ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মানসিক ভারসাম্যহীনদের পাগল বলবেন না প্লিজ

কাজী ইফতেখারুল আলম

প্রকাশিত : ০৯:৫৩ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ১২:২১ এএম, ৩ আগস্ট ২০২৩ বৃহস্পতিবার

দীর্ঘ এক দশক ধরে যমুনা ব্যাংকের আইটি বিভাগে কাজ করছেন শামীম আহমেদ। চাকুরির পাশাপাশি মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। তবে সেবার ধরনটা একটু ভিন্ন। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যারা রাস্তাঘাটে ভবঘুরে হয়ে পড়েন, যাদের দেখাশোনার কেউ থাকে না, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শামীম আহমেদ। রাস্তা থেকে কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে তুলে এনে সেবা দিয়ে সুস্থ করে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে দেন তিনি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন রোগীকে সুস্থ করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন শামীম আহমেদ। তারা এখন পরিবারের সাথে সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের সেবা দেওয়ার গল্প নিয়ে শামীম আহমেদ মুখোমুখি হয়েছেন ইটিভি অনলাইনের। সাক্ষাতকার নিয়েছেন কাজী ইফতেখারুল আলম

ইটিভি অনলাইন : প্রথমে শুরুর গল্পটা শুনতে চাই- 

শামীম আহমেদ : ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে বান্দরবান জেলার থানচিতে কয়েকজন অফিস সহকর্মীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। থানচি বাজারে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করে দেখতে পাই মানসিক ভারসাম্যহীন একটি মেয়ে গাছের নীচে বসে আছে। দুইদিন পর থানচি থেকে ঢাকা চলে আসার পথেও দেখি গাছের নীচেই মেয়েটি বসে আছে। মেয়েটিকে দেখে আমার খুব মায়া হয়। তারপর,  ঢাকায় আসার পর মেয়েটির অসহায় মুখখানা আমার চোখে ভাসতে থাকে। মেয়েটিকে সুস্থ্য করে তোলার চিন্তা করি। পরে আমার ভাবনাটা সহকর্মী আলী সাব্বির এর কাছে প্রথম প্রকাশ করি। তিনি আমার সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী সময়ে আলী সাব্বিরের আরেক বন্ধু হাসান ফরহাদ আজাদ আমাদের সাথে যোগ দেন। সম্পূর্ণ এই ব্যাপারটিতে আমার অন্য কয়েকজন সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কীভাবে মেয়েটিকে থানচি থেকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলা যায় সেই চিন্তা থেকে মূলত আমার এই কাজের সূচনা। 

ইটিভি অনলাইন : মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের রাস্তা থেকে তুলে এনে কীভাবে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন? বিস্তারিত শুনতে চাই-

শামীম আহমেদ : প্রথমে বলি অন্তরের গল্প। আমি প্রথমে বান্দরবান থেকে এই যাত্রা শুরু করি। মেয়েটিকে ঢাকায় আনার পর শেরেবাংলা নগর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। যেহেতু তার নাম জানি না তাই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনে তার নাম  দেই অন্তর। তাকে পরিচর্যা করার জন্য জরিনা বেগম নামের একজন বেতনভুক্ত আয়া রেখে দিলাম। অন্তর সুস্থ হলে জানতে পারলাম তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহজাদাপুরে। তার নাম শিউলি রানি সরকার। তার ২ ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে। পরে তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। মানবিক এই প্রতিবেদনটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে প্রচারসহ শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকগুলিতে প্রকাশিত হয়।

সরাইল উপজেলা মিলনায়তনে ব্যক্তি উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানের অয়োজন করা হয়। সেদিন পরিবারের কাছে মেয়েটির হস্তান্তর আনুষ্ঠানে তার স্বামী ফালান সরকার নতুন করে সিঁদুর পরিয়ে তাকে বরণ করে নেন। এ সময়  অন্তর নামের সেই শিউলি রানী সরকারকে একটি সেলাই মেশিন, নগদ টাকা ও সোনার নাক ফুল প্রদান করা হয়। ব্যতিক্রমধর্মী ও মানবিক আবেদনময়ী এ অনুষ্ঠানটি ভবিষ্যতে মানবিক কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

ইটিভি অনলাইন : পরে কতজন রোগীকে সুস্থ করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিলেন?  কীভাবে এই সেবা পরিচালনা করছেন?

শামীম আহমেদ : মানিকগঞ্জের জিকু নামের এক লোকের সঙ্গে বাসে পরিচয় হয়। আলাপচারিতায় জানতে পারি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনীতে পরিচয়হীন মানসিক ভারসাম্যহীন এক মেয়ে অসহায় অবস্থায় দিনাদিপাত করছে। মানিকগঞ্জ স্থানীয় সাংবাদিকদের সহযোগিতায় ও বন্ধু আলী সাব্বিরসহ মেয়েটিকে উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে আসি। অন্তরের মতো একইভাবে তাকেও  জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করিয়ে দেই। তার নাম দেই পারুলি। পারুলিকে ঢাকার আদাবর এলাকায় আমাদের আয়ার তত্বাবধায়নে রেখে দুই মাস সেবা দেয়া হয়। পড়ে রাস্তায় অঙ্গাতপরিচয়ের এই মানসিক ভারসাম্যহীন পারুলি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এইভাবেই বদলে যায় পারুলির জীবন।

২০১৫ সালের আরেকটি ঘটনা। একদিন রাজধানীর পল্টন মোড়ে রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ ছেড়া  কাপড় পরে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে দেখতে পেলাম। সহকর্মী আলী সাব্বিরকে নিয়ে পল্টন থানা পুলিশের সহায়তায় অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্যহীন সেই মেয়েটিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়। সেই সময় তার নাম রাখি আদুরি। আদুরি সুস্থ হলে জানতে পারি তার বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে। তার আসল নাম জবা। পরে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। এখন সে ভালো আছে।

এবার কহিনুরের গল্প বলি। ফরিদপুরের ডোমরাকান্দি কৃষি কলেজের রাস্তার পাশে যাত্রী ছাউনির ভেতরে উলঙ্গ কহিনুর পাগলীকে দেখে কেউ এগিয়ে আসেনি। রুহুল আমিন নামের এক দন্ত চিকিৎসকের কাছে ফেসবুকের মাধ্যমে এই পাগলির বিষয়টি জানতে পারি। একদিন ঠিকই হাজির হলাম রুহুল আমিনের বাসায়। তারপর কহিনুর পাগলিকে নিয়ে এসে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। তার শরীরে কিছু আঘাত ও ক্ষত থাকায় প্রাথমিক চিকিসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন জেলা প্রশাসক। এখনও কহিনুর চিকিৎসাধীন।

এবার রানির বদলে যাওয়ার গল্প। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি বাজারে পড়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী।  তাকে ঢাকায় নিয়ে এনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। তার নাম দিলাম রানি। দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেয়ার পরে সে এখন সুস্থ। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের থানা পাড়ায়। সোমবার (২৮ আগস্ট) তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হবে। 

ইটিভি অনলাইন : আপনি রাস্তা থেকে তুলে এনে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন, এক্ষেত্রে রোগীর পথ্য খাবার কীভাবে সরবরাহ করছেন? কী পরিমান টাকা প্রতি মাসে খরচ করতে হচ্ছে ?

ইটিভি অনলাইন : এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পাই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়। আর যাদের বাসায় রেখে সেবা দিচ্ছি তাদের ওষুধ দুই তিন মাসের জন্য কিনে দেই। আর ঢাকার বাহিরে থাকলে কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদের সেবার পেছনে আমার প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। 

ইটিভি অনলাইন : মানবসেবা করতে গিয়ে অফিসের কাজের ব্যাঘাত সামলান কীভাবে? 

শামীম আহমেদ : আমি সপ্তাহে ২ দিন ছুটি পাই,  মাসে ৮ দিন আমি একাজে সময় দিতে পারি। বিশেষ কোনো ছুটির দিনেও এদেরকে হাসপাতালে দেখতে পারি। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমাদের একটা গ্রুপ আছে। যা থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে পারি।

ইটিভি  অনলাইন : এই কাজে আপনাকে কে কে সহযোগিতা করছেন?  আপনার পরিবারের ভূমিকা কী ?

শামীম আহমেদ : আমার সহকর্মী আলী সাব্বির আমাকে এইকাজে সব সময় সহযোগিতা করে আসছেন। এছাড়া আমার স্ত্রী আমাকে এসব কাজে আন্তরিক সহযোগিতা করছেন। এই মহৎ কাজ পরিচালনার জন্য সরকারি কিংবা  বেসরকারি কোনো সংস্থার সহযোগিতা পেলে এর কর্মপরিধি বাড়ানো যেত। রাস্তাঘাটে পরে থাকা এই  অসহায় মানুষগুলো যদি আরো বেশি সেবা পেত তবে দ্রুত তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো।

ইটিভি অনলাইন : ভবিষ্যতে এ ধরণের রোগীদের নিয়ে কি করতে চান? এ নিয়ে আপনার যদি কোনো স্বপ্ন থেকে থাকে-

শামীম আহমেদ : আমার লক্ষ্য হলো, ভবিষ্যতে একটি মানসিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে রাস্তায় পড়ে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হবে। এর পাশাপাশি সেখানে গড়ে তোলা হবে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, যেখানে থাকবে সুস্থতায় ফিরে আসা মানসিক রোগীরা। সেখানে আরো পুর্নবাসিত হবে, পরিত্যক্ত পথশিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। তবে এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান রইল।

ইটিভি অনলাইন : অনেকে অনেকভাবে মানবসেবা করছেন। কিন্তু আপনি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করছেন। এটা ব্যক্তিক্রম। এ বিষয়ে আগ্রহের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?

শামীম আহমেদ : দেখুন, এই ধরনের মানুষকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারছি এটাই পরম সুখ। এই আনন্দ অন্য কিছুতে পাই না। একজন ভিক্ষুক আমাদের কাছে টাকা অথবা কিছু খাবার চাইতে পারে। কিন্তু একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কিছু চাইতে পারে না, কিছুই বুঝাতে পারেন না। তারা নিতান্তই অসহায়। এদের ভালোবাসা দরকার। আমরা যদি সবাই রাস্তায় পড়ে থাকা এসব মানুষের পাশে দাঁড়াই, যদি তাদের কল্যাণে একটু এগিয়ে আসি,  তাহলে হয়তো একদিন এদেশের রাস্তা ঘাটে, খোলা পার্কে অনাদরে অবহেলায় কোনো অসুস্থ মানুষ পরে  থাকবে না। আবারও বলছি এরা পাগল না। এদের কেউ পাগল বলবেন না।

ইটিভি অনলাইন : মানসিক রোগীদের নিয়ে আপনার এই কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজের উদাহরণ। সমাজের কিছু মানুষ এদেরকে সমাজ, পরিবার থেকে আলাদা করে দেখতে চায়। এ ব্যাপারে কি বলবেন? আপনার এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চান?

শামীম আহমেদ : আমাদের সমাজে পথশিশু, হিজরা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক নারী-পুরুষদের নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। অথচ এসব মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদেকে নিয়ে কেউ কাজ করছেন না, এগিয়ে আসছে না। সব কাজ সরকার করবে এমনটা ভাবাও ঠিক না। আসুন সবাই মিলে এসব ভারসাম্যহীন মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাদের সুস্থ করে স্বজনদের মাঝে ফিরিয়ে দেই।

আমি একটা কথা বলতে চাই সবাইকে, আপনারা কেউ এসব মানসিক রোগীদের পাগল বলবেন না। এরা আমাদের কারো ভাই,  বন্ধু, বোন, কারো প্রিয়তম আপনজন, এরা আপনার আমার নিকট স্বজন। এরা মহাকালের প্রবাহমান সময়ের কিছু অবচেতন মানুষ। এদের কেউ অবহেলা করবেন না, এটা অসুন্দর, অমানবিক। এরা  কখনও আমাদের মতই সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। হয়তো একটু ভালোবাসা পেলে, একটু সুচিকিৎসা পেলে এরাও আমাদের মতন বাঁচার সুযোগ পাবে। সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। 

ডব্লিউএন