ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বিবিসির বিশ্লেষণ

রোহিঙ্গা ইস্যূতে সু চির নিরবতা : কৌশল না দূর্বলতা

প্রকাশিত : ১১:৪১ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ১১:৪৬ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বুধবার

এক সময়ে গৃহবন্দী থাকা মায়ানমারের অবিসংবাদিত নেতা অং সান সু চি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের কারণে তাকে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরুষ্কার দেওয়া হয়। সু চি শুধু মিয়ানমারের লোকজনের মুক্তি আন্দোলনের আশার প্রতীকই নন বরং বিশ্ব মানবাধিকারের ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন তিনি। সু চি’র গৃহবন্দী থাকার সময় মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর বিশ্ব দরবারের অনবরত চাপ ও কূটনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পান তিনি। আশা করা হচ্ছিল মুক্তির পর তিনি মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন আনবেন। বিশেষত অবহেলিত মানুষদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। তবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে সু’চির ‘নীরব ভূমিকা’ সেই আশায় গুড়েবালিতে রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির নিরবতা রাজনৈতিক কৌশল নাকি দূর্বলতা?

গত বছরের অক্টোবর এবং চলতি বছর আগস্টের শেষ দিকে চলমান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনা, পুলিশ ও সীমান্ত বাহিনী যে নির্মম আগ্রাসন চালিয়ে আসছে তার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এটেছেন যেন এই নেত্রী। অনেকেই বলছেন, তিনি যখন গৃহবন্দী ছিলেন তখন তার মুক্তিতে ভূমিকা রেখেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাহলে তিনি এখন এমন নির্লিপ্ত কেন? নির্বাচনের আগে মিজ সু চি`র প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি গণতন্ত্রের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সাথে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কিন্তু  সু চি`র সে প্রতিশ্রুতি এখন সুদূর পরাহত।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র এমন নীরব ভূমিকা পালন ইতোমধ্যে সমালোচিত হচ্ছে। দেশটির উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হবার সুবাধে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি একটি কার্যকরী ভূমিকা নেবেন এমনটাই আশা করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লী এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফ জাই এরই মধ্যে সু চি’কে প্রতিক্রিয়া জানাবার আহবান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ইয়াং হি লী সু চি’র নির্লিপ্ততায় তার সমালোচনা করে বলেন, “তাঁর (সু চি) উচিত এবার মূখ খোলা”। আর মালালা বলেন, “আমি যেমন শান্তিতে নোবেল পুরুষ্কার পেয়েছি তেমনি তিনিও পেয়েছেন। আমি তাঁর বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছি”। অন্যদিকে বিশ্বের অনেক শহরেই সু চি বিরোধি বিক্ষোভ হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ সু চি’র নোবেল পুরুষ্কার কেন ফেরত নেয়া হবে না?

তবে সু চি’র এমন অবস্থানকে অনেকেই ‘রাজনৈতিক কৌশল ও দূর্বলতা’ হিসেবেই দেখছেন। সু চি’র দল ক্ষমতায় থাকলেও কার্যত সামরিক জান্তার ওপর তাঁর প্রভাব নেই বললেই চলে। উপরন্তু মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সংসদের ২৫ শতাংশ আসন এখনও সামরিক জান্তার জন্য নির্দিষ্ট। এমনকি স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় এখনও সামিরক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই। তাই বিশ্লেষকদে মতে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে আবারও বিপাকে পরতে পারেন বলেই হয়তো ‘দর্শক’ এর ভূমিকা নিয়েছেন তিনি।

কলকাতায় বিবিসির সাবেক সাংবাদিক ও বর্তমানে মায়ানমারে অবস্থান করা সুবীর ভৌমিক সম্প্রতি বিবিসি’কে বলেন, মিয়ানমারের ভিতরে রোহিঙ্গা বিরোধি তীব্র মনভাব রয়েছে। তারা (মিয়ানমার প্রশাসন) মনে করে ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’র আক্রমণের শিকার হচ্ছে রাখাইনরা”। তিনি আরও বলেন, “তাদের একটা চাপ রয়েছে। কোনভাবেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সাথে কথাবার্তা আলোচনা বা এমন কিছু করা যাবে না যাতে রোহিঙ্গাদের সুবিধা হয়। সেখানে স্বার্থ দেখতে হলে রাখাইনদের স্বার্থ দেখতে হবে। আর সু চি’র নীরব ভূমিকা বিষয়ে তিনি মনে করেন, এটা সু চি’র রাজনৈতিক দূর্বলতা। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী কন্সটিটিউশন (সংবিধান) এমনভাবে করেছিল যে পার্লামেন্টে এক চতুর্থাংশ তাদের সদস্য থাকবে। এটা মেনেই অং সান সু চিকে নির্বাচন করতে হয়েছে এবং এটা পরিবর্তন করার কোন সম্ভাবনা নেই।.. . অং সান সু চি`র টিকে থাকতে গেলে এবং নতুন কোন সেনাবাহিনীর তৎপরতা যাতে না হয় ওনাকে গদিচ্যুত করার, তাহলে তার পক্ষে মনে হচ্ছে খুব বেশি কিছু বলা সম্ভব না।

তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি’র মধ্যেও ক্ষোভ লক্ষ্য করেছেন সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। তাঁর বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, এনএলডি’র একটি অংশ মনে করে, অং সান সু চি`র উচিত সেনাবাহিনীর কাছে বিষয়গুলো জোরালো ভাবে তুলে ধরা। তবে কার্যতভাবে রাখাইন রাজ্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক দেশটির সামরিক বাহিনী।তবে সেনাবাহিনীর একটি অংশ মনে করে, মিয়ানমারে নির্বাচন হলেও রাখাইন রাজ্যে তাদের কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এ অসমাপ্ত কাজটি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের সে অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা। মূলত রোহিঙ্গারা সেদেশে জাতিগত বিদ্বেষেরি শিকার। এখন দেখার বিষয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’ও কী রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে নাকি বিপক্ষে।

 সূত্রঃ বিবিসি

//এস এইচ/এআর