ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

গীবত কীভাবে সবকিছু নষ্ট করে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:১৭ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২৪ শুক্রবার

গীবত বা পরনিন্দা মানুষের ভেতরকার শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্টকারী এক ঘৃণ্য অপরাধ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এটাকে নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো অরুচিকর ঘৃণিত কাজের সঙ্গে তুলনা করেছে। আর হাদিস শরিফে ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক অপরাধ বলা হয়েছে। আমাদের সমাজের প্রায় মানুষ গীবতকে খুবই মামুলী বিষয় ভেবে নিচ্ছি। একে অপরের দোষচর্চাকে কোনোভাবেই দোষনীয় ও দূষণীয় মনে করছি না। ফলে গীবত বর্জনের কার্যকর কোনো প্রচেষ্টাও আমাদের নেই।

ভাইয়ের দুর্নাম মানে গীবত
অথচ নবীজি (সা.) সবসময় সাহাবিদের গিবত থেকে সতর্ক করতেন। একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘গীবত কী, তা কি তোমরা জান? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। নবীজি (সা.) তখন বললেন, গীবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যা বলি- তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, এটাও কি গিবত হবে? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে— তাহলেই তা গিবত। আর যদি তার মধ্যে না থাকে— তাহলে তো তা অপবাদ।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯০)

গিবত সাধারণত কোনো অবস্থাতেই বৈধতা পায় না। গিবত করার মতো এটা শোনাও গুনাহের কাজ। গিবতের কারণে নিন্দুক যেমন দুনিয়াতেই অধঃপতিত হয়, তেমনি আখেরাতেও রয়েছে তার জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, 'যখন আমার প্রতিপালক আমাকে মিরাজে নিয়েছিলেন— তখন আমি এমন একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের হাতের নখগুলো পিতলের নখের মতো। তারা নিজেদের মুখ ও বুক খামচাচ্ছিল এই নখ দিয়ে। তাদের ব্যাপারে জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলেছিলেন, এরা সেইসব অভাগা যারা দুনিয়ায় মানুষের গোশত খেতো এবং অগোচরে সমালোচনা করে তাদের সম্মানহানি করতো।' (মিশকাত, হাদিস : ৪৮৭৪)

রোজা মানে অপ্রয়োজনীয় কথা মিথ্যা এবং গীবত পরচর্চা থেকে বিরত থাকা
রোজা আপনাকে যে শিক্ষা দেয় সেই শিক্ষাটা কিন্তু অন্তরশুদ্ধি। এবং এই অন্তরশুদ্ধির সাথে মেন্টাল সোশ্যাল এবং স্পিরিচুয়াল। এই তিনটা দিকই হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেন্টাল সোশ্যাল এন্ড স্পিরিচুয়াল। মানসিক সামাজিক এবং আত্মিক। এটার জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে অন্তরশুদ্ধি, এবং অন্তরশুদ্ধি প্রয়োজনটা কেন? নবীজী (স)-এর হাদীসকে আমরা জানি, মনের দূষণ শরীরকে দূষিত এবং অসুস্থ করে তোলে, ক্বালব বা মন দূষণমুক্ত হলে শরীর দূষণমুক্ত ও সুস্থ হয়।

তো যখন আপনি রোজা রাখছেন আপনি তখন শুধু খাবার থেকে বিরত থাকছেন না, আপনাকে বিরত থাকতে হচ্ছে জিহ্বার আরেকটি কাজ থেকে, সেটা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় কথা মিথ্যা এবং গীবত পরচর্চা।

আমরা রোজার সওয়াব কত এটা আমরা জানি রোজাতে উপকার কত নেকি- কত জানি। কিন্তু রোজা কিসে নষ্ট হয়ে যায় সেটা আমরা জানি না। রোজা নষ্ট হওয়ার জন্যে শুধু খাবার খাওয়া নয় আপনি যখনই গীবত করছেন পরনিন্দা এবং পরচর্চা করছেন তখনই আসলে সাথে সাথে আপনার রোজা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মা আয়েশা (রা) খুব বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন একজন মানুষ হালাল খাবার খেয়েছে সেটার জন্যে মুখ ধোয় কিন্তু হারাম কথা যে বলেছে গীবত পরচর্চা যে করেছে এজন্যে সে কখনো মুখ ধোয় না।

তুমি যদি দুর্ব্যবহারকারী এবং দুশ্চরিত্র হও, এই হাম্মাম থেকে কিছু প্রত্যাশা করো না
তুরস্কের বাথ থাকত মানে হাম্মাম। গণ গোসলখানা। একটা গোসলখানায় লেখা ছিল ইস্তাম্বুলে অনেক আগে তুমি যদি দুর্ব্যবহারকারী এবং দুশ্চরিত্র হও এই হাম্মাম থেকে তুমি কিছু প্রত্যাশা করো না। এই হাম্মামে তুমি যদি পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন হতে চাও তাহলে প্রথম তোমার অন্তরটাকে পরিশুদ্ধ করো তারপরে এখানে আসো, আমরা তোমার দেহটাকে পরিশুদ্ধ করে দেবো। এই যে গান আছে না অন্তর না রাঙিয়ে সখী বসন রাঙালে কী হবে? অন্তরে যদি সন্ন্যাস না হয় তো পোশাকে সন্ন্যাস হয়ে কোনো লাভ নাই। তো অন্তরে সন্ন্যাস হওয়াটা হচ্ছে ইম্পর্টেন্ট। অন্তরে সন্ন্যাস হওয়াটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থাৎ রোজার মূল জিনিস অন্তরশুদ্ধি করা। এবং তার মধ্যে নম্বর ওয়ান পয়েন্ট হচ্ছে গীবত। এবং গীবত আসলে কীভাবে একজন মানুষের পুণ্যকে নষ্ট করে এটা আমরা জানি না। এটা নিয়েও একটা খুব মজার ঘটনা আছে।

যখন কারো গীবত করছেন তার পাপ আপনার আমলনামায় যুক্ত হচ্ছে
ইমাম শারানী, উনি খুব বড় ইমাম ছিলেন। ইমাম শারানী তার বইতে এক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। যে এক শহরে একলোক ছিল যে এই গীবত এবং পরনিন্দা পরচর্চায় আসক্ত। এমন কোনো লোক নাই যার সে নিন্দা করত না, এমন কোনো লোক নাই যার সে গীবত করত না। তার মহল্লাতে একজন বুজুর্গ ছিলেন, খুব বড় বুজুর্গ ছিলেন অলি ছিলেন। তার গীবত করতেও কখনো কোনো সংকোচবোধ করেন নাই সেই ব্যক্তি। তো এটা তার কানেও গেল। যে হুজুর আপনার নামে এই এই বদনাম করছে এই এই গীবত করছে সে লোক। তো যখন হুজুর এটা শুনলেন হুজুরের সাথে যখনই ঐ লোকের দেখা হতো হুজুর আগে তাকে খুব হেসে সালাম দিতেন এবং হাসি দিয়ে বলতেন অ্যা আসো আসো, আমার বন্ধু আমার পার্টনার আসো। এবং এটাও তার কিন্তু মানে গীবত বন্ধ করে নি। সে গীবত করেই চলছে এবং ঐ বুজুর্গ তার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই তাকে ঐভাবেই আহ বন্ধু আসো, ভালো আছ? তুমি বন্ধু আসো, আমার পার্টনার তুমি, বন্ধু আসো।

তো হুজুরের সুন্দর আচরণ এই গীবতকারীর মনে গিয়ে লাগল যে আমি এই লোকটার এত বদনাম করি এত গীবত করি আর দেখা হলেই এমন সুন্দরভাবে সালাম দেয়, হেসে বলে যে পার্টনার বন্ধু আসো, তুমি আসো কাছে আসো। বলে যে না এর নামে আর গীবত করব না। সে প্রতিজ্ঞা করল এবং সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করল। সে হুজুরের ব্যাকবাইটিং বন্ধ করে দিল। যখন সে ব্যাকবাইটিং মানে গীবত করা বন্ধ করে দিল হুজুর তাকেও কমপ্লিমেন্ট দেয়া বন্ধ করে দিলেন। দেখা হয় সালাম হয়। আসসালামু আলাইকুম, ওয়াআলাইকুমুস সালাম। কিন্তু আগের মতো, এই যে বন্ধু পার্টনার আসো, হাসি দিয়ে সেটা আর হয় না স্বাভাবিক।

তো বিস্মিত হলো- এই গীবতকারী বিস্মিত হয়ে একদিন সে ঐ বুজুর্গকে ধরেই ফেলল। বলে যে, হুজুর আমি যখন আপনার গীবত করতাম তখন আপনি এত সুন্দর হাসি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানাতেন, বলতে যেন বন্ধু পার্টনার আসো। আর আমি গীবত বন্ধ করে দিলাম আপনি হাসিও বন্ধ করে দিলেন। এখন আর বন্ধু পার্টনার কিছুই বলেন না। খালি শুধু সালাম আর সালামের জবাব। আমি এটা বুঝলাম না? তো বুজুর্গ বললেন যে, দেখো, তোমার সাথে আমার একটা ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ ছিল। এখন যেহেতু সেই পার্টনারশিপটা আর নাই সেই অংশীদারিত্ব নাই। সো তোমাকে সম্ভাষণ জানানোর তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বিষয়টাও নাই। তো এই গীবতকারী অবাক হয়ে বলে যে, কী ধরনের পার্টনারশিপ? আপনার সাথে তো আমার কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন কখনো ছিল না?

তখন হুজুর বলা শুরু করলেন, তুমি আমার বিরুদ্ধে সব জায়গায় গীবত করতে বদনাম করতে আমি ধৈর্যধারণ করলাম। দেখলাম যে তোমার নামে কোনো কথা বলার চেয়ে চুপ থাকা আমার জন্যে ভালো। এবং আমার এই ধৈর্যের জন্যে আল্লাহ তায়ালা আমাকে পুরস্কৃত করলেন। যে আমার যত গুনাহ, সমস্ত তোমার খাতাতে লেখা হতে শুরু হলো। এবং তোমার যত ভালো কাজ সে ভালো কাজ আমার খাতাতে লেখা শুরু হলো। আমি দেখলাম এটাতো একটা খুব বেনিফিসিয়াল পার্টনারশিপ। এর চেয়ে লাভজনক অংশীদারিত্ব তো আর কিছু হয় না। যে আমার পাপ মোচন হচ্ছে আর তোমার নেকি আমার খাতায় এসে জমা হচ্ছে। এজন্যে আমি তোমাকে খুব প্রশংসা করেছি। তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে গুড পার্টনার হিসেবে তোমাকে সম্ভাষণ জানিয়েছি। এখন তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনো গীবতও করো না, আমার পাপ দূর হয়ে পুণ্যও এখানে লেখা হয় না। সো আমাদের যে পার্টনারশিপ ছিল এটা ওভার হয়ে গেছে, এটা পার হয়ে গেছে।

অর্থাৎ আপনি যখন কারো গীবত করছেন তার পাপ আপনার আমলনামায় যুক্ত হচ্ছে এবং আপনার আমলনামা থেকে আপনার পুণ্য তার আমলনামায় গিয়ে যুক্ত হচ্ছে।

গীবত বন্ধ করা মানেই হচ্ছে আপনি আল্লাহ-সচেতন হয়েছেন
অতএব এই রমজানে কোনো গীবত না। শুধু এই একটি কাজ এই রমজানে যদি আপনি বাদ দিতে পারেন আপনার মন পরিশুদ্ধ হবে সামাজিকভাবে এবং আত্মিকভাবে। যেটা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর যাতে তোমরা আল্লাহ-সচেতন থাকতে পারো।

এবং গীবত বন্ধ করলেই আপনি আল্লাহ-সচেতন থাকতে পারবেন। কারণ আল্লাহ-সচেতন না হওয়া পর্যন্ত আপনি গীবত বন্ধ করতে পারবেন না। এটা ভাইস ভারসা। গীবত বন্ধ করা মানেই হচ্ছে আপনি আল্লাহ-সচেতন হয়েছেন। এবং এই আল্লাহ-সচেতনতাই তাকওয়া। এই তাকওয়া হচ্ছে ঈমানের একটা বড় স্তর।
কেআই//