ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কোটা সংস্কার

দর কষাকষিতে আটকে আছে প্রজ্ঞাপন

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৮:৫২ পিএম, ২০ মে ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১১:৩১ পিএম, ২২ মে ২০১৮ মঙ্গলবার

(ফাইল ফটো)

(ফাইল ফটো)

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারে সরকার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে ২৫ শতাংশ কোটা থাকবে এদিকে শিক্ষার্থীরা বলছে সবোর্চ্চ ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে এমন দর কষাকষিতে আটকে আছে কোটা সংস্কার বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এছাড়া ও সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা সুস্পষ্টভাবেভাবে উল্লেখ না করাই প্রজ্ঞাপন জারিতে একটু বিলম্ব হচ্ছে।

এব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, আমর মনে হয় এটি একটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে আমলে নিয়ে আমলাদের  উচিৎ ছিল খুব তাড়াতাড়ি প্রজ্ঞাপন জারি করা। কিন্তু আমলারা ফাইল চালাচিালি করতে করতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা। এটা নিয়ে সময় ক্ষেপণ করা কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছেন তা দ্রুত আমলে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মোকাদ্দেম (এম এম আকাশ) একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না। কিন্তু আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিশেষ ব্যবস্থা আগে নির্ধারণ করতে হবে। তারপর নিয়োগ প্রক্রিয়া কোন ধরণের হবে সেটি আগে নির্ধারণ করতে হবে। এরপর কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। এজন্যই হয়তো একটু সময় লাগছে। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কোটা বাতিলের ঘোষণা একবার দিয়েছেন, অবশ্যই কোটা বাতিল হবে। কিন্তু কিছু কারণে একটু সময় লাগছে। আশা করি কিছু দিনের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

এব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো.মোজাম্মেল হক খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর সার্কুলার জারি করে কোটা সংস্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কারে কাগজপত্র ইতোমধ্যে প্রস্তুত। এখন শুধু প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর প্রয়োজন। প্রজ্ঞাপন বা সার্কুলার,প্রক্রিয়াধীন আছে। বাতিল না সংস্কার এবিষয় আলোচনা সমোলচেনা চলছে। এটা নির্ধারিত হলেই প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

এব্যাপারে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটি পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে, এরপর তারা কাজ শুরু করবেন।

এবিষয় জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার ও সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে পুরো জাতির সামনে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না। কিন্তু তার পাঠানো প্রতিনিধি দল বলছেন, ২০ ভাগ কোটা থাকবে। তারা এর পক্ষে নানা ধরনের যুক্তিও দেখাচ্ছেন। আমরা বলেছি, কোটা থাকলেও ১০ থেকে ১৫ ভাগের বেশি হবে না। এখন প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করবে, কোটা কী সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে না কি ১৫ শতাংশ থাকবে। আমরা দুটোতেই রাজি। কোটা পুরোপুরি বাতিল করা হলেও আমাদের আপত্তি নেই। আর যদি সংস্কার করে ১৫ শতাংশ রাখা হয় আমরা সেটাকেও স্বাগত জানাবো।

সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেখানে কোনো বিশেষ কোটার কথা না বলে সব মিলিয়ে কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি তোলা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন। তখন ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে অচল করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর জাতীয় সংসদে কোটা তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংস্কার করতে গেলে, কয়দিন পর আরেক দল এসে বলবে আবার সংস্কার চাই। কোটা থাকলেই হবে সংস্কার। আর না থাকলে সংস্কারের কোনো ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই।

তবে, এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।

কোটা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি সরকারের চূড়ান্ত বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোজাম্মেল হক খান। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কোটার প্রজ্ঞাপন জারির সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোটা বাতিলের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন সেটার চূড়ান্ত রূপ, যাকে আপনারা বলেন প্রজ্ঞাপন বা সার্কুলার, সে কাজটা একটু বাকি আছে। সেটা কোন পর্যায়ে আসবে সেজন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে এটা কি বলা যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরকারের চূড়ান্ত বিবেচনাধীন আছে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সোমবার পর্যন্ত স্থগিত ছিল’- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল বলেন, যখন ছাত্ররা আন্দোলন করছিল, তখন সরকারের প্রতিনিধিরা গেলে তাদেরকে বলা হয় ৭ মে পর্যন্ত এক মাস আন্দোলন স্থগিত করা হবে। দেখা গেল সেই কথা বলার পরও আন্দোলন থামেনি। তা হলে আমার বিবেচনায় ৭ তারিখ তো আর থাকল না। তারা যদি সেদিন আন্দোলন বন্ধ করতো তাহলে আজকে বলা যেত ৭ তারিখে কেন হলো না। এটা ঠিক কি-না? তিনি বলেন, এই বিষয়টা সরকারের মাথার মধ্যে আছে। সরকারের বিবেচনায় আছে। প্রধানমন্ত্রী যখনই নির্দেশ দেবেন সেটা বাস্তবায়িত হবে।

এই সময়ের মধ্যে গেজেট প্রকাশ না হলে ১ মে থেকে ফের আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। এমতাবস্থায় ২৭ এপ্রিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীমের বৈঠক হয়।

প্রায় দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে এবং মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাসে ৭ মে পর্যন্ত আলটিমেটামের সময় বৃদ্ধি করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। এই সময়েও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় ৯ মে মানববন্ধন করে ১০ মের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করতে ফের আলটিমেটাম দেন তারা।

কিন্তু চতুর্থ দফা আলটিমেটাম অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি না হলে ১৩ মে রোববার বিক্ষোভের ডাক দেন আন্দোলনকারীরা। ওই বিক্ষোভ থেকে ১৪ মে সোমবার থেকে লাগাতার ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ১৯ মে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিন্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

কোটা প্রথা: সরকারি চাকরি বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে ৫৬ শতাংশ প্রার্থীর-ই নিয়োগ হয় কোটা ব্যবস্থার আওতায়। অন্যদিকে বাকি ৪৪ শতাংশ পূরণ করা হয় সাধারণ কোটা থেকে। কোটা ব্যবস্থায় ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য। বাকি ২৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা ও বাকি ১ শতাংশ প্রতিবন্দী কোটা।

 টিআর/ এসএইচ/