ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট : অপার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

প্রকাশিত : ০৬:৩৮ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৫৯ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার

দেশে বিপুল কর্মক্ষম তরুণ কাঙিক্ষত চাকরি পাচ্ছে না, তাদের কাজেও লাগানো যাচ্ছে না।

দেশে বিপুল কর্মক্ষম তরুণ কাঙিক্ষত চাকরি পাচ্ছে না, তাদের কাজেও লাগানো যাচ্ছে না।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার অভাবে ভুগছে, তখন বাংলাদেশের জন্য সুযোগের দরজা খুলে গেছে। ২০১৬ সালে বিশ্বে কর্মক্ষম জনসংখ্যা কর্মে অক্ষম জনসংখ্যার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ কর্মক্ষম জনসংখ্যায় এগিয়ে আছে।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এক প্রতিবেদনে (২৬ এপ্রিল ২০১৬) বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তরুণ জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র। এ অঞ্চলের ৪৫টি দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির নিযুত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের সুবিধা ভোগ করছে। ইউএনডিপির মতে, এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যার আধিক্য। যখন এই কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি থাকে, তখন ওই দেশ ডেমোগ্রাফিক বোনাসকালে অবস্থান করছে বলে ধরা হয়। মনে করা হয়, এ জনসংখ্যা কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে, যা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে এ দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৩ কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিগণিত হবে। তবে ২০০৭ সালে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে প্রবেশ করলেও বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। কেন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাচ্ছে না এবং কিভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে- এসব বিষয়ে কথা হয় অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদের সঙ্গে। নিয়াজ আহমেদ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক মোহাম্মদ জুয়েল

ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশ কখন থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালে প্রবেশ করেছে? কতোদিন এ সুযোগটি পাবে?  


নিয়াজ আহমেদ : স্বাধীনতা পরবর্তী বছরে দেশে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ছিল ৪৩ মিলিয়ন। বিপরীতে কর্মক্ষম জনশক্তি ছিল ৪৩ মিলিয়ন । গত কয়েক বছরে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়ায় বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে প্রবেশ করে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট হলো একটি দেশের ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়স্ক কর্মক্ষম জনশক্তি যখন কর্মে অক্ষম জনশক্তির চেয়ে বেশি থাকে। মূলত ২০০৭ সালে আমরা ডেমোগ্রাফিতে প্রবেশ করি। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, ২০৪২ সালের দিকে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ হারাব। তবে আমার নিজস্ব গবেষণা হচ্ছে, ২০৩৫ সালেই ডেমোগ্রাফির চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা চলে যাব। এরপর থেকে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমতে থাকবে।

ইটিভি অনলাইন : বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো কিভাবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে?

নিয়াজ আহমেদ : জাপান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির উপর জোর দেয়। তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যয় করে । শুধু তাই নয়, বরাদ্দের শতভাগ কিভাবে যথাযথভাবে ব্যয় করা যায়, সেটির উপর নজর দেয়। শুধু তাই নয়; তারা ৭০-এর দশকে লেভার ইনসেন্টিভ মার্কেট (শ্রম বাজার) থেকে ক্যাপিটাল ইনসেন্টিভ মার্কেটের (পুঁজিপ্রবণ বাজারের) দিকে যায়। পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ণের দিকে যায় দেশগুলো। একইসঙ্গে দক্ষ জনশক্তিও তারা তৈরি করতে থাকে। শুধু তাই নয়, দেশগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পাঠায় তারা।

ইটিভি অনলাইন : আমাদের দেশে জনমিতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

নিয়াজ আহমেদ : বাংলাদেশ সরকার ব্যপকমাত্রায় কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সরকার ৪০ লাখের মতো কর্মসংস্থান তৈরি করেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে সামনে রেখে। তবে দেশের বাইরে জনশক্তি আগের চেয়ে কম রফতানি হচ্ছে। দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে । কিন্তু বিপরীতে বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যাও। এছাড়া দেশ থেকে যারা বিদেশে যাচ্ছে, তারাও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারছেন না। এসব কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছি না। 

ইটিভি অনলাইন : দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রধান অন্তরায় কী? সরকার কিভাবে দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে পারে?

নিয়াজ আহমেদ : শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের মাত্র ২০-২২ শতাংশের মতো বরাদ্ধ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বাজেটের শতকরা ১৬ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। তাও বরাদ্দকৃত টাকার পুরোটা কার্যকর ব্যবহার হয় না । অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিলেও, অনেক টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। এর কারণ, সরকার বাজেট দিচ্ছে, অথচ মন্ত্রণালয় তা খরচ করতে পারছে না। মন্ত্রণালয় বাজেটের সব টাকা ব্যয় করতে না পারলে, সরকার বাজেট দিবে কেন? তাই সরকারের দেওয়া টাকাগুলো অবশ্যই যথাযথভাবে ব্যয় করতে হবে।

মূলত কর্মক্ষম জনশক্তির প্রধান অন্ত:রায় পুষ্টিহীনতা, স্থুলতাসহ আরও কিছু দৈহিক সমস্যা। জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে, প্রথমেই নজর দিতে হবে তাদের স্বাস্থ্য-উন্নয়নের দিকে। আর এর জন্য সরকারের উচিত আরও বেশি কমিউনিটি সেবা চালু করা ।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের চিকিৎসকরা একজন রোগী দেখতে মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে থাকে, বিপরীতে সুইডেনে একজন ডাক্তার ২২ মিনিটেরও বেশি সময় দিয়ে থাকে একজন রোগীর পেছনে। এতে চিকিৎসকরা মানুষিক চাপে ভোগেন, যা দেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যপক প্রভাব ফেলছে ।

ইটিভি অনলাইন : জনসংখ্যাকে জনসম্পদ করতে হলে তো যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করাটা জরুরি? আমরা কতটুকু সেটি নিশ্চিত করতে পারছি?

নিয়াজ আহমেদ : শিক্ষাখাতে কেবল বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, কর্মমূখী শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘জব মার্কেট অরিয়েন্টেড’ শিক্ষার উপর জোর দেন। এমনকি বর্তমান উদীয়মাণ শক্তি ভারতও এখন কারিগরি শিক্ষার দিকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারকে পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। কেবল শিক্ষার হার বাড়ালেই উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণ হবে না।

ইটিভি অনলাইন : বেকারত্ব দূর করার জন্য সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে?

নিয়াজ আহমেদ : সরকার যুব সমাজের অনেককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে । তাদের অনেকেই দক্ষতা অর্জন করে দেশে ও বিদেশে চাকরি করছে। তবে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েও বেকার থেকে যাচ্ছে। জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের জন্য সরকারকে আরও বেশি প্রশিক্ষণশালা নির্মাণ করতে হবে। পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্টও সরবরাহ করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : বিদেশে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার, কর্মক্ষম জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সেটি কতটা কাজে দিচ্ছে?

নিয়াজ আহমেদ : এখন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের খাত প্রবাসীদের আয়। দেশের বাইরে প্রায় এক কোটির মতো প্রবাসী আছে। সম্প্রতি দেখা গেছে তাদের আয় ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিপরীতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মাত্র ১ কোটি ৩০ লাখের মতো জনগোষ্ঠী পাঠিয়ে ৬৮ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। একমাত্র অদক্ষতার কারণেই আমরা তাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সরকার উদ্যোগ নিয়ে এদেরকে দক্ষ করতে পারলে আমাদের প্রবাসী আয় আরও তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বিদেশের শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদাও বাড়বে।

ইটিভি অনলাইন : আপনাকে ধন্যবাদ।

নিয়াজ আহমেদ :  ইটিভিকেও ধন্যবাদ । ইটিভি অনলাইনের প্রতি শুভ কামনা রইল। 

//ডিডি// এআর