ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

৯ কোটি মানুষ মাদকের চরম ঝুঁকিতে   

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৫:১২ পিএম, ১৩ মে ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৯:৪২ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২০ বুধবার

মাদকের ভয়াবহ ছোবলে বাংলাদেশ। নিরবে চলছে এক ধ্বংসলীলা। যা কল্পনাতীত। আর এ ধ্বংসলীলায় মত্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্ম। তারাই সবচেয়ে বেশি এই আগ্রাসনের শিকার। দেশের ২০ থেকে ৪০ বছরের প্রায় ৯ কোটি মানুষ আজ মাদকের চরম ঝুঁকিতে। প্রতিটি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যেন মাদকের হাট। এ দেশের তরুণ মেধাবীরা যেখানে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে। শিক্ষা জীবন শেষ করে স্বপ্নের দেশ গঠনে ভুমিকা রাখবে সেখানে তারা প্রবেশ করছে স্বপ্নহীন এক জগতে। যা ধুঁকে ধুঁকে শেষ করে দিচ্ছে জাতির মেরুদন্ড।      

এ বিষয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে মাদকের ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ লোক এই মাদকে আসক্ত। এর মধ্যে তরুণরাই সবচেয়ে বেশি। দেশে এখন প্রায় ৯ কোটি তরুণ রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই এখন মাদকের ঝুঁকিতে। মিয়ানমার থেকে অবাধে ইয়াবা প্রবেশ করছে। এ দেশে মাদক আসা বন্ধ করার জন্য আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে অনেকবার বসেছি। তারা আমাদের প্রতিবারই আশ্বস্ত করেছে কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নিতে পারেনি। তাদের কারখানাগুলো তারা বন্ধ করেনি। ফলে সারাদেশ মাদকে ছেয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এটা নিয়ন্ত্রণের।’         

মাদকের ছোবলে দিশেহারা যুবসমাজ। এক গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায় দেশে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ইয়াবা প্রবেশ করছে। দেশের প্রায় ৬৫ ভাগ তরুণ এই মরণ নেশায় আসক্ত। ইয়াবার চালানের সঙ্গে দেশর প্রভাবশালীরাই বেশি জড়িত বলে জানা গেছে। এক গবেষণা তথ্য ওঠে আসে, টেকনাফে মোট ১৩৩টি গ্রাম রয়েছে এর মধ্যে ১০০টি গ্রামই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। টেকনাফের যুবসমাজের অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসায় তাদের পুরো সময় ব্যয় করে থাকে। এটি শুধু একটি এলাকার চিত্র। এভাবে সারা দেশেই ইয়াবার বিস্তার রয়েছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বনাশা ইয়াবা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিযানে ইয়াবার চালান বা অপরাধিদের ধরা হচ্ছে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এসব কারবার।   

ইয়াবার সঙ্গে জড়িত অনেককে গ্রেফতার করা হলেও সেটি তেমন একটি কাজে আসছেনা। বা ইয়াবা রোধে তেমন প্রভাব ফেলছে না। এর কারণ কি জানতে চাইলে সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। মাদকের বিস্তার রোধে এর আস্তানাগুলো ভেঙ্গে দেওয়ারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখানে দেখা যায় আমরা যাদেরকে গ্রেফতার করছি কিছুদিন পর তারা আবার জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে এটি একটি বড় সমস্যা। তারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও একই কাজ করছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এছাড়া যারা ইয়াবায় আসক্ত তাদেরকে সুস্থ করার জন্য সারাদেশে আমাদের প্রায় দুইশতাধিক হাসপাতাল রয়েছে। এর মাধ্যমেও আমরা মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’’ 

বিজিবিকে আরও আন্তরিক হওয়ার কথা বলে তিনি বলেন, ‘‘ইয়াবার বিস্তার রোধ করতে হলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কে আরও কঠোর ও আন্তরিক হতে হবে। তারা বিভিন্ন সময় ইয়াবার চালান ধরছে বা ইয়াবা উদ্ধার করছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় তারা আসামীকে ধরতে পারে না। বর্ড়ার দিয়েই দেশে ইয়াবা প্রবেশ করে থাকে। তারা যদি কঠোর হয় বা আন্তরিক হয়ে প্রতিরোধে কাজ করে তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সম্ভব হয়ে ওঠবে।’’  

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করলেও বর্তমানে কক্সবাজার হয়েই সবচেয়ে বেশি ইয়াবা প্রবেশ করছে। মাদক ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা আয় করছে মিয়ানমার। বর্ডারের পাশে তৈরি করছে আরও বড় বড় কারখানা। আর এদিকে এই মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদকের কারণে ভাঙ্গছে সুন্দর সংসার। তছনছ হয়ে যাচ্ছে বহু পরিবার। বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-বিভেদ, অস্থিরতা। মাদকের জন্য টাকা সংগ্রহে নিজের সন্তানকেও বিক্রি করার মতো হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ঘটছে। মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে স্ত্রী। হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহৃত হয় এই মাদকাসক্তরা। সবকিছু ছাপিয়ে সর্বনাশা মাদক শেষ করে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়া রহমান মাদক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, বিভিন্ন কারণেই মানুষ মাদকে আসক্ত হচ্ছে। এক সময় আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন খুব মজবুত ছিল। কিন্তু এখন এ বন্ধন অনেকটা নেই বললেই চলে। সম্পর্ক আলগা হয়ে যাওয়াও মাদকে আসক্ত হওয়ার একটা কারন। এরপর ইন্টারনেটের সহজ ব্যবহার, মাদকের সহজলভ্যতা। চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। ফ্রাস্টেশনসহ নানা কারণে যুবসমাজ এখন মাদকে আসক্ত হচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে হলে পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করতে হবে।  সামাজিক কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। প্রশাসনকে শক্ত হাতে মাদক নিয়ন্ত্রণে ভুমিকা রাখতে হবে। তাহলেই মাদক থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।  

এসি