ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কোটা সংস্কার

‘প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ার জন্য আমলাতন্ত্র দায়ী’

প্রকাশিত : ০৯:০৯ পিএম, ১৭ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:৪৬ পিএম, ২১ মে ২০১৮ সোমবার

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-বিসিএস এর মতো সিভিল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা থাকা উচিত না। সিভিল সার্ভিসে কোটায় নিয়োগ পাওয়ার ফলে আমাদের আমলাদের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অন্য কাজতো দূরের কথা, আমলাতান্ত্রিক কাজে এরা ভারতের সঙ্গেই পারেনা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের অভিমত প্রকাশ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, একুশ শতক মেধার যুগ, প্রতিযোগিতার যুগ। যে এগিয়ে আসতে চাইবে তাকে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রজ্ঞাপন না আসার জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, আমলারা ফাইল চালাচালি করতে গিয়েই সময় নষ্ট করে। তাই এখনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে কোটা বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনকে আপনি কতোটা যৌক্তিক মনে করছেন?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: আমি মনে করি এ আন্দোলনটা ১০০ ভাগ যৌক্তিক। বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। আমি মনে করি বিসিএস- এর মতো একটা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কোটা থাকা উচিত না। যদি কোটা থাকতে হয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর গ্রেডে কোটা থাকতে পারে। কিন্তু প্রথম শ্রেণীতে কোটা দেওয়া অন্যায়। প্রাইমারী স্কুলে ৬০ ভাগ মেয়েদের কোটা। সেটা নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু সিভিল সার্ভিসে কোটায় নিয়োগ পাওয়ার ফলে আমাদের আমলাদের মান খারাপ হয়েছে। তারা আমলাতান্ত্রিক কাজে ইন্ডিয়ার সাথে পারেনা। অন্য দেশের সাথে তো পারার প্রশ্নই আসেনা। সেখানে কোনো কোটা থাকা চলবে না। ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে, সেখানে কিন্তু তারা কোটা বাতিল করার দাবি জানায়নি। তারা চেয়েছে সংস্কার। আমি দাবি জানাচ্ছি, সিভিল সার্ভিসে কোনো কোটা দরকার নেই। অন্য কোথাও থাকলে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা বাতিলে দাবিতে আপনার যুক্তিগুলো কী?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: একুশ শতক হচ্ছে মেধার যুগ। প্রতিযোগিতার যুগ। যে এগিয়ে আসতে চাইবে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এগিয়ে আসতে হবে। সেখানে কোটা ব্যবস্থা দিয়ে খুব বেশী দূর যাওয়া যাবে না। কোটা হয়েছিল সাময়িক সময়ের জন্য। আমরা চল্লিশ বছরের বেশি সময় কোটার ভেতর অতিক্রম করেছি। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না। আদিবাসীর জন্য কোটা দরকার। নারী কোটা দরকার। এমনকী মুক্তিযুদ্ধ পোষ্য কোটাও থাকতে পারে। কিন্তৃ সেটা বিসিএস - এর মতো পরীক্ষায় না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পরও এখনো কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। প্রজ্ঞাপন জারির ব্যাপারে আপনি কতোটুকু আশাবাদি?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: আমরা মনে হয় এটি একটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে আমলে নিয়ে আমলাদের দরকার ছিল খুব তাড়াতাড়ি প্রজ্ঞাপন জারি করা। যেহেতু আমদের রাষ্ট্রটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাই আমলারা ফাইল চালাচলি করতে করতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু কোটা বিরোধী আন্দোলন ছাত্রদের প্রাণের দাবি। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, অতিশীঘ্রই প্রজ্ঞাপন জারি করা। এটা নিয়ে সময় ক্ষেপণ করা কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে যে ভাষণটি দিয়েছেন তা দ্রুত আমলে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন:  চাকরীতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধির দাবিতে তরুণদের একটি অংশ আন্দোলন করছে। এটা আপনি কেমন সমর্থন করেন?

অধ্যাপক রোবায়ত ফেরদৌস: আমি এদের আন্দোলনকে খুব বেশি যৌক্তিক মনে করিনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বয়স সীমা ৬৫ হওয়ায় আমরা তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছি। নতুন যারা বেকার তাদেরকে তো চাকরীতে ঢুকতে হবে। চাকরীতে প্রবেশের বয়স সীমা ৩৫ হলে নতুনদের চাকরীতে প্রবেশের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে যায়। সেটা করা ঠিক হবেনা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: তরুনদের মধ্যে বিসিএসমুখী মনোভাব বাড়ছে। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: পুরো পৃথিবীতে ব্যবসায়ীরা, উদ্যোক্তারা এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের এখানে প্রচুর সুযোগ থাকার পরও তা হয়নি। ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের যে ধারাবাহিকতা আমরা বহন করছি, আমাদের যুব সমাজের মধ্যে এখনো উপনিবেশিক মানসিকতা রয়ে গেছে তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। `আমি চাকরী দেব` বা ` আমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবো` এমন ধারণা এখনো আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরকম স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসা উচিত। সরকারেরও এগিয়ে আসা উচিত। সবার আগে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কী যথোপযুক্ত মনে করছেন?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: না, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি আছে। এই পঙ্গু শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের তরুণদের কেরানী হওয়ার উৎসাহ দেয়। স্বনির্ভর, স্ব উদ্যোগে কিছু করার শিক্ষা দেয়না। যে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয়না তা কখনো পরিপূর্ণ শিক্ষা হতে পারেনা। পাশাপাশি আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি অনেক ত্রুটিপূর্ণ। এখানে আমাদের ছেলে মেয়েদের ক্রিটিকাল ফ্যাকাল্টিতে পরীক্ষা হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থী ক্রিটিক্যালি জগৎকে দেখতে পারে কিনা, চিন্তা করতে পারে কিনা, বিশ্লেষণ করতে পারে কিনা - তার উপর নির্ভর করবে সে কতোটুকু শিখলো। আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করতে পারতে হবে, তর্ক করতে পারতে হবে। সেইরকম একটা জায়গায় তাদের নিয়ে যেতে হবে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সাম্প্রদায়িক মানুষ তৈরি করে। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক মানুষ আমাদের দরকার। যারা তার পরিবারের কথা, সমাজের কথা,  রাষ্ট্রের কথা ভাববে। এখন যারা তৈরি হচ্ছে - তারা শুধু চাকরী ও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে। মানবতা নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে তারা ভাবেন না। ফলে এই জায়গায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগানোর ব্যাপারে আপনি কতোটুকু আশাবাদী?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: বাংলাদেশ তার ইতিহাসে একটা বড় জায়গায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ৬৫ ভাগ মানুষ কর্মক্ষম। এটিকে দ্রুত কাজে লাগিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে উন্নত রাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব। আমরা যদি উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে চাই, তাহলে আমাদের জনসংখ্যাকে শুধু কোয়ান্টিটি দিয়ে বিবেচনা না করে কোয়ালিটি দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। তাহলে কী করা উচিত? তাহলে আমাদের সঠিক শিক্ষা দরকার। দক্ষতা দরকার। ভালো ভাষা দক্ষতা তৈরি করা দরকার। নয়তো আমরা আমাদের যুব সমাজকে কাজে লাগাতে পারবো না। আমরা জানি, আমাদের দেশে ফরেন রেমিটেন্স আসে। আমাদের প্রচুর রেমিটেন্স কিন্তু ভারতে চলে যায়। আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে পাঁচ লক্ষ ইন্ডিয়ান ও শ্রীলংকান কাজ করে। কেনো কাজ করে? কারণ, এই লেভেলে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারি নাই। গার্মেন্টস মানে কিন্তু শুধু মেয়েদের সস্তা শ্রম না। গার্মেন্টসে পাঁচ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরীও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদেরকে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, ফ্যাশন ডিজাইনিং- কোর্সগুলো চালু করা খুব জরুরি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: তরুণদের নিয়ে আপনি কতোটা আশাবাদী?

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: আমি খুবই আশাবাদী। আশাবাদী এই কারণে, তরুণরাই পৃথিবী পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশে মাটির নিচে যতো লাশ, তার বেশীরভাগ তরুণদের। কেন? কারণ বেশীরভাগ তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেই তরুণরা যেনো সাম্প্রদায়িক না হয়, জঙ্গি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। আধুনিক, মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।