ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মানববর্ম তৈরি করেছিলাম নেত্রীকে বাঁচাতে

প্রকাশিত : ০৯:৩২ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৫:১৭ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের দাবিতে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ডাকা সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যা আসার খবরে সমাবেশস্থল ও এর আশপাশে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। বিশাল ওই সমাবেশে সেদিন ইতিহাসের নৃশংস এক হামলার ঘটনা ঘটে। সমাবেশে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও পুলিশের ছোড়া গুলিতে ঝরে যায় বহু প্রাণ। বীভৎস ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা অমল কান্তি দাস। তিনিসহ আরো অনেকে সেদিন শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মানববর্ম তৈরি করেন। গুলিতে তিনিও গুরুত্বর আহত হন। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা নিজ উদ্যোগে অমলের চিকিৎসা করান। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন অমল কান্তি দাস। তবে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন সেদিনের নির্মমতার ক্ষত। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠেন তিনি। সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে সেদিনের নারকীয় হামলার বর্ণনা দিয়েছেন অমল কান্তি দাস। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইন প্রতিবেদক তমাল আবদুল কাইয়ূম ও রিজাউল করিম

ইটিভি অনলাইন : কেমন আছেন আপনি?

অমল কান্তি : সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা যে তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন বেশ ভালো আছি।

ইটিভি অনলাইন : ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে ৮ দলীয় জোটের সমাবেশে পুলিশ ও বিডিআরের তাণ্ডব চলে। আপনি ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কী ঘটেছিলো ওই দিন?

অমল কান্তি : আমি তখন সীতাকুণ্ড কলেজের ডিগ্রী শেষ বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। তখন আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সীতাকুণ্ড কলেজ শাখার সদস্য ছিলাম। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনটি ছিল রোববার। ওই দিন বিকেলে চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে ৮ দলীয় জোটের পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিল। অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা সীতাকুণ্ড কলেজ শাখার নেতা-কর্মীরা একটি বাস নিয়ে ওই সমাবেশের উদ্দেশে রওনা হই। সমাবেশে লোক সমাগম অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের বাস শহরের বিআরটিসি মার্কেটের সামনে রাখা হয়। সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ লালদিঘির মাঠের দিকে যাচ্ছিলেন। আমরাও বিআরটিসি মার্কেট থেকে মিছিল নিয়ে লালদিঘির মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। নিউমার্কেট মোড়ে যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের বাঁধা দেয়। ব্যারিকেড দিয়ে সবাইকে আটকে দেয়।

অন্যদিকে ঢাকা থেকে বিমানযোগে নেত্রী (শেখ হাসিনা) প্রথমে চট্টগ্রামের বর্তমান শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামেন। বিমানবন্দর থেকে নেত্রীকে বহনকারী গাড়িটি নিয়ে নেতাকর্মীরা মিছিল করতে করতে লালদিঘির মাঠের দিকে আসছিল। নিউমার্কেট মোড়ে এসে নেত্রীকে বহনকারী গাড়িটিও পুলিশ ব্যারিকেডে আটকা পড়ে। পরে আমরা পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে সমাবেশ স্থলের দিকে এগুতে থাকি। মিছিলটি কোতয়ালি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়ে পৌঁছালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলের উপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তখন ওই হামলা থেকে নেত্রীকে রক্ষা করার জন্য চারদিক থেকে নেত্রীকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করি। তখন কোর্ট বিল্ডিং থেকে বার কাউন্সিলের নেতাকর্মীদের মিছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ের দিকে আসছিল। পরে বার কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দসহ আমরা নেত্রীকে পাশের কোর্ট বিল্ডিংয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাই।

ইটিভি অনলাইন : অতর্কিত হামলার পর আপনারা কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন?

অমল কান্তি : ওই মিছিলে নেত্রীর গাড়ির পাশে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বিডিআর-পুলিশ নেত্রীর গাড়িবহরসহ ওই মিছিলটি এমন অতর্কিত হামলার শিকার হওয়ার পর তখন আসলে চিন্তা-ভাবনা করার মতো কিছু ছিল না। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ঙ্কর ছিল যা আমি ভাষায় প্রকাশ করে পারবো না। আমাদের তখন একটি চিন্তাই ছিল যে, নেত্রীকে কীভাবে রক্ষা করা যায়। নেত্রীকে রক্ষার জন্য যে মানববর্ম তৈরি করা হয়েছিল আমিও সেই মানববর্মের মধ্যে ছিলাম। আমি তখন ভাবছিলাম নিজের জীবন দিব তবু নেত্রীর কোনো ক্ষতি হতে দিব না। আপনারা তো জানেন নেত্রীকে হত্যার জন্য এ যাবত বহুবার হামলা হয়েছে। তবে ওই হামলাটাই ছিল প্রথম হত্যাচেষ্টার হামলা। ব্যাংকের মোড়ের ওই হামলায় মানববর্মে অংশ নেওয়া ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৯ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। এই ৯ জন শহীদের বিনিময়ে সেই দিন আমাদের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে বেঁচে যান।

ইটিভি অনলাইন : ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় আপনারা কী কখনও কল্পনা করেছিলেন এ ধরনের ন্যাক্কারজনক হামলা হতে পারে?

অমল কান্তি : না। ওটা তো পূর্ব ঘোষিত একটি সমাবেশ। ওই সমাবেশের অনুমতিও সরকারের পক্ষ থেকে ছিল। তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের নির্দেশ ছিল যেকোনো মূল্যে সমাবেশ বানচালের। তাই তারা পূর্ব ঘোষিত সমাবেশের অনুমতি দিয়েও ইতিহাসের এমন ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়।

ইটিভি অনলাইন : সমাবেশের সময় কী ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল?

অমল কান্তি :আমার জানামতে এমন কোনো কিছু ছিল না। তখন চট্টগ্রাম মহানগরীর পুলিশ কমিশনার ছিলেন মির্জা রকিবুল হুদা। স্বৈরাচারী সরকারের এই পুলিশ কমিশনারের নির্দেশেই বিডিআর-পুলিশ ওই হামলা চালায়। তরুণ নেতাকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হয় লালদিঘি সংলগ্ন কয়েক কিলোমিটার এলাকা। নেত্রীর ওই জনসভায় নির্বিচারে গুলি করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ২৪ নেতাকর্মীকে হত্যা করে স্বৈরাচারী সরকার। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার এই  রকিবুল হুদাকে প্রমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করে।

ইটিভি অনলাইন : তারপরে কী ঘটনা ঘটেছিল?

অমল কান্তি : সমাবেশে যোগ দিতে আসা অসংখ্য নেতাকর্মীকে ছত্রভঙ্গ করতে বিডিআর ও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। একসঙ্গে তিন থেকে চারটি বিডিআরের গাড়ি আসছে, চতুর্দিকে গ্যাস ছুড়ে দিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার আসছে। চারিদিকে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আসে। যে যার নিরপাদ অশ্রয়ে ছুটছে। এদিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে নেত্রীকে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে অনেক নেতাকর্মী জড়ো হতে থাকেন। কিন্তু কোর্ট বিল্ডিংয়ে জায়গা স্বল্পতার কারণে সেখানে বেশি লোকের ঠাঁই হচ্ছিল না। তাই সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীমসহ আমরা কিছু নেতাকর্মী কোর্ট বিল্ডিং থেকে নেমে পার্শ্ববর্তী দারুল ফজল মার্কেটের মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেই। 

ইটিভি অনলাইন : আপনি তো ওই দিনের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। বলতে গেলে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত এসেছেন। কীভাবে আপনি আহত হলেন? কী ঘটেছিল?

অমল কান্তি : কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ওখানে সম্ভবত বিডিআরের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীমসহ আমরা কিছু নেতাকর্মী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন সময় বিকেল পাঁচটা। ওই স্কুল দুটির দিক থেকে বিডিআর ও পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে শুরু করে। এ সময় রক্তপিপাসু সেই হায়েনাদের ছোবলের নির্মম শিকার হয় আমার পাশে থাকা মহিউদ্দিন শামীম। ঘাতকদের ছোড়া গুলি ভেদ করে শামীমের চোয়াল। এ সময় আমি আর শামীম একসঙ্গে ছিলাম। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হতে থাকে। কত যে রক্ত সেদিন মহিউদ্দিনের শরীর থেকে ঝরেছিল তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।

গুলির আঘাতে শামীম প্রথমে আমার গায়ের উপর এসে পড়ে। এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় যেন আমার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসছিল। শুধু মনে হচ্ছিল শামীমকে কীভাবে বাঁচাবো? কিন্তু বেশি ভাবার সুযোগ ছিল না। কারণ চতুর্দিকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তাতে অনুমান হচ্ছিল অন্য জায়গাতেও শামীমের মতো লাশ হতে হচ্ছে অনেককে। মনে হচ্ছিল ঘাতকদের গুলিতে পাখির মতো লাশ পড়ছে চতুর্দিকে। পরিবেশটা এমন ছিল যে, কে কার কান্না শুনবে? যে যার মতো জীবন বাঁচাই। দিগ্বিদিক সবাই ছুটাছুটি শুরু করে। পায়ের জুতা এমনকি পরনের পোশাক পর্যন্ত ফেলে রেখে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিল সবাই। তবে আমি এ সময় শামীমকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত শামীমকে মাটি থেকে টেনে তুলতে না তুলতেই আমার চোয়ালে গুলি লাগে। মুহূর্তেই যেন পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে আমার। মাথার ভিতর চক্কর দিয়ে ওঠে। চিৎকার করারও শক্তি হারিয়ে ফেলি। কিন্তু সে সময়ও আমার চেতনা ছিল। আমি বুঝতে পারি গুলির আঘাতে আমার চোয়াল ঘুরে গেছে। আসলে গুলির আঘাতটা লাগে মুখের বামপাশে। বামপাশে লাগলেও গুলির আঘাতের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, সেদিনের ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপনি দেখেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়! আমার মতো অনেকেই এমন ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

ইটিভি অনলাইন : গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আপনি কী করলেন?

অমল কান্তি : গুলিবিদ্ধ হলেও তখন আমার জ্ঞান ছিল। কয়েকজন আমাকে ধরাধরি করে দ্রুত রিয়াজ উদ্দিন বাজারের গলির ভিতরে নিয়ে যায়। শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। রক্তে আমার গায়ের শার্ট-প্যান্ট ভিজে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল। আমাকে  হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। এমন সময় আমার সারা শরীর রক্তাক্ত দেখে এক রিক্সাওয়ালা নিজে থেকেই ডেকে নেন। সেই রিক্সায় চড়ে চৈতন্যগলি, বিআরটিসি মার্কেট ও প্রবর্তকের মোড় হয়ে আমাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রবর্তকের মোড় পর্যন্তই আমার জ্ঞান ছিল। তারপর অচেতন হয়ে যাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পাই আমি চট্টগ্রামে মেডিকেলের ফ্লোরে পড়ে আছি। কোনো ডাক্তার আমার চিকিৎসা করছিলেন না। পরে আমি হাতের ইশারায় একটি কাগজ আর কলম দিতে বলি। কাগজে অমল কান্তি দাস, সীতাকুণ্ড কলেজ লিখে দেই। এরপর হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই আবার আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

ইটিভি অনলাইন : কতদিন পর আপনি জ্ঞান ফিরে পান?

অমল কান্তি : দ্বিতীয়বার অজ্ঞান হওয়ার চারদিন পর জ্ঞান ফিরে পাই। জ্ঞান ফিরে পেলেও আমার শারিরীক পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ক্ষতস্থানে ইনফেকশন শুরু হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমি তৎকালীন বিএমএর সেক্রেটারি ডা. সিরাজুল ইসলামের তত্তাবধানে ছিলাম। তিনি আমার বাবাকে ডেকে পরামর্শ দেন। বলেন, ‘যদি আপনার ছেলেকে বাঁচাতে চান তাহলে ঢাকায় নিয়ে যান।’ কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে রিলিজ দিতে চায়নি। তারা জানায়, আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিতে হলে আমার বাবাকে বন্ড সই দিতে হবে। পরে ঘটনার ৬ দিনের মধ্যে বাবা বন্ড সই দিয়ে আমার রিলিজের ব্যবস্থা করেন। স্বৈরাচারী সরকার আমাকে বিমানের টিকেট দেয়নি। পরে ‍তূর্ণা-নিশীথা ট্রেনে চড়ে আমি ঢাকায় আসি। ডা. সিরাজুল ইসলামের পরামর্শ মতে আমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পঙ্গু হাসপাতালে ডা. এ এফ এম রুহুল হকের (পরবর্তীতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী) তত্তাবধানে ভর্তি হই। এখানে আমার দীর্ঘ ৬ মাস চিকিৎসা চলে। এই হাসপাতালে ডাক্তার দুইবার অপারেশনের তারিখ ধার্য করেও স্বৈরাচারী সরকার অপারেশনের ডাক্তারকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়ার কারণে অপারেশন করা আর সম্ভব হয়নি। পঙ্গু হাসপাতালে অপারেশনের তারিখ দিয়েও ডাক্তার না থাকার অজুহাতে অপারেশন করা যায়নি। পরে রুহুল হক ছুটি নিয়ে লন্ডনে চলে যান। আমাকেও হাসপাতাল থেকে রিলিজ ‍দিয়ে দেওয়া হয়। পরে ডাক্তার রুহুল হক লন্ডন থেকে ফোন করে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনি দেশে ফিরে আগে আমার অপারেশন শেষ করে পরে তিনি হাসপাতালে যোগ দেন।

ইটিভি অনলাইন : আপনার জটিল অস্ত্রোপচার সম্পর্কে যদি একটু বলতেন-

অমল কান্তি : বাংলাদেশে অপারেশনের সময় আমার মুখে স্টিল বসানো হয়। কিন্তু তাতে মুখ নড়াচড়া করা সম্ভব হচ্ছিল না। মুখ যেহেতু শরীরের একটি মুভমেন্ট করা অংশ, তাই সেখানে নরম জাতীয় এবং মুভমেন্ট করতে পারে এমন কিছু বসানো জরুরি হয়ে পড়েছিল। এর জন্য আবার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের অস্ত্রোপচার তখন ছিল না। তখন নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। দেশে আমার যত চিকিৎসা হয় তার সমস্ত কাগজপত্র নেত্রী ঢাকায় ভারতের দূতাবাসে পাঠান এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।

তখন আমার এই অস্ত্রোপচারটি কলকাতার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর দ্য অর্থোপেডিক হ্যান্ডিক্রাফ্ট নামক একটি চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করা হয়। সেখানে প্রায় দেড় বছর আমার চিকিৎসা চলে। আর এর সবকিছুই নেত্রীর উদ্যোগে ও সাহায্যে সম্পন্ন হয়েছে। কলকাতায় চিকিৎসার সময় আমার বাম পায়ের ফিবুলা নিয়ে মুখের ডান চোয়ালের মাড়িতে প্রতিস্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আমি মুখ নাড়তে সক্ষম হই। তবে এখনও বাম মাড়ি দিয়েই আমাকে খেতে হয়। কারণ ডান মাড়িতে তো দাঁত নেই। খাদ্যদ্রব্য চিবানোর সুযোগ নেই।

ইটিভি অনলাইন : চিকিৎসার বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কেমন সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলেন?

অমল কান্তি : চট্টগ্রামে চিকিৎসার সময় নেত্রী আমাকে দেখতে হাপাতালে যান। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ও তিনি খোঁজ-খবর নিয়েছেন। পরবর্তীতে জানতে পেরেছি পঙ্গু হাসপাতালে কৌশলে আমার যে অপারেশন করা হয়েছিল তাও নেত্রী তদারকি করেছিলেন। নেত্রীই পরবর্তীতে আমার উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগ নেন। চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভারও তিনিই বহন করেন। নেত্রী ওই চিকিৎসার উদ্যোগ না নিলে বর্তমানে আমাকে যতটুকু ভালো অবস্থায় দেখছেন তা হয়তো দেখতে পারতেন না। আমার নিয়মিত দেখাশোনা করার জন্য নেত্রী কে এম হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গকে দায়িত্ব দেন। হেমায়েতউল্লাহ কলকায় প্রতিদিন একবার করে আমাকে দেখে যেতেন। তিনি আরেকজন লোক রেখে দিয়েছিলেন সেই লোক সকাল সন্ধ্যা আমার খোঁজ-খবর নিতেন।

ইটিভি অনলাইন : আপনার পরিবারও কী রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়েছিল?

কলকাতায় আমার চিকিৎসা চলার সময় আমার বাবাও আমার সঙ্গে ছিলেন। এ কারণে তাকে চাকরিতে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছিল কিছুদিন। সেই অজুহাতে আমার বাবাকে সাসপেন্ড করা হয়।

ইটিভি অনলাইন : এমন ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসায় অর্থের যোগানটা কোথা থেকে হয়েছিল?

অমল কান্তি : সে অনেক কথা। আমার বাবা ছিলেন একজন তহসিলদার। জায়গা-জমিও আমাদের অনেক ছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেলে যখন প্রথম ৬ দিন ছিলাম তখন আমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠছিল। আমার মুখে ইনফেকশনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। আমার বাবা তখন আমাকে বাঁচাতে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ডাক্তারসহ হাসপাতালের অন্যরা উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে কোথাও নিতে দিচ্ছিলেন না। তারা বলেছিলেন অন্য জায়গায় ব্যাপক খরচ হবে। আমার বাবা বলেছিলেন, আমার ছেলেকে দিব এক পাল্লায় আর টাকা দিব অন্য পাল্লায়। তবুও আমার ছেলেকে বাঁচাতে চাই। শেষমেষ বন্ড সই দেওয়ার মাধ্যমে আমার বাবার হাতে আমাকে তুলে দেন তারা। এরপর আনা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। যেখানে দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসা চলে আমার বাবার জমি বিক্রির টাকায়। প্রতিমাসে-ই এক বিঘা করে জমি বিক্রি করতে হয়েছে আমার বাবার। তবে ভারতে আমার যে উন্নত চিকিৎসা হয় তার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ইটিভি অনলাইন : ঘটনায় হতাহতদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

অমল কান্তি : সুস্থ হওয়ার পর আহত একজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছিল। এখন আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। দীর্ঘদিন চিকিৎসা ও ভারতে বসবাস করার কারণে যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঘটনার স্থানে স্থাপিত নাম ফলকে ওই ২৪ জনের-ই নাম আছে। তবে সরকারিভাবে ২৪ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ্য করা হলেও নিহতের সংখ্যা শতাধিক হবে। কারণ লালদিঘির ওই দিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ অনেককে ট্রাকে করে বল্লার দিঘিরপাড় শ্মশান ঘাটে নিয়ে জীবিত অবস্থায়ই আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন আরও ৫ শতাধিক। যাদের অধিকাংশই আমার পরিচিতজন।

ইটিভি অনলাইন : ঘটনার ২৯ বছর পর সেই ক্ষত কতটুকু সেরে উঠেছে?

অমল কান্তি : গুলি লাগায় শরীরে যে ক্ষত সেটি আজও আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ক্ষত কাটিয়ে ওঠার নয়। গুলির আঘাতে আমার মুখের চেহারার যে বিকৃতি হয়েছে তা প্রতিক্ষণে আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। দেখতেই পাচ্ছেন-আমার মুখের ডান দিকটা কিছু অংশ মাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে। কিছু অংশ বেঁকে গেছে। মানুষ প্রথম দেখাতেই এর কারণ জানতে চায়। এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমার মনের ক্ষতটা আরও বেড়ে যায়। যা সবসময়-ই আমাকে কষ্ট দেয়। আমি ভাবতেও পারি না যে আমার শরীরের অন্য অঙ্গ থেকে হাড় নিয়ে মুখে লাগানো হয়। আমার চিকিৎসায় ২৪ ব্যাগ রক্ত লাগে। রক্ত দেওয়া সেসব ব্যক্তিদের আমি চিনি না।

ইটিভি অনলাইন : বর্তমানে আপনি কী করছেন?

অমল কান্তি : আমি ভারতে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। যার নাম সেলফ এমপ্লয়ি বিজনেস। আমার এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে ও-লেভেলে আর মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। স্ত্রী-সন্তান আর ব্যবসার মধ্য দিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে।

ইটিভি অনলাইন : জীবনের এ পর্যায়ে আপনার প্রাপ্তি কতটুকু?

অমল কান্তি : জীবনের এ পর্যায়ে প্রকৃত অর্থে প্রাপ্তির খাতাটা এখনও শূন্যই রয়ে গেছে। আমাদের ত্যাগের বিনিময়েও দলের ভেতরে নেতাকর্মীদের মধ্যে সহমর্মিতাবোধ জেগে ওঠেনি। দলের ভেতরে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগাতে পারলেই আমার প্রাপ্তিটা এসেছে বলে মনে করব।

ইটিভি অনলাইন : আপনার জীবনের শেষ চাওয়া কী?

অমল কান্তি : আমার জীবনে শেষ চাওয়া চট্টগ্রামের মাটিতেই যেন আমার মৃত্যু হয়। আমি যেন বাংলার আকাশ-বাতাস ও মাটির স্বাদ নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।

ইটিভি অনলাইন :আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও আপনার জীবনের সামগ্রিক মঙ্গল কামনা করছি।

অমল কান্তি : ধন্যবাদ আপনাদেরকেও।

ডব্লিউএন