ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

পর্ব-১

নেশায় বুঁদ তারুণ্য

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৫:৪৬ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:৫২ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২০ বুধবার

প্রতিকী ছবি

প্রতিকী ছবি

সর্বনাশা মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে তারুণ্য। হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সোনালী দিনগুলো। ঢাকার বিভিন্ন অলিতে গলিতে দেখা যায় মরণ নেশা মাদকে ডুবে আছে অসংখ্য তরুণ-তরুণী। এদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী। তারা তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে নিজেদের জীবনকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও মাদকের এমন মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে শেষ করে দিচ্ছে নিজেদের শিক্ষাজীবন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হতাশা থেকেই মাদকে আসক্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমানে  বেকারত্বের কারণে যুব সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশা বিরাজ করছে। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়া, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও সুশিক্ষার অভাব, যত্রযত্র মাদকের সহজলভ্যতা ও প্রযুক্তির প্রভাবেও মাদকের দিকে ঝুকছে তরুণরা। 

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাবি ও বুয়েট ক্যাম্পাসের আশপাশেই ছড়িয়ে আছে বিশাল মাদকচক্র। ঢাকা মেডিকেল গেট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল এলাকার ফুটপাত, ফার্মগেট এলাকার ফুটওভার ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা, গাউসুল আজম মার্কেট, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকা, নিউমার্কেটের ১নং গেট ও তার আশপাশের এলাকা, শহীদ মিনারের পেছন দিকসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি স্থানে সন্ধ্যার পর থেকে স্বল্প মূল্যে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই বিক্রি হয় বিভিন্ন নেশাদ্রব্য। এর খরিদ্দারদের বেশির ভাগই হচ্ছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা তরুণ।    

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখে অনেকে ভাবে এখানে শুধু পড়ালেখাই হয়। এর ভেতরে যে আরো কত কিছু আছে সেটা কয়জনে জানে। এখানকার অসংখ্য ছেলেমেয়ে মাদকে আসক্ত। এখানে যে বিশাল অন্ধকার জগত রয়েছে সেটা কেউ জানে না।

গত ৬ জুলাই রাত ১১টার দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে মাদকসেবনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীসহ ২৬ জনকে পুলিশ আটক করে। সন্ধ্যার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আটকৃতরা সেখানে প্রবেশ করে মাদকসেবন করছিলেন।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ক্যাম্পাসের ভেতরে মাদক সেবনের কোনো সুযোগ নেই। এখানে রাতে পুলিশ নিয়মিত টহল দেয়। এরপরও ক্যাম্পাসে মাদকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে- এমন কাউকে পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।    

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায়, অনেকে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করছে। কেউ ইনজেকশন নিচ্ছে, কেউ গাঁজা বানাচ্ছে, কেউ পলিথিনের মধ্যে আঠা দিয়ে ফুঁকাচ্ছে। সিগারেট থেকে তামাক ফেলে দিয়ে সিগারেটের মধ্যে ঢুকানো হয়, গাঁজাপাতা, নাম দেয়া হয় স্টিক। ২০ থেকে ২৫ টাকা করে বিক্রি করে প্রতিটি স্টিক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার কারওয়ান বাজারের বড় মাপের তামাক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা গাঁজাপাতা সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করেন। এছাড়া দেশের বাহির থেকেও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আসে। সেগুলো ঢাকার বিভিন্ন স্পট থেকে তারা সংগ্রহ করেন।  

কারওয়ান বাজার এলাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদকসেবি বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে নেশায় আসক্ত হই। কয়েকবার ছাড়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। এখন নেশা না করে থাকতে পারি না। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদক বিক্রেতা জানান, প্রতি রাতে তার কাছে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী মাদক কিনতে আসে। তবে ছাত্রদের সঙ্গে একটা সমস্যা হয়, তারা ঠিকমত টাকা দিতে চায় না। বরং কখনও কখনও উল্টো তাদেরকে চাঁদা দিতে হয়। আর ছাত্রদের অনেকে কেবল নিয়মিত সেবনই করে না, নিয়ন্ত্রণ করেন বড় বড় মাদকচক্র। সহজলভ্য হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হেঁটে, বাইকে ও প্রাইভেটকারে চড়ে এখান থেকে মাদক কিনে নিয়ে যায় অনেক মাদকসেবী।

এটি ঢাকার কয়েকটি এলাকার চিত্র। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশেই এ ধরনের চিত্র রয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে মাদক। এই মাদকের নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে তারুণ্য। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ। সারা দেশের মাদকের সার্বিকচিত্র তুলে ধরলে আগ্রাসনের যে ভয়াবহতা প্রকাশ পাবে, তা যে কোনো মানুষকেই উদ্বিগ্ন করে তুলবে। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা জড়িয়ে পড়ছে এই মরণ নেশায়। বর্ডার দিয়ে অবাদে প্রবেশ করছে মাদক। নারীরাও এখন হয়ে উঠছে এর অন্যতম খরিদ্দার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এখন আসক্ত এই মরণ নেশায়। 

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৭৩ শতাংশ নানা কারণে মানসিক সমস্যায় জর্জরিত। নিজেদের ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে ৮৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অনিশ্চয়তায় ভোগেন। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ৩ বছর পর্যন্ত চাকরি পায় না ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিয়েও হতাশ ৯৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন হতাশার চিত্র তাদেরকে মাদকাসক্তে আসক্তির অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলত হতাশা থেকেই মাদকে আসক্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমানে  বেকারত্বের কারণে যুব সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশা বিরাজ করছে। এছাড়া পারিবারিক সুসর্ম্পকের অভাবের কারণে সন্তানরা তাদের সমস্যার কথা পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও সুশিক্ষার অভাবেও মাদকের দিকে আসক্ত হচ্ছে তরুণরা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়া রহমান মাদক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন কারণে নেশায় আসক্ত হচ্ছে। যেমন- নগরায়নের ফলে এর একটা প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব পরিস্থিতির পট-পরিবর্তনের কারণেও এর প্রভাব পড়ছে। টেকনোলজি, ইন্টারনেটের সহজ ব্যবহার, হঠাৎ হাতে টাকা-পয়সা চলে আসা, পারিবারিক এনগেজমেন্ট কমে যাওয়া বা রিলেশন আলগা হয়ে যাওয়া, মাদকের সহজলভ্যতা ও ফ্রাস্টেশনসহ নানা কারণে যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করা। সমাজিক কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত থাকা। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলা। এছাড়া অনেকগুলো সেচ্ছাসেবি এনজিও আছে, তারা এটা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের প্রশাসনকেও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলেই মাদকের হাত থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।  

এসি/ডিডি