ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সিএনএনের বিশেষ প্রতিবেদন

এশিয়ার ‘ম্যান্ডেলা’র পতন

প্রকাশিত : ০১:০৭ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:০৫ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের পক্ষে যখন সারাবিশ্ব প্রতিবাদমুখর, তখন নির্বিকার `এশিয়ার ম্যান্ডেলা` খ্যাত অং সান সু চি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকারকারী জান্তার সঙ্গে সু চির অন্যান্য ব্যাপারে নানা মতানৈক্য থাকলেও এ ব্যাপারে দারুণ মিল দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নীপিড়নের খবরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেলেও, সব খবর অস্বীকার করে সু চি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রাখাইনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করছে সেনাবাহিনী। কাউকে উচ্ছেদ, হত্যা বা নির্যাতন করা হচ্ছে না। মুসলিমবিদ্বেষী কট্টর বৌদ্ধ আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের `বাঙালি` হিসেবে অভিহিত করতেও ছাড়ছেন না তিনি। সু চির এমন নির্বিকার অবস্থানে গণমাধ্যমগুলো বলছে এশিয়ার ম্যান্ডেলার পতন হয়েছে। সিএনএন ও বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন মোহাম্মদ আতাউর রহমান

বুধবার এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএন। এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নিধনে সু চির নীরবতা ও ক্ষেত্রে বিশেষে মৌন সমর্থন দেখে মনে হচ্ছে এশিয়ার ম্যান্ডেলার পতন হয়েছে। তবে সেনা আধিপত্যের দেশ মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসা সু চির ক্ষমতা আসলেই কতটুকু, আর কী বা করার আছে তার সে প্রশ্নও উঠেছে বিবিসির মতো বেশ কিছু প্রভাবশালী গণমাধ্যমে। তার দেশের ভেতরে দুর্বলতার কারণে সু চির কাছে সংকট সমাধানের আশা করা অনুচিত বলেও মন্তব্য করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

প্রসঙ্গত মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক অং সানের মেয়ে অং সান সু চির উত্থান মূলত নব্বইয়ের দশকে। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী আন্দোলনে তার দৃঢ়তা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও শান্তিপ্রিয়তার কারণে সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল তার প্রতি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাকে অভিহিত করা হয় এশিয়ার ম্যান্ডেলা হিসেবে। ম্যান্ডেলা যেমন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন, তেমনি সু চিকেও দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকতে হয়। এভাবে একজন নারী, সু চি বিশ্বের মহান নেতাদের আসনে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার অমানবিক চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এশিয়ার ম্যান্ডেলাখ্যাত এই নেত্রীর ভাবমূর্তির এখন পতন ঘটতে শুরু করেছে।


এশিয়ার ম্যান্ডেলাখ্যাত সু চি`র ইমেজ আসলে নির্বাচনের আগে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপোষ করার সময় থেকেই ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে। আর এখন মনে করা হচ্ছে, তিনি আসলে শান্তির নেত্রী নন; সাধারণ একজন রাজনীতিবিদ মাত্র। অবশ্য চলতি বছরের শুরুতে সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সু চি নিজেও তার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন একজন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবেই। তিনি বলেছিলেন, `দেখুন, আমি মাদার তেরেসা কিংবা মহাত্মা গান্ধী নই। আমি একজন রাজনীতিবিদ।`

এদিকে বিবিসির সাংবাদিক জনাথন হিড জানিয়েছেন, দেশটির ভেতরে সু চির হাতে কতটা ক্ষমতা, তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। তিনি রাষ্ট্রীয় পরামর্শক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও দেশটির স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এর অর্থ দেশটির পুলিশ বাহিনীও সেনা-হুকুমের দাস।


জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের জন্য নির্ধারিত ১১টি আসনের ছয়টিই সেনাবাহিনীর পছন্দের লোকদের হাতে। এ কমিটির হাতেই রয়েছে দেশটির গণতান্ত্রিক সরকারকে `বাতিল` করার ক্ষমতা। তা ছাড়া পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসনও সংবিধানবলে সেনা-দখলে। তো সু চির সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে রোহিঙ্গা সংকটে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তা সন্দেহের ঊর্ধে নয়। তবে আন্তর্জাতিক মহল চায়, এই মানবিক বিপর্যয়ে নৈতিক কারণেই সু চি সরব হবেন ও সংকট সমাধানে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন।


কিন্তু বাস্তবতা হলো, সু চি নীরবতা ভাংতেই পারছেন না। কখনও যদি বা সরব হচ্ছেন, রোহিঙ্গাদের দূরে ঠেলে সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পক্ষেই সাফাই গাইছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এখন সু চির ভূমিকা আশা করা বাতুলতা মাত্র।

প্রাণের ভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। অনেকে নৌকাডুবে মারা যাচ্ছে। তাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের কাহিনী শোনাচ্ছে সাংবাদিকদের। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। জাতিসংঘ এটাকে গণহত্যার আদর্শ উদাহরণ বলছে। বাংলাদেশে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে কাজ করছেন ম্যাথিও স্মিথ। মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটসের এই প্রতিষ্ঠাতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, `নির্বিচার হত্যা চলছে। এখনও তা চলছে। সু চির কার্যালয় কিছুই করছে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা এই আগুনে ঘি ঢালছে।`

অবশ্য সু চি যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনই চুপ করে আছেন, তা নয়। আগেও সেনা সহিংসতার ঘটনায় মুখ এঁটে ছিলেন। ২০১৩ সালে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের তখনও সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজ দেশে পরবাসী জীবন কাটাতে হচ্ছিল। এমনকি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশের ভেতরে সরকারের অঘোষিত বন্দিশিবিরেই দিন কাটাতে হচ্ছিল। সে সময়েও সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের সহিংসতায় প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। বিবিসির সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে সংবাদিক মিশাল হোসেইনের এক প্রশ্নের জবাবে সু চি রোহিঙ্গাদের নাম নিতেও রাজি হননি। তিনি তখনও সহিংস বৌদ্ধদের পক্ষেই পরোক্ষে কথা বলেছিলেন। সু চি বলেছিলেন, `বিশ্বকে বুঝতে হবে আতঙ্কে কেবল মুসলিমরাই নয়, বৌদ্ধরাও।` এমন মন্তব্য সে সময়েও বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।



//এআর