ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাংলাদেশের মোবাইল খাত পর্ব-২

অবৈধ-ভুয়া পণ্যে সয়লাব বাজার, হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত : ০৬:২৩ পিএম, ৭ জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:১৫ এএম, ১০ জুন ২০১৮ রবিবার

রাহাত মাহমুদ ঢাকার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি রাজশাহীতে। টিউশনির টাকা জমিয়ে ছোট বোনের জন্য একটি মুঠোফোন কিনতে চান তিনি। এটি হবে বোনের ঈদ উপহার। ফোনের আবদার ঈদে লাগবে আইফোন। ইন্টারনেটে টুকটাক ঘাটাঘাটি করে ১৫ হাজার টাকায় একটি নতুন আইফোন সেভেনের সন্ধান পান তিনি। রাজধানীর একটি নামকরা বিপনী বিতানের একটি দোকানে বিক্রি হয় ওই আইফোন।

দোকানে গেলে রাহাতকে বলা হয়, এই আইফোনটি লাগেজে করে বাইরে থেকে আনা হয়েছে। তাই দাম কম। এভাবে লাগেজে মুঠোফোন আনা বৈধ বলেও দাবি করা হয় ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। তাই আর কোনো কিছু না ভেবে মুঠোফোনটি কিনে নেন রাহাত। তবে রাজশাহীতে ছোট বোনকে মুঠোফোনটি দেওয়ার দু’দিন পর জানা যায় যে, মুঠোফোনটি ক্লোন সেট। এ বিষয়ে জানতে ওই দোকানির নম্বরে ফোন দেন রাহান। দোকানটি মুঠোফোনের বিষয়ে কোনো দায়ভার নিতে রাজি হয়নি। রাহাত বুঝলেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন।   

রাহাতের মতোই রোজ এমন প্রতারণার শিকার হন অনেকেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনাময়ী এক খাতের নাম মোবাইল বা মুঠোফোন হ্যান্ডসেট ইন্ডাস্ট্রি। তবুও ভুয়া, অবৈধ, ক্লোন-কপি আর নকল হ্যান্ডসেটে সয়লাব বাজার।  বছরে অংকের হিসেবে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার বাজার আছে বাংলাদেশে। এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু বিশাল এই ‘সর্ষে ক্ষেতের মাঝেই আছে ভূত’। আর এই ভূতের কারসাজিতে একদিকে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে সরকার প্রতি বছর রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

বর্তমানে বলবত থাকা নিয়মানুযায়ী, দেশের বাইরে থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট ডিভাইস দেশে আমদানি করতে হলে দামের ওপর ৩০ দশমিক ১৯ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হয়। আর এই শুল্ক ফাঁকি দিতেই বিভিন্ন উপায়ে দেশের বাজারে অনুমোদনবিহীন হ্যান্ডসেট। বাজারের এই অংশটিকে বলা হয় ‘গ্রে মার্কেট’।

অবৈধ মুঠোফোন কোনগুলো

মুঠোফোনের বিষয়ে সরকারি যে সংস্থাটি সার্বিকভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিউনিকেশন-বিটিআরসি। বিটিআরসি জানায়, বাইরে থেকে দেশের ভেতরে মুঠোফোন আমদানি করার সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে।

বাইরে থেকে মুঠোফোন আমদানি করতে বিটিআরসি’র তালিকাভুক্ত বিক্রেতা বা আমদানিকারক হতে হবে সবার প্রথমে। তালিকাভুক্ত এসব বিক্রেতা বা আমদানিকারকেরা বাইরে থেকে যেসব মুঠোফোন আমদানি করতে চান তার আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) নম্বর এবং অন্যান্য তথ্য বিস্তারিত আকারে জমা দিতে হবে বিটিআরসি’তে।

বিটিআরসি এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে আমদানির অনুমতিপত্র দিলে তবেই আমদানি করা যাবে হ্যান্ডসেট। বিটিআরসি আমদানির জন্য অনুমতি পাওয়া হ্যান্ডসেটের বিস্তারিত তথ্য দেবে রাজস্ব বিভাগের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে। মুঠোফোনগুলো আমদানির সময় বিটিআরসি’র দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিল থাকলে সেগুলো দেশে প্রবেশের অনুমতি দেবে কাস্টমস বিভাগ।

এখানেই শেষ নয়। বিটিআরসি’র মিডিয়া উইং এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক মো. জাকির হোসেন খাঁন জানান, হ্যান্ডসেট আমদানির পর সেগুলো আবার যাচাই করিয়ে নিতে হবে বিটিআরসি থেকে। কাস্টমসের থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে দেখবে সংস্থাটি।

শুধু এভাবে আমদানি হওয়া মুঠোফোনই বৈধ মুঠোফোন বলে বিবেচিত হয়। তবে কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরার সময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য মুঠোফোন নিয়ে আসেন সেগুলোকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। একজন ব্যক্তি ভ্রমণের সময় সর্বোচ্চ চারটি মুঠোফোন সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেন।

কিন্তু এতসবের নিয়মের বেঁড়াজাল ভেদ করে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হ্যান্ডসেট অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

সরকারের রাজস্ব ক্ষতি

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি হ্যান্ডসেট বৈধভাবে আমদানি করা হয়। যার বাজার মূল্য ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অবৈধ উপায়ে যেসব মুঠোফোন দেশে আসে তাঁর সংখ্যা বৈধ বাজারের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।

সেই হিসেবে বৈধ বাজারের বাইরে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার মুঠোফোন দেশের বাজারে আসে অবৈধ উপায়ে। যার থেকে সরকার প্রতি বছর রাজস্ব আয় করতে পারত প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

যেসব ব্র্যান্ডের অবৈধ ফোন পাওয়া যায়

দেশের বাজারে নামিদামি প্রায় সবগুলো ব্র্যান্ডেরই নকল বা অবৈধ উপায়ে আসা হ্যান্ডসেট পাওয়া যায়। তবে সবথেকে বেশি নকল ফোন পাওয়া যায় আইফোন এবং স্যামসাং এর। অন্যদিকে অবৈধ উপায়ে আমদানি হওয়া মুঠোফোনের মধ্যে আছে শাওমি, হুয়াওয়ে এবং এইচটিসি।

বাংলাদেশে শাওমি’র অনুমোদিত আমদানিকারক সোলার ইলেক্টো বিডির কর্পোরেট সেলস বিভাগের প্রধান জোনায়েত হোসাইন জানান, বর্তমানে বাজারে যেসব শাওমি হ্যান্ডসেট পাওয়া যায় তাঁর প্রায় ৪০ শতাংশই অবৈধ উপায়ে আমদানি হয়ে আসে।

অবৈধ অথবা নিম্ন মানের ক্লোন ডিভাইস হওয়ার কারণে এসব মুঠোফোনের গুণগত মান ভালো হয় না। এছাড়া কোনো ধরণের বিক্রয়োত্তর সেবাও পাওয়া যায় না এসব হ্যান্ডসেট কেনার পর। আর যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্রেতারা।   

বাজারের ক্ষতি

অবৈধ উপায়ে আসা এসব হ্যান্ডসেট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের মুঠোফোন বাজারে। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ট্রানশন হোল্ডিংসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানুল হক জানান, অবৈধ উপায়ে যারা মুঠোফোন দেশে আনছেন তারা মূলত মুঠোফোনের কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই আনছেন। এভাবে একটি মুঠোফোন আনতে পারলেই ৩০ শতাংশ কর সাশ্রয় হয় যা মোবাইলের বাজারে লাভের পাল্লা ভারি করে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আর এই গ্রে মার্কেটের কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বৈধ উপায়ে হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা। সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করে বলে দাবি করেন এই খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। রেজওয়ানুল হোক বলেন, বাংলাদেশের গ্রে মার্কেটকে আমি তিন ভাগে ভাগ করে থাকি। প্রথমটি হচ্ছে ক্লোন বা কপি সেট। আরেকটি হচ্ছে রিভার্বিস্ট অর্থ্যাত দেশের বাইরে কিছুদিন ব্যবহারের পর দেশে আনা হয় সেসব মুঠোফোন। আর তৃতীয়টি হচ্ছে আসল হ্যান্ডসেট কিন্তু কোনো না কোনোভাবে কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা হ্যান্ডসেট। বর্তমানে বাজারে এসব অবৈধ কর ফাঁকি দেওয়া কিন্তু আসল মুঠোফোনগুলোই বেশি আসে। তবে এসব হ্যান্ডসেটে বিক্রয়োত্তর সেবা পান না গ্রাহকেরা।

অভিযোগের তীর যেদিকে

অবৈধ এসব মুঠোফোনের বিষয়ে আছে ত্রিমুখী অভিযোগ। নকল বা অবৈধ হ্যান্ডসেট কিনে যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের অভিযোগ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও অবৈধ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে। গ্রাহকদের দাবি, অবৈধ আমদানিকারকরা তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশ ও জাতির ক্ষতি করছেন। পাশাপাশি সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো   অবৈধ ও নকল মুঠোফোন বাজারে আসা ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে দাবি এক শ্রেণীর গ্রাহকদের।

অন্যদিকে বাংলাদেশ মোবাইল ফোন বিজনেসম্যান অ্যাসোসিয়েশনে (বিএমবিএ) সভাপতি ও টেলিলিংক গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জিটু সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। তিনি দাবি বলেন, অবৈধ আমদানিকারকদের সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যোগসাজোশ আছে। তারাই প্রথমে অবৈধ মুঠোফোন দেশের বাজারে আসতে দেন। পরে তারাই আবার মার্কেটে মার্কেটে অভিযান চালিয়ে সেগুলো জব্দ করেন। জব্দকৃত সেসব মুঠোফোনগুলো এরপর কি হয় তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই ব্যবসায়ী।

অন্যদিকে বৈধ উপায়ে যারা হ্যান্ডসেট আমদানি করেন তাদের অভিযোগ অবৈধ উপায়ে আমদানি করা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও তৎপর হওয়ার দাবি তোলেন তারা।

এসব বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলে রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বরত কোনো কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য জানাতে রাজি হননি। এমনকি ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (সার্বিক) মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রতিকার ও সমাধান কী

নকল ও অবৈধ হ্যান্ডসেট কিনে প্রতারিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মোবাইল খাত সংশ্লিষ্টরা। দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যতম শীর্ষ দুই ব্র‍্যান্ড হুয়াওয়ে এবং স্যামসাং গ্রাহকদের কিছুটা কম দামে অবৈধ এবং নকল হ্যান্ডসেট না কেনার পরামর্শ দেন গ্রাহকদের। এছাড়া সব ব্র‍্যান্ডের অনুমোদিত ডিলার বা দোকান থেকে হ্যান্ডসেট কেনার পরামর্শ দেন মোবাইল হ্যান্ডসেট খাত সংশ্লিষ্টরা।

রেজওয়ানুল হক জানান, ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রেশনের (এনইআইআর)মাধ্যমে অবৈধ গ্রে মার্কেট অনেকাংশে বন্ধ করা যায়। তিনি বলেন, এনইআইআরের মাধ্যমে বিটিআরসি একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলতে পারে। সেখানে শুধু অনুমোদিত হ্যান্ডসেটের আইএমইআই নাম্বারের তালিকা থাকবে। এই তালিকার বাইরের কোন মুঠোফোন বাংলাদেশের নেটওয়ার্কে চলবে না। এমনটা যদি করা যায় তাহলে গ্রে মার্কেট এমনিতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, চুরি বা ছিনতাই এর মতো ঘটনাও ঘটবে না।   

আর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যারা মুঠোফোন বিদেশ থেকে নিয়ে আসবেন তারা নিজেদের হ্যান্ডসেট বিটিআরসি’র মাধ্যমে এনইআইআর-এ নিবন্ধন করবেন। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ের ক্রেতারাও তাদের মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারবেন-যোগ করেন রেজওয়ান।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত) মাসুম আরেফিন বলেন, কোনো ক্রেতার কাছে যদি কোনো বিক্রেতা সঠিক তথ্য গোপন রেখে নকল বা ক্লোন হ্যান্ডসেট বিক্রি করে তাহলে সেই ভুক্তভোগী ক্রেতা আমাদের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাঁকে মুঠোফোন বিক্রয়ের প্রমাণ এবং মুঠোফোনটি যে নকল তার স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে।

/ এআর /

 এ সংক্রান্ত আরও খবর

গার্মেন্টের মতো বড় শিল্প হতে পারে মুঠোফোন ডিভাইস