ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে ছাত্রলীগের খসড়া কমিটি

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৭:১৪ পিএম, ১৬ মে ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০২:৩৪ পিএম, ১৯ মে ২০১৮ শনিবার

দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পরবর্তী নেতৃত্ব কারা আসছেন এটিই এখন রাজনীতির টেবিলে আলোচনার প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত গত এক সপ্তাহজুড়ে বিষয়টি চলমান রাজনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কমিটির খসড়া ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নীতিনির্ধারকেরা। প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই চূড়ান্ত করবেন মূল নেতৃত্ব। এর পরপরই কমিটি ঘোষণা করা হবে।

ছাত্রলীগের ২৯ তম সম্মলন হয়ে গেলো ১১ ও ১২ মে। ছাত্রলীগের তৃণমূলসহ নীতি নির্ধারকেরা ধরেই নিয়েছিল ১২ তারিখেই জানা যাবে মূল নেতৃত্বে তথা সভাপতি ও সম্পাদক কারা হচ্ছেন তাদের নাম। কিন্তু সম্মেলনের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন জানান কমিটি ঘোষণায়ে দু’এক দিন সময় লাগবে।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরবর্তী নেতৃত্বে কারা আসছেন সেই খসড়া কমিটি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। সেটি এখন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার টেবিলে। খসড়া অবস্থায় থাকা এ কমিটি যে কোনো সময় পেতে পারে পূর্ণাঙ্গ রূপ। যেকোনো সময় আসতে পারে ঘোষণা। আর সেদিকে তাকিয়ে আছে পদপ্রত্যশীসহ লাখো নেতাকর্মী।

এবারের সম্মেলন ছিল চমকে ঠাসা। সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ ছিল নেতৃত্ব নির্বাচনের বয়সসীমা ও কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। কীভাবে নতুন কমিটি গঠন হবে সে ব্যাপারে নেতা-কর্মীরা আগেভাগে নিশ্চিত হয়ে গেলেও বয়সসীমা কত হবে তা নিয়ে ছিল জোর আলোচনা। অন্যান্য সম্মেলন চলাকলে পরবর্তী নেতা কে হবেন তা আগেই ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু এবারের সম্মেলন ছিল ব্যাক্তিক্রম। কারা নেতৃত্ব আসছে সেটি নিয়ে নেতাকর্মীদের জল্পনা ছিল, কিন্তু কেউ নিশ্চিত হতে পারছিল না। ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটগুলো থেকেও কাউকে গ্রিণ সিগন্যাল দেওয়া হচ্ছিল না। এর কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই।

১১ মে প্রধানমন্ত্রী বিদায়ী কমিটি ও সাবেক নেতাদের ডেকে বলে দেন, ‘কাউন্সিলরদের খেয়ে চলে যেতে বলো। কমিটি আমি নিজে করবো।’ এমন ঘোষণার পর সবাই নিশ্চিত হয়ে যায়, সেদিন আর হচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা। যারা এতোদিন গর্ব করে বলছেন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আমি ঠিক করি সেই সিন্ডিকেট পিছপা হয়ে যায় যখন প্রধানমন্ত্রী বলে দেন যে, ছাত্রলীগে তার পছন্দ নেতৃত্ব আছে। পদপ্রত্যাশীদের সিভি ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দেখে তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন। তখন সবাই প্রধানমন্ত্রীর উপরই মূল নেতৃত্ব বাছাইয়ের ভার দেন। সবাই একবাক্যে বলেন, ‘আপা আপনার পছন্দ আমাদের পছন্দ’।

সম্মেলন শেষে মূল নেতৃত্ব নিয়ে লবিং তদবির শো ডাউনে কিছুটা ভাটা পড়লে আলোচনার টেবিলজুড়ে প্রাধান্য পাচ্ছে কারা হচ্ছেন সভাপতি ও সম্পাদক। সবাই চেয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষায়।

সম্মেলনের আগেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, এবার ছাত্রলীগের কমিটিতে চমক আসছে। সেটি আরও জোরালো হয় যখন আওয়ামী লীগ সভাপতি বলে দিলেন ছাত্রলীগে তার পছন্দের নেতৃত্ব আছে।

সম্মেলনের উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর থেকে ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছে তা নিয়ে দফায় দফায় আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন জনের নাম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে নিয়ে হয়েছে আলোচনা হয়েছে। সম্মেলনের দিনভরও বিভিন্ন জন আলোচনায় ছিলেন। আলোচিত পদ প্রত্যাশীরা যতোটা না সরব ছিলেন তার চেয়ে বেশি সরব ছিলেন তাদের সমর্থকরা। বরাবরের মতো আঞ্চলিকতা ভেদে কিছু অলিখিত প্যানেলও সাজিয়ে ফেলেছিলেন অনেকে।

ছাত্রলীগে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব পছন্দ আছে- এমন কথা ঘোষিত হওয়ার পর কে বা কারা সেই পছন্দের প্রার্থী তা নিয়েই চলছে জল্পনা কল্পনা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের নাম ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাতাসে। তবে সেসব নামের গ্রহণ যোগ্যতা অদৌ কতোটুকু বা প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার কাছে এই নামগুলোর অদৌ গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তবে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের অনুসন্ধানে এমন কিছু নাম বেরিয়ে এসেছে যেগুলো নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় জোরালোভাবে স্থান পাচ্ছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই দুটি শীর্ষ পদ ঠিক করে দেবেন। বাকিটা বিদায়ী কমিটি ও নতুন কমিটির উপর ছেড়ে দেবে।

সম্মেলনের শুরু থেকে এখন পর‌্যন্ত ছাত্রলীগে মূল নেতৃত্বের দাবিদার হিসেবে একটি নাম ঘুরেফিরে আসছে। সেটি হচ্ছে আদিত্য নন্দী। চট্টগ্রামের সন্তান আদিত্য বর্তমান কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ধীর স্থির প্রকৃতির আদিত্য নন্দী সংগঠনটির বর্তমান ও সাবেক নেতৃত্বের অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য। প্রথম দিকে আদিত্য নন্দীর নাম মাঠে খুব বেশি আলোচনায় না থাকলেও সম্মেলনের দু`একদিন আগে থেকে জোরালো আলোচনায় আসে এ নামটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ নেতা এ প্রতিবেদককে জানান, সভাপতি হিসেবে যাদের নাম আলোচনায় আছে তাদের মধ্যে আদিত্য নন্দী সেরা। তাছাড়া আঞ্চলিকতা বিবেচনায়ও আদিত্য নন্দীর নামটি প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ, ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি সম্মেলনে ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম থেকে কোনো মূল দায়িত্ব পায়নি।

আদিত্য নন্দী যদি ছাত্রলীগের সভাপতি হয় তাহলে সাধারন সম্পাদক হতে পারেন বর্তমান কমিটির সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী শোভন। উত্তরবঙ্গের সন্তান শোভন আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। তার বাবা দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রধানমন্ত্রীর গুডলিস্টে শোভনের নামে আছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স নেতৃত্বে আসছেন এমন কথা প্রথম দিকে শোনা না গেলেও সম্মেলনের পরদিন থেকে খুব জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। রাজনীতি ঘনিষ্ট একটি মহল দাবি করছেন প্রিন্স যদি নেতৃত্বে আসেন তবে তার রানিং মেট হবেন মাজহারুল হক শামীম। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিতে মাজহারুল হক শামীম সম্পাদকীয় দায়িত্বে ছিলেন। সব সময় সক্রিয় থাকায় শামীম পরিচিত মুখ।

আদিত্য নন্দীর সঙ্গে রেজাউল হক চৌধুরী শোভন বা মোতাহার হোসের প্রিন্সের সঙ্গে মাজহারুল হক শামীমের নাম প্যানেলে আকারে আসছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত আঞ্চলিকতা ব্যালেন্স করতে গিয়েই এমন যোগ বিয়োগ করা হচ্ছে। এমনটি হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন ছাত্রলীগে নেতা বানাতে গিয়ে যেন পরিবারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেসব বিবেচনায় প্রথম থেকেই আলোচনায় আছেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম এইচ এম কামরুজ্জামানের নাতনী ও রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের মেয়ে অর্না জামান। অর্না জামান বর্তমান কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্মেলনের আগে তার নামটি খুব জোরালো আলোচনায় না থাকলেও যতোই সময় যাচ্ছে নামটি ততোই গুরুত্ব পাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অন্য একটি সূত্র দাবি করছে যদি প্রধানমন্ত্রী নারীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাই করেন তাহলে অর্না জামানের নামটি সেখানে প্রাধান্য পাবে। ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের কাছে পছন্দের মুখ বর্তমান কমিটির সহ সম্পাদক জায়েদ বিন জলিলও। তবে সাধারন নেতা কর্মীদের পছন্দের মেসেজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। তবে ছাত্রলীগের সাবেক একাধিক নেতা দাবি করেছেন, একেবারে ফ্রেশ ইমেজের নেতৃত্ব বাছাই করা হলে সেখানে টিকে যেতে পারেন জায়েদ বিন জলিল।

একটি সূত্রের দাবি সৈয়দ আরাফাতও মূল নেতৃত্বে আসতে পারেন। সৈয়দ আরাফাত বর্তমান কমিটির উপ স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক। সংগঠনে তার গ্রহণযোগ্যতাও আছে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, চমক ও নির্বাচন সামনে রেখে আগামী দিনে ক্যাম্পাসে আন্দোলন-সংগ্রামের দিকটি মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী একটি ক্লিন ইমেজের শক্তিশালী কমিটি দিতে চাইছেন। যাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও ত্যাগ আছে এমন দু’জনকেই বেছে নেবেন তিনি। সেই ধরনের একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে আছে। সেটি থেকে তিনি নেতৃত্ব বাছাই করবেন। সেটি খুব শিগগিরই ঘোষিত হবে বলে জানা গেছে।

/এএ / এআর /