ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘প্রতিবন্ধী-উপজাতি ছাড়া সব কোটা তুলে দিতে হবে’

প্রকাশিত : ০৬:০৬ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:২৯ পিএম, ১৩ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার

সৈয়দ আবুল মকসুদ

সৈয়দ আবুল মকসুদ

‘শারীরিক প্রতিবন্ধী ও দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে দেওয়া উচিত। কোটা পদ্ধতির কারণে তৈরি হচ্ছে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদি গোষ্ঠী। ফলে অনেক শিক্ষিত যুবক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার জাতাকলে পিষ্ট হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না। কোটা পদ্ধতি বহাল থাকলে দেশের মঙ্গল তো দূরের কথা জাতি সম্পূর্ণ মেধাহীন হয়ে পড়বে।’ এমনটাই মনে করেন সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। সম্প্রতি একুশে টিভিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকার তিনি এসব কথা করেন। সাক্ষাতকার নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-

তার কথায় উঠে এসেছে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কার, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময় চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সমালোচনা এবং এ থেকে বেরিয়ে আসার দিশাও খুঁজে পাওয়া যাবে তার সাক্ষাৎকারে। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ মনে করেন, এখন পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের যে দাবি উঠেছে সেটি হতে হবে শিক্ষাবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে, আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে নয়। শিক্ষাকে নিরেট সেবায় পরিণত করতে হলে সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটির সুপারিশের আলোকে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটার সংস্কারে ভূক্তভোগীরা দাবি জানিয়ে আসছেন, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন ?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও দেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাড়া কোনো কোটা রাখা উচিত নয়। তাদের (প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী) কোটার মধ্যে রাখলেও এক শতাংশের বেশি রাখা উচিত হবে না। এর মাধ্যমে এক শ্রেণীর লোকজন সুবিধা ভোগ করে আসছে। এর ফলে দেশের সঠিক মেধাবীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না। দেশের সার্বিক উন্নয়ন মেধাবীদের সঠিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

একুশে টিভি অনলাইন : বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষাটা পাচ্ছে কি না?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু বছর ধরে কিছু নতুন পদ্ধতি যোগ হয়েছে। এসব পদ্ধতি যখন চালু হয় তখন অনেকেই সমলোচনা শুরু করেন। সেসময় আমি বলছিলাম, প্রশ্নপত্র যদি ফাঁস নাও হয় তবুও এই শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হতে তেমন সহায়ক হবে না। কিন্তু সরকার আমাদের কথা তখন আমলে নেয়নি।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই দুর্বল। এর সাথে আরও যুক্ত হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে অতি অল্প ব্যতিক্রম বাদে সমগ্র জাতি মেধাহীন হয়ে পড়বে। জাতি মেধাহীন হলে প্রসাশনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। দেশ শাসনের জন্য ভালো ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোক তৈরি হবে না। বুদ্ধিজীবী সংকটে পড়বে জাতি।

বর্তমানে যে সৃজনশীল পদ্ধতি রয়েছে। এটি পরিবর্তন না হলে সরকার যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

একুশে টিভি অনলাইন: শিক্ষা ব্যবস্থায় কি কি পরিবর্তন নানা দরকার বলে আপনি মনে করছেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: শিক্ষা ব্যবস্থা একই রকম অনন্তকাল থেকে না। ৩০০ বছর আগে একটা শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। সেটাও তো পরিবর্তন হয়েছে। উপনিবেশ আমল যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সেটির মান নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। সে সময় অনেক বিজ্ঞানী বের হয়েছেন। তবে যুগের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন হবে এটেই স্বাভাবিক। যখন যেভাবে যুগ চলবে সেভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। এর দায়িত্ব দিতে হবে শিক্ষাবিদদের কাছে। তারা নানা গবেষণা করে, আগামী ২০বছর পর কি ধরনের লোক দ্বারা জাতি গঠন করতে চায় সেই আলোকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করতে হবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটিগুলো কোথায় তা বের করে বাজারমুখী চাহিদার আলোকে পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে একেবারেই ব্যর্থ। ফলে অনেকেই পড়ালেখা শেষ করেও চাকরি পাচ্ছে না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন :  সৃজনশীল পদ্ধতিকে কিভাবে দেখছেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ :  সৃজনশীল পদ্ধতিতে মেধার বিকাশের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রত্যেক মানুষ ভালো মেধা নিয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন না হলে আগামীতে মেধাহীন হবে জাতি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : কী কারণে বারবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে, এটা থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো প্রশ্নফাঁস। এর পিছনে মূল কারণ হলো দুর্নীতি। যারা প্রশ্নপত্র তৈরি করছে  এবং এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারাই মূলত প্রশ্নফাঁস করছে।

বিনা লাভে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করে না। এছাড়া সমাজে মূল্যবোধের অভাব দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটা পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এ শ্রেণীর অভিভাবকরা ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে। সাধারণ নাগরিকদের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারণে এমনটা হচ্ছে। এককথায় বলতে গেলে সন্তাদের অসাধু করে গড়ে তুলতে কাজ করছেন অভিভাবকরা।

সুতরাং প্রশ্নফাঁস হাওয়ার জন্য সামাজিক অবক্ষয় এবং মানবিক মূলবোধের ঘাটতি কিছুটা হলেও দায়ী। প্রশ্নফাঁস বন্ধে সরকারকে সর্তক থাকতে হবে। সমাজে মূলবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা চালু করতে হবে। প্রশ্নফাঁসসহ অসাধু কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও কমে আসবে প্রশ্নফাঁস। তবে যেখানে টাকা পয়সার সর্ম্পক লেনদেন, দূর্নীতি জড়িত সেখানে ঝুঁকি নিয়েই অনেকই প্রশ্নফাঁস করবে এটাই স্বাভাবিক। গোটা শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। তাতে করে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব হবে।

‘‘সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও লেখক। ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কাব্যচর্চা করতেন। শৈশবে বাবার সংস্পর্ষে থেকে তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। আবুল মকসুদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় তাদের বাড়ির নাপিত লোকনাথ শীলের কাছে। তিনি তাকে `বর্ণবোধ` ও `আদর্শলিপি`র পাঠ দিতেন। এরপর তিনি পড়েন তাদের ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহা পোদ্দারের কাছে। তিনি সপ্তাহে তিন-চার দিন তাকে পড়াতেন। তিনি ঝিটকা আনন্দমোহন হাই স্কুলে একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়ালেখা করেছেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এটি ছিল পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সপ্তাহিক `জনতা`য় কাজ করেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায় যোগ দেন। ২০০৮ সালের ২ মার্চ বার্তা সংস্থার সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রথম আলোর একজন নিয়মিত কলাম লেখক। তার প্রবন্ধসমূহ দেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। জার্নাল অব জার্মানী তার লেখা ভ্রমণকাহিনী। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।’’

/ এআর /