ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

চিকিৎসকদেরও কাঁদালো রাজীবের মৃত্যু

প্রকাশিত : ০৭:৪৬ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার

টানা দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেনে রাজধানীতে বাস চাপায় হাত হারানো সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। ১৫দিন আগেও তার দু’চোখে ভরা স্বপ্নগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। রাজীবের লাশের সঙ্গে তার স্বপ্নও এই শহর ছেড়েছে।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাশপাড়া গ্রামের প্রয়াত হেলাল উদ্দিন এবং আকলিমা বেগমের ছেলে বড় ছেলে রাজিব হোসেন। শৈশবে বাবা মাকে হারিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে কাটতে থাকে তার অসহায় দিনগুলো। চরম দারিদ্য আর মাথার উপর ছাদশূন্য আকাশ চরম বাস্তবতার রোদে পোড়াতে থাকে তাকে। জীবনের সেই কঠিন বাস্তবতার কাছে হার না মানলেও রাজধানীর দুই বাসায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা হার মানতে হয়েছে তাকে। স্বপ্নবাজ রাজীবের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। বড় জীবনের পথে তাঁর স্বপ্ন রচনার মঞ্জিল যেন ধীরে ধীরে নির্মিত হচ্ছিল। আলোর মুখ দেখছিল তার রোদে পোড়া স্বপ্নগুলো। কিন্তু এভাবে থাকে বিদায় দিতে হবে এটা অজানা ছিলো সবার।

দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পটুয়াখালী থেকে আসেন রাজধানীতে। ভর্তি হন পোস্ট অফিস হাইস্কুলে। খালার বাড়ি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ভর্তি হন সরকারি তিতুমীর কলেজে। বাবা মা হারা এতিম রাজীব দুই ভাইকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়ে ছিলেন। তার এমন স্বপ্ন ও সংগ্রামী জীবনকে থামিয়ে দিল যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল।

বিগত ১৫ দিন আগে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর ১৬ এপ্রিল থেকে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রাজীবের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। সেই থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি তাঁর। আজ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। রাস্তায় যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। রাজধানীর পথচারী বলছে, রাজধানীর রাস্তায় কেউ নিরাপদ নয়। যাদের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তাদের অবশ্যই বিচারের আওয়াত আনা উচিত। তাদের দাবি হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হক।

রাজীবের দায়িত্বরত চিকিংসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান বলেন, এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের। গত ১৩ দিন ধরে রাজীব হোসেনের সঙ্গে ছিলেন তাঁরা। রাজীবকে নিয়ে দেশবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাঁদেরও স্পর্শ করেছিল। দুর্ঘটনার পর যেন এই জগৎ-সংসারের ওপর অভিমান চেপে বসেছিল রাজীবের। হাসপাতালে যখন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও কথা বলেননি, তখন চিকিৎসকদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন তিনি। শুরুতে রাজীবের জীবনাশঙ্কা ততটা না থাকলেও গত এক সপ্তাহে তাঁর নিয়তি যেন নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল। এরপরও গতকাল সোমবার বুকের ভেতর এমন হাহাকার অনুভব করেছেন তাঁর চিকিৎসকেরাও।

তিনি বলেন, রাজীব নেই। আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রাজীবের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ক্রটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই  ক্রটিগুলো সারানো দরকার। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়ে আসতেন। এখন এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই যেমন আজ একটি বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। জীবন বাঁচাতে তার পা কেটে ফেলতে হলো।

রাজীবের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাস চালকের শাস্তির দাবিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন যাত্রী অধিকার আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। তার রাজীব হত্যারকারীদের সঠিক বিচার দাবি করেন।

এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজীবের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে ৩০৪–এর খ ধারায় তদন্ত হবে।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার তদন্তে ঘটনার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসলে এই ঘটনার আমরা শোকহাত।

টিকে