বলা হয়, বাড়বকুন্ড পাহাড়ের যে স্থান থেকে গুপ্তাখালী খালের উৎপত্তি হয়েছে সেখানের তিনদিক পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত বলে একদিকে ৩০০ মিটার লম্বা ও পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১ দশমিক ৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে একটি পানি সংরক্ষণাগার তৈরি করা সম্ভব। প্রস্তাবিত পানি সংরক্ষণাগারে পানি ধারণক্ষমতা হবে ১,১২,৫০,০০০ ঘনমিটার। এ পানি দ্বারা ৫৫০ হেক্টর উচ্চফলনশীল ধানের জমিতে সেচসুবিধা ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। প্রকল্প এলাকার ৩/৪ হাজার লোকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গুপ্তাখালী খাল পুনঃখননের জন্যে গম ধরা হয় ৫শ মেট্রিক টন।

নোনাছড়া সেচ-প্রকল্প

প্রকল্পটির উত্তরে পোল্ডার নম্বর ৬১/১ এর উত্তরাংশ, পূর্বে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়, দক্ষিণে সীতাকুন্ড উপজেলা ও পৌরসভা সদর ও পশ্চিমে পোল্ডার নম্বর ৬১/১। সীতাকুন্ড পাহাড় থেকে প্রাকৃতিক জলস্রোত উৎপন্ন হয়ে নোনাছড়া নামে পোল্ডার নম্বর ৬১/১ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে স্লুইচ নম্বর ১৩ সি ও ১৩-১৪ দ্বারা সন্দ্বীপ চ্যানেলে পড়েছে। প্রকল্পটির তিনদিক পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই একদিকে ২০০ ও ১৫০ মিটার লম্বা ও ১০মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট মাটির বাঁধ নির্মাণ করে পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে একটি পানি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা যেতে পারে। এ পানি সংরক্ষণাগারে পানি ধারণ ক্ষমতা হবে ৭৫,০০০০০ ঘনমিটার (৩০% পানি অপচয় ধরে)। যা দিয়ে ৫শ হেক্টর উচ্চফলনশীল ধানের জমিতে সেচ প্রদান করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এখানের ১৫ হাজার লোক ও ২ হাজার পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প এলাকার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। এলাকার ভৌত পরিবেশের প্রভুত উন্নতি ঘটবে। প্রকল্পে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্তির কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। আশা করি, জনস্বার্থে বিষয়টি নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হবেন।   

লেখক: প্রধান সম্পাদক, চাটগাঁর বাণী।