ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ঢিবি আর খানাখন্দে ভরা যশোরের রাস্তাঘাটে চরম দুর্ভোগ

যশোর থেকে ফিরে, রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৯:০৬ পিএম, ৬ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:১৩ পিএম, ৬ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার

ঢিবি আর খানাখন্দে বেহাল দশা দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের চারটি মহাসড়কের। এছাড়া দুটি আঞ্চলিক সড়কসহ পৌরসভার ৭২টি সড়কের অবস্থাও নাজুক। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এসব সড়কে বিটুমিন ও কার্পেটিং উঠে গিয়ে বড় বড় খানাখন্দ আর ঢিবির সৃষ্টি হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই গর্তগুলোতে জমছে পানি। এ কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। মারাত্মক দূর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। এ অবস্থায় সড়কের কিছু কিছু অংশে আস্ত ইট দিয়ে জোড়াতালির মাধ্যমে সাময়িক যাতায়াতের ব্যবস্থা করছে যশোরের সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলার উপর দিয়ে যাওয়া ৪টি জাতীয় ও দুটি আঞ্চলিক মহাসড়কের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ৪টি জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে ঢাকা-খুলনা সড়কের যশোর শহরের পালবাড়ি-চাঁচড়া-মুড়লির ৬ কিলোমিটার, পালবাড়ি-দড়াটানা-মনিহার-মুড়লির সাড়ে ৬ কিলোমিটার, যশোর-বেনাপোলের নাভারণ মোড় পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার ও যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের পালবাড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ৮ কিলোমিটারের অবস্থা বেশি খারাপ। সংস্কারের অভাবে এসব সড়কের ইট-বালি ও খোয়া উঠে বড় বড় খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বেনাপোল সড়ক অনেকটা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। প্রায়-ই ঘটছে দুর্ঘটনা। দিনে দিনে এ দুর্গতি আরও বাড়ছে।

সড়কের এ দূরবস্থার মধ্যে যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকায় সড়কের অর্ধেক অংশ কালভার্ট নির্মাণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কের একপাশ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণে যান চলাচল করছে। আর ওই কালভার্টের দুই পাশে অন্তত আধা কিলোমিটার করে সড়ক ভাঙাচোরা। ফলে ভাঙা অংশের দুই পাশে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। তাছাড়া এখান থেকে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী পর্যন্ত অন্তত ২০ কিলোমিটার সড়কে বিটুমিনের আস্তরণ উঠে বেহাল হয়ে পড়েছে।

এ পরিস্থিতে সম্প্রতি যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পুলেরহাট এলাকার ভাঙা অংশে বিটুমিনের উপর ইট বিছিয়ে (সলিং) যোগাযোগ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই সলিংয়ের দুপাশে অন্তত ২০০ মিটার অংশে বড় বড় গর্ত হয়েছে। পণ্যবাহী যান ও যাত্রীবাহী বাস ওই অংশ পার হচ্ছে হেলেদুলে। পুলেরহাট এলাকায় ব্যাপক যানজট হচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরের একমাত্র সড়ক এটি। বলতে গেলে যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়কই চলাচলের প্রায় অনুপযোগী।

যশোর-বেনাপোলের মতো যশোর-খুলনার সড়কটিরও একই দূরবস্থা। যদিও বছরখানেক আগে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর-খুলনা সড়ক পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। কিন্তু ওই সড়কের মনিহার থেকে বকচর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার অংশে সড়কের মাঝখানে ফুলে-ফেঁপে বড় ঢিবি, খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। ঢিবিতে যানবাহনের নিচের অংশ আটকে যাচ্ছে। ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। অথচ এ রাস্তা দিয়েই খুলনা, ঢাকা, কুষ্টিয়াসহ আঞ্চলিকপথের দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলাচল করে।

যশোর খুলনা রোডের দূরবস্থার বর্ণনা দিয়ে জেলার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শারমিন বিনতে জামান বলেন, আমার বাড়ি বসুন্দিয়া। ক্লাস থাকার কারণে সপ্তাহে প্রায় ৪ থেকে ৫ দিন আমাকে যশোর আসতে হয়। কিন্তু যশোর-খুলনা রোডের যে অবস্থা, তা আমার সত্যিই ভয়ে ফেলে দিয়েছে। দূর্ঘটনার ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসতে মন চায় না। কিন্তু লেখাপড়ার কথা ভেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আসতে হচ্ছে। গত দুই দিন আগেও এ রোডে একটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। সড়কের পানি জমে থাকা গর্তে হঠাৎ বাস আটকে গেছিল। আর তাতে বাসের ভিতর ১০ থেকে ১২ জন আহত হয়েছিল। যশোরে বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনোলজি পার্কসহ অনেক কিছুর উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু সড়কের এ দূরাবস্থা সব অর্জন যেন বিলিন করে দিচ্ছে।

সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যশোরের সড়কগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে এ কথা স্বীকার করি। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে সড়কগুলোর এ পরিমান ক্ষতি হয়েছে। সড়কগুলো পুননির্মাণ ও সংস্কার করতে কিছু সময় লাগবে। তাই আমরা সাময়িকভাবে ইট দিয়ে রাস্তাগুলো চলাচলের উপযোগী করতে চেষ্টা করছি। তবে আশার কথা হলো যশোরের উপর দিয়ে চলে যাওয়া চারটি মহাসড়কের সংস্কারের ব্যাপারে গত জুনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অর্থ চেয়ে কর্মসূচি পাঠানো হয়েছিল। সড়কগুলোর মধ্যে যশোর-খুলনা ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক পুনর্নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে ৬৪২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পাওয়া গেছে। গত ১৭ আগস্ট এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে প্রকল্প দুটির কাজ শুরু হতে পারে।

যশোর সড়কের এ করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে স্থানীয়রা বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষ যশোরের এই চারটি মহাসড়ক দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে থাকেন। বিশেষ করে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলকে ঘিরে মূলত এসব মহাসড়ক কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার মালামাল আমদানি-রফতানি হয় বেনাপোল বন্দর থেকে। এসব মালামাল আনা নেয়ার জন্য এ সড়কগুলোই হচ্ছে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। অথচ বেনাপোল মহাসড়কসহ চারটি সড়কের বর্তমান করুণ অবস্থা। স্থানীয়দের অভিযোগ মাঝে মধ্যে এসব সড়কের কিছু অংশ তড়িঘড়ি করে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করা হলেও ৬ মাস যেতে না যেতে কার্পেটিং উঠে আবার বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। ফলে ভোগান্তির শেষ হয়না।

মহাসড়কগুলোর মতো যশোর পৌর শহরের ৭২টি সড়কের অধিকাংশই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পৌর নাগরিকদের অভিযোগ প্রতিবছর তারা পৌরসভাকে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব দিলেও নাগরিক উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়না। তার বড় প্রমাণ হচ্ছে পৌর এলাকার রাস্তাসমূহের বেহাল দশা।

যশোর বারান্দি পাড়ার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ জানান, পৌরসভার অধিকাংশ সড়কের বর্তমান অবস্থা নাজুক। বৃষ্টি হলে শহরের ৬০ শতাংশ রাস্তায় পানি উঠে যায়। রাস্তার উপর বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের চলাচলে কষ্টের শেষ থাকে না। তিনি দ্রুত এসব সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানান।

সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, পোরসভার ৭২টি সড়কেই সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। গর্তগুলোতে জমে থাকা পানি পথচারীদের জীবনকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। গর্তের মধ্যে অনেক গাড়ি আটকে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়কে ঘটছে দূর্ঘটনা। খোদ পৌর ভবনের সামনের সড়কজুড়ে বড় বড় গর্ত। বর্তমান ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচলতো দূরের কথা, মানুষের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। পৌর ভবনের উল্টো দিকে যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে নাকাল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। শহরের এম এম আলী রোডের পোস্ট অফিস, সমবায় ব্যাংক মার্কেট মোড় হয়ে চিত্রামোড় পর্যন্ত, মাইকপট্টি সড়কের বেশিরভাগ স্থান খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা শহরের গুরুদাস বাবু লেন ও কেশবলাল সড়কে। রেলরোডের অবস্থাও নাজুক। এছাড়া পশ্চিম বারান্দীপাড়া প্রধান সড়ক, যশোর-ঢাকা রোড, বারান্দীপাড়া লিচুতলা, পূর্ব বারান্দীপাড়া কবরস্থান, পশ্চিম বারান্দীপাড়া খালধার, নিউ রামকৃষ্ণ মিশন, পিটিআই, নীলরতন ধর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সার্কিট হাউসপাড়া, ঘোপ সেন্ট্রাল, পালবাড়ি, খড়কির হজরত বোরহান শাহ সড়ক, যশোর-নড়াইল রোডের তাঁতিপাড়া, চাঁচড়ার রাজা বরদাকান্ত, চাঁচড়া ডালমিল, ঘোপ পিলু খান, জেলখানা, পালবাড়ি ঘোষপাড়া, কাঁঠালতলা, মুক্তিযোদ্ধা মোড়, পূর্ব বারান্দীপাড়া সাহাপাড়া, টিবি কিনিক, বেজপাড়া পিয়ারি মোহন, সিভিল কোর্ট মোড় বাঁশপট্টি, কারবালা ওয়াপদা গ্যারেজ, স্টেডিয়ামপাড়া রোড, খড়কি কবরস্থান, কারবালা বামনপাড়া, কারবালা খ্রিস্টানপাড়া মোড়, খড়কি মাওলানা আবদুল করিম রোড, এম এম কলেজ-ধোপাপাড়া, শহীদ মসিউর রহমান ও তালতলা সড়ক খানাখন্দে ভরা। সামান্য বৃষ্টিতে এসব সড়ক দিয়ে মানুষের চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া সড়কের অন্তত এক কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। এই সড়কে যশোর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালসহ অন্তত ২০টি বেসরকারি হাসপাতাল-কিনিক ও বিদ্যালয় রয়েছে। অথচ সড়কটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

সড়কগুলোর এ দূরবস্থা আগামীতে থাকবে না জানিয়ে যশোর পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু বলেন, আগামী বর্ষা মৌসুমে আর যশোর পৌরসভার অভ্যন্তরে কোনো রাস্তার অবস্থা এমন থাকবে না। ২০১৮ সালের মধ্যে পৌরসভার শতভাগ সড়ক চলাচলের উপযোগী করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পৌরসভার নাগরিকদের সুবিধায় পর্যায়ক্রমে সব ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

আরকে/ডব্লিউএন