ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

সীতাকুন্ডে ইকো-ট্যুরিজমের উজ্জ্বল সম্ভাবনা  

মো. আরিফুর রহমান

প্রকাশিত : ০৯:৫১ পিএম, ১২ জুন ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:৫৩ পিএম, ১২ জুন ২০১৮ মঙ্গলবার

একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত বিকাশমান একটি অনবদ্য ও অগ্রসরমান শিল্প হলো পর্যটন। পর্যটনশিল্প তার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল। ‘ভিজিট বাংলাদেশ’ স্লোগানে শুরু হয়েছিল পর্যটন বর্ষ-২০১৬। স্বাগত জানাচ্ছে বাংলাদেশ ও বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি পর্যটনশিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময়ী দেশ। এদেশে ছড়িয়ে আছে অপরিমেয় সৌন্দর্য। দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশ প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক সব সম্পদেই সমৃদ্ধ। এ কারণে যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে চির সবুজঘেরা বাংলাদেশ এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে পরিচিত-অপরিচিত অনেক পর্যটক-আকর্ষক স্থান আছে। তার মধ্যে সৌন্দর্যের রাণী বলে খ্যাত চট্টগ্রাম অন্যতম। এখানে রয়েছে সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, লেক, বন, ঝর্ণা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা-যা পর্যটকের মনকে ভরিয়ে তোলতে যথেষ্ট। চট্টগ্রাম জেলার পর্যটক-আকর্ষক উপজেলাগুলোর মধ্যে সীতাকুন্ড অন্যতম। সীতাকুন্ড অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি-যেখানে আকাশ, পাহাড় ও ঝর্ণা মিলে মিশে একাকার আর হাতছানি দিয়ে ডাকে সমুদ্র। সীতাকুন্ডের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তার সেই বিখ্যাত গান ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়...’। গতানুগতিক পর্যটন এর পরিবেশের ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেই ধারণা থেকে বাইরে এসে আশির দশক থেকে সমগ্র বিশ্বে ইকো-ট্যুরিজম` বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ ব্যাপক প্রসার ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ইকো-ট্যুরিজম` বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ বলতে বোঝায় পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং তার পারিপার্শ্বিকতাকে অটুট রেখে বেড়াতে যাওয়া। পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ এর অন্যতম কয়েকটি শর্ত হল; পরিবেশের, প্রতিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি না করে একেবারে কাছাকাছি চলে যাওয়া, ভ্রমণস্থানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, সেটিকে যথাযথ সম্মান দেখানো ও স্থানীয় মানুষের আর্থিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখা। ইকো-ট্যুরিজম` বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ এর জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেও প্রসার ঘটেছে। সেই প্রেক্ষাপটে পরিবেশের ভারসাম্য, ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের চাহিদা ও স্থানীয় মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন এর কথা চিন্তা করে সীতাকুন্ড এলাকায় ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ এর ব্যাপক সম্ভাবনা, গুরুত্ব ও চাহিদা রয়েছে।

সীতাকুন্ডে কমিউনিটিভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম এর সম্ভাব্য সব পর্যটনস্পট

সীতাকুন্ড চট্টগ্রামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এলাকাটি পাহাড়, সমুদ্র, ছড়া-ঝর্ণা, জলাধার-লেক, উদ্যান, উপকূলীয় বনভূমি, সমুদ্রসৈকতের ছায়াতলে বিরাজমান। এখানের পাহাড়চূড়াগুলোয় রয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বেশকটি বৌদ্ধবিহার-মন্দির। জনসংখ্যার দিক থেকে রয়েছে বৈচিত্র্যতা, এখানে বাংলাদেশীর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির বসবাস (মারমা, ত্রিপুরা)। ভৌগলিক ও অবস্থানগত কারণে উক্ত স্থানসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে অবস্থিত। যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সড়কপথ ছাড়াও রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। সহজ এ যোগাযোগমাধ্যম, প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্যতা এবং জনগোষ্ঠির ভিন্নতা সীতাকুন্ডকে দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে। এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও কৃষিনির্ভর কর্মকান্ড দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছে। এক্ষেত্রে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ, বন থেকে ফল ও কাঠ সংগ্রহ, আবাদি জমির ফসল উৎপাদন অন্যতম। যদিও এ উপজেলায় বৃহৎ বৃহৎ শিল্পকারখানা অবস্থিত ও সম্প্রতি সীতাকুন্ডের পাশবর্তী উপজেলা মীরসরাইকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে কিন্ত বাস্তবিক অর্থে কর্মদক্ষতার অভাবে এ বৃহৎ শিল্পকারখানায় স্থানীয় জনগণের জীবিকার আশ্রয় অনেকাংশে কম। কিন্তু সেখানে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে স্থানীয় কমিউনিটিনির্ভর ইকো-ট্যুরিজম শিল্পের। সীতাকুন্ড উপজেলার পর্যটকদের আকর্ষণীয় বিশেষ স্থানসমূহ নিচে তুলে ধরা হলো-

সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়

সীতাকুন্ডের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র হলো “চন্দ্রনাথ পাহাড়”। চট্টগ্রাম মহানগর থেকে এর দূরুত্ব প্রায় ৩৭ কিলোমিটার। সীতাকুন্ড বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে চন্দ্রনাথ পাহাড় অবস্থিত। বাজার থেকে সর্পিল আঁকা-বাঁকা একটি সড়ক চলে গেছে সোজা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। কথিত আছে নেপালের একজন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বিশ্বের পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ আর সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ। এ স্থানটি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সর্বোচ্চ চূড়াটির উচ্চতা প্রায় ৩৬৫ মিটার বা ১২০০ ফুট প্রায়। চূড়ায় ওঠার পথটি বেশ দুর্গম। পর্যটকদের পাহাড়ে ওঠার জন্য এখান থেকে শান বাঁধানো সিঁড়ি তৈরি করা আছে। এ পথে রয়েছে শংকর মঠ, শ্মশান, গিরিশ ধর্মশালা, সৎসংঘ আশ্রম, জগন্নাথ আশ্রম, ননী গোপাল সাহা তীর্থ মন্দির, ভৈরব ধর্মশালাসহ আরও অনেক দেবালয়। আরও কিছুটা পথ ওঠার পরে দেখা যাবে ভবানী মন্দির। ভবানী মন্দির ছেড়ে আরেকটু পথ এগোলেই শয়ম্ভুনাথ মন্দির, ছোট্ট একটি পাহাড়ি ঝর্ণা। আর এখান থেকেই চন্দ্রনাথ মন্দিরের দিকে ওঠতে হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে নিচে নামলেই ইকোপার্কের শুরু। এটি দেশের প্রথম ইকো-পার্ক। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা সহজেই সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌর্ন্দয উপভোগ করতে পারবে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে প্রায় পাঁচঘণ্টায় সীতাকুন্ডে আসা যায়। এখানে আছে রেলপথ। রেলপথে আসতে চাইলে আন্তঃনগর ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে হবে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে সীতাকুন্ডে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে সাতঘণ্টা। পর্যটকদের আবাসনের জন্যে এখানে স্থানীয়ভাবে তেমন কোনো মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল নেই। তবে স্থানীয় কিছু মন্দির ও বেসরকারি সংস্থা ইপসা’র ডরমেটরী রয়েছে। আগে থেকে যোগাযোগ করে আসলে সেসব ডরমেটরীর আবাসনসুবিধা নেওয়া যেতে পারে। পর্যটকদের খাবারের জন্যে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধে নেই। স্থানীয় হোটেলগুলোতে খাবারের চাহিদা মেটাতে হয়। স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের জন্যে কোনো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড নেই। নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘুরে দেখতে হয়। যদি পর্যটকদের জন্যে মানসম্পন্ন পরিবহন,পরিচ্ছন্ন থাকা-খাওয়া ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তবে এখানে দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকেরাও চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় জমাবে।

সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথধামে শিবচতুর্দশী মেলা উপভোগ

উপমহাদেশে সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথধাম। প্রতিবছর তিথিসময়ে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথধামে শিবচতুর্দশী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্যাসকুন্ডে স্নান-তর্পণ ও গয়াকুন্ডে পিন্ডদানশেষে পূণ্যার্থীরা মঠ-মন্দির পরিভ্রমণ করে মেলায় মিলিত হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের কাছে সবচেয়ে বড় মেলা হচ্ছে সীতাকুন্ডের এ শিবচতুর্দশী মেলা। এ মেলা উপলক্ষে লাখ লাখ পুণ্যার্থী হিন্দু নরনারী সারাদিন উপবাস থেকে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মন্দিরগুলোতে দুধ ও ডাবের জল দিয়ে শিবকে স্নান করান। মেলা উপলক্ষে দেশীয় পণ্য বিশেষ করে হস্তশিল্পের সামগ্রীসহ গৃহস্থলীর নানা পণ্যের বিশাল ভ্রাম্যমান বাজার বসে। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা সহজেই সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথধামের এ শিবচতুর্দশী মেলা উপভোগ করতে পারবে।

সীতাকুন্ডের ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন

সীতাকুন্ড ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে দেশের প্রথম এবং এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন অবস্থিত। সীতাকুন্ড বাজারের ২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ১৯৯৬ একরের ওপর এ গার্ডেনটি অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম ইকোপার্ক। চট্টগ্রাম মহানগর থেকে এর দুরুত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে সড়কপথে পাঁচঘণ্টায় সীতাকুন্ডে আসা যায়, আর রেলপথও রয়েছে। রেলপথে আসতে চাইলে আন্তঃনগর ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে হবে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে সীতাকুন্ডে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় সাতঘণ্টা। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাণিকুলের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে বন বিভাগ এ পার্ক প্রতিষ্ঠা করে। এখানে বিরল প্রজাতির গাছপালা, সৌন্দর্যবর্ধক ফুলের বাগান, কৃত্রিম লেক, পিকনিক স্পট, গ্রিনহাউস এবং বিরল প্রজাতির পশুপাখি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে তিনটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ মন্দির, যেগুলো দর্শকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।সীতাকুন্ড ইকোপার্কের ভেতরের যে সৌন্দর্য তা এক কথায় অপরূপ। এখানে রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির গোলাপ বাগান, অর্কিড হাউস, গ্রীনহাউস, পদ্ম পুকুর, ভ্যালি ব্রীজ, প্রাকৃতিক লেক, নয়নাভিরাম ঝর্ণা, আর হাজারো পাখির কলতান। ভাগ্য ভালো হলে দেখা যেতে পারে বাঁদর, নানারকম মায়া হরিণসহ অনেক বণ্য প্রাণির। তাছাড়া পার্কের চুড়া থেকে সোজা পশ্চিমে তাকালে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ ও নয়নাভিরাম সূর্যাস্তের দৃশ্য। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কে প্রবেশ মূল্যে জনপ্রতি ১০ টাকা। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ জনের জন্যে মাত্র ১০০ টাকা প্রবেশ ফি দিতে হয়। এক্ষেত্রে আসার আগে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইর্কোপার্ক কর্তৃপক্ষকে অবগত করতে হবে। স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের জন্যে কোনো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড নেই। নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে সীতাকুন্ডের বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক ঘুরে দেখতে হবে। 

সীতাকুন্ডের প্রাকৃতিক ঝর্ণাসমূহ

সীতাকুন্ড থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে লবণ পানির উষ্ণ ঝর্ণা যা স্থানীয় ভাষায় লাবণাক্ষ্য ঝর্ণা নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে সহস্রধারা আর সুপ্ত ধারা নামের দু’টি জলপ্রপাত। তাছাড়াও বর্ষাকালে আরো অনেক নাম না জানা ঝর্ণার দেখা পাওয়া যায়। ঝর্ণাপ্রিয় পর্যটকদের জন্যে সীতাকুন্ডের ঝর্ণাসমূহ অতি আকর্ষণীয় বিষয়। সৌন্দর্যপ্রিয় পর্যটকেরা এখানে আসেন ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ও ঝর্ণার পানিতে নিজেকে সিক্ত করতে।

ভাটিয়ারি লেকে নৌবিহার ও মৎস্য শিকার

সীতাকুন্ডের কৃত্রিম লেক ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের রূপে ও মাধুর্যে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কৃত্রিম লেক হল ভাটিয়ারির লেক। প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ লেকটি চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে সীতাকুন্ড উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়ন থেকে এক-দুই কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সড়ক পথে ছয় ঘণ্টায় সীতাকুন্ডে আসা যায়, আর রয়েছে রেলপথ। রেলপথে ভাটিয়ারি আসতে চাইলে প্রথমে আন্তঃনগর ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে হবে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে ভাটিয়ারি আসতে হবে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় ছয়ঘণ্টা। পাহাড়ের কোলঘেঁষে আঁকাবাঁকা লেকটি অপরূপ সুন্দর। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত ভাটিয়ারি লেক এর অন্যতম আকর্ষণ এখানে নৌকা করে বেড়ানো ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। স্বচ্ছ পানির জলাধারের চারপাশ সবুজ চাদরে মোড়া। মনে হয়, কোনো সুনিপুণ শিল্পীর কারুকাজ। ভাটিয়ারি লেকের চারপাশে পাহাড়ের বুকচিরে ছুটে চলা পর্যটককে বিমুগ্ধ করবে। সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি হলো, বাংলাদেশের একমাত্র স্থান যেখান থেকে পাহাড়ী সূর্যোদয় ও সূযাস্ত দুটোই দেখা যায়। পাহাড়ী দিগন্তের প্রান্ত থেকে চিরে সূর্যোদয় এবং সমুদ্রের বক্ষে সূর্যকে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা নিঃসন্দেহে অপরুপ ও ভাগ্যের ব্যাপার। আর এ দুই দৃশ্য অবলোকন করা যায় সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি থেকে। ভাটিয়ারি লেকের পাশেই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি অবস্থিত। প্রাসঙ্গিক কারণে এখানে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত। পর্যটকদের খাবারের জন্যে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এখানে কিছু ক্যাফে ও স্ন্যাকস বার রয়েছে যা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত। স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের জন্যে কোনো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড নেই। নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে ভাটিয়ারি লেকে নৌবিহার ও মৎস্য শিকার উপভোগ করতে হয়। প্রতিবছর অসংখ্য দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক সীতাকুন্ডের এ ভাটিয়ারি লেক দেখতে ভিড় জমায়।

নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রার সাথে পরিচয়ঃ

জনসংখ্যার বৈচিত্র্যতা রয়েছে সীতাকুন্ডে। সীতাকুন্ডের দুর্গম পাহাড়ে দুটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির (মারমা ও ত্রিপুরা) বসবাস। নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি বসবাসরত এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণোপযোগী আবকাঠামো নির্মাণ বা তাদের বসবাসরত স্থানে পর্যটকদের জন্যে সাময়িক আবাসন নির্ধারণ করতে পারলে অনেক ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা আকৃষ্ট হবে এবং যার ফলে পরিবেশবান্ধব পর্যটন এর প্রসার ঘটবে।

কুমিরা ফেরিঘাট ও সমুদ্রবিহার (সীতাকুন্ড থেকে সন্দ্বীপ)

সীতাকুন্ডে তিনটি ঘাট রয়েছে যেখান দিয়ে মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ১৮কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত সন্দ্বীপে যাওয়া যায়। সীতাকুন্ডের সবচেয়ে’ সুন্দরতম ঘাট হলো কুমিরা ঘাট। এখান থেকে প্রায় প্রতি আধঘণ্টা পরপর স্পীডবোট করে ২০ মিনিটে সন্দ্বীপ যাওয়া যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিরা নামক স্থানে ফেরিঘাটটির অবস্থান। বিআইডব্লিউটিএ’র বড়জাহাজ করে দিনে একবার সীতাকুন্ড থেকে সন্দ্বীপ আসা যাওয়া করে। এ্যাডভেঞ্চরপ্রিয় পর্যটকদের জন্যে এসব জায়গা খুবই আর্কষণীয় ও ভ্রমণোপযোগী। কুমিরা ঘাট থেকে সমুদ্রে সূর্যাস্ত এর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ঢাকা থেকে সড়ক পথে ছয় ঘণ্টায় সীতাকুন্ড (কুমিরা ঘাটে) আসা যায়, এছাড়া রয়েছে রেলপথ। রেলপথে কুমিরা আসতে চাইলে প্রথমে আন্তঃনগর ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে হবে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে কুমিরা আসতে হবে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় ছয়ঘণ্টা। প্রতিবছর অসংখ্য দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক সমুদ্রবিহার করার জন্যে সীতাকুন্ড থেকে সন্দ্বীপ ভ্রমণ করে। পর্যটকদের খাবারের জন্যে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে এখানে কিছু ক্যাফে ও ¯স্ন্যাকস এর দোকান রয়েছে। স্থানীয় হোটেলগুলোতে খাবারের চাহিদা মেটাতে হয়। স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের জন্য কোনো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড নেই। সমুদ্রবিহার আয়োজনে পর্যটকদের নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। নিজ উদ্যেগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে সীতাকুন্ড থেকে সন্দ্বীপ সমুদ্রবিহার উপভোগ করতে হয়।

বাঁশবাড়ীয়া ও মুরাদপুর সমুদ্রসৈকত

বাঁশবাড়ীয়া ও মুরাদপুর বেড়িবাঁধ পেরিয়ে সমুদ্রসৈকতের দিকে যেতেই বামদিকে ঝাউবাগান। এখানে আছে ফেরিঘাট, পাশে কেওড়া গাছের বাগান, এরপর রয়েছে বিশাল সমুদ্রসৈকত-যা কক্রবাজারের সমুদ্রসৈকত দেখার স্বাদ মেটাবে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে সীতাকুন্ড উপজেলাসদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্রসৈকত। যদিও পুরো সীতাকুন্ড সমুদ্রোপকূলে অবস্থিত কিন্তু তুলনামূলকভাবে সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়ীয়া ও মুরাদপুর এর সমুদ্রসৈকত বালুকাময় ও সুন্দর। এ সমুদ্রসৈকতকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জনগণের আর্থ-কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর অসংখ্য দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক, সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়ীয়া ও মুরাদপুর এর সমুদ্রসৈকত দেখতে ভিড় জমায়। পর্যটকদের আবাসনের জন্যে এখানে স্থানীয়ভাবে কোনো আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের খাবারের জন্য দিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এখানে কিছু স্ন্যাকস বার রয়েছে। স্থানীয় হোটেলগুলোতে খাবারের চাহিদা মেটাতে হয়। স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের জন্য কোনো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড নেই। সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তা যথেষ্ট ঘাটতি ও বসে বিশ্রাম নেয়ার কোনো সুব্যবস্থা নেই। নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়ীয়া ও মুরাদপুর এর সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে হয়। পর্যটক আকর্ষণে দ্রুত প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য সব ব্যবস্থার আয়োজন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সীতাকুন্ডে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান

সীতাকুন্ডের বারৈয়াঢালায় রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে। সীতাকুন্ড থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ও ছোট দারোগাহাটের সন্নিকটে এ বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। সেখানে রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণি। দূর থেকেই নজরে পড়বে বিভিন্ন প্রজাতির উচুঁ বৃক্ষ (শাল, সেগুন, আকাশমনি, চাপালিশ) ও গুল্ম প্রজাতি। বনের দিকে যতই এগিয়ে যাওয়া যাবে, ততই সৃষ্টি হতে থাকবে রোমাঞ্চকর সব অনুভূতি! পথের ধারে ছোট-ছোট বসতবাড়ি। পথ পেরুতে পেরুতে চোখে পড়বে উচুঁ উচুঁ টিলা ও পাহাড়। প্রাকৃতিক এ বনভূমির মধ্যে নেই কোনো কৃত্রিমতা, নেই কোনো আনুষ্ঠানিকতা। এ্যাডভেঞ্চরপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এসব স্থান আর্কষণীয় ও ভ্রমণোপযোগী। ঢাকা থেকে সড়ক পথে পাঁচঘণ্টায় সীতাকুন্ডে আসা যায়, এখানে রয়েছে রেলপথ। রেলপথে সীতাকুন্ড আসতে চাইলে প্রথমে আন্তঃনগর ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে হবে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে সীতাকুন্ডে বারৈয়াঢালায় রিজার্ভ ফরেস্ট-এ আসতে হবে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় সাতঘণ্টা। প্রতিবছর অসংখ্য দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক পাহাড়ের উদ্যান ও ট্র্যাকিং করার জন্য ভিড় জমায় সীতাকুন্ডের বারৈয়াঢালার জাতীয় উদ্যানে। পর্যটকদের আবাসনের জন্য এখানে স্থানীয়ভাবে কোনো আবাসিক হোটেল নেই। পর্যটকদের খাবারের জন্য দিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এখানে কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে নেই কোনো প্রশিক্ষিত ও দক্ষ গাইড। এবং জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের নিরাপত্তা যথেষ্ট ঘাটতি ও বসে বিশ্রাম নেবার কোনো সুপরিসর জায়গা নেই। নিজ উদ্যোগে ও প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে সীতাকুন্ডের বারৈয়াঢালার জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। যদি পর্যটকদের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মিলনমেলায় রূপ নেবে।

পাহাড় আরোহণ ও ট্রেইল

ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের পাশেই সীতাকুন্ডের পাহাড় ও বনাঞ্চলের অবস্থান। ছোট-বড় পাহাড়ের ঢালে ঢালে চিরসবুজ প্রকৃতি, ভ্রমণপ্রিয় যেকোনো পর্যটকের কাছে আর্কষণীয় ও উপভোগ্য হবে। এসব পাহাড়ী বনে রয়েছে শতবর্ষী গর্জন গাছ। এছাড়াও রয়েছে শাল সেগুন, আকাশমণি, গর্জন, চাপালিশ, হরিতকি, বহেরা, বাশঁ, আকাশ লতা, ছন প্রভৃতি উদ্ভিদ। এখানে রয়েছে বেশ কিছু ট্রেইল, এই সমস্ত ট্রেইলে চলতে চলতে দেখা মিলবে বেশ পুরোনো বৃক্ষ, বাশঁঝাড় সহ নানান জাতের গাছপালা। ভাগ্য সহায় হলে দেখা মিলতে পারে বানর, বন্য শুকুর, সজারু, শিয়াল ও খরগোশ। এ অঞ্চলটি নানান জাতের পাখির অভয়ারণ্য। মোটকথা এখানকার পাহাড় ও বনাঞ্চল বেশ সাজানো ছবির মতো। প্রতিবছর হাজার হাজার দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক সীতাকুন্ডের পাহাড় দেখতে ভিড় জমায়।

গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও কৃষি কর্মকান্ড অবলোকন

গ্রামীণ জীবনযাত্রার এক অপরূপ চারণক্ষেত্র হল সীতাকুন্ডের এর গ্রামীণ জনপদ। এখানকার গ্রাম এবং মানুষের জীবন এক নিবীড় বন্ধনে বাঁধা। শহরের যান্ত্রিকতা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে ও ভবিষৎ প্রজন্মকে গ্রামীণ জনপদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বেড়াতে ও দেখতে আসতে পারে সীতাকুন্ডের গ্রামীণ জনপদ। এখানে রয়েছে গ্রামের মেঠোপথ, সুশীতল গাছের সারি, আঁকাবাঁকা পথঘাট, সবুজ প্রান্তর, সহজ সরল জনগোষ্ঠি, লোকালয়ের প্রান্ত ঘেসে বাঁশঝাড়, দক্ষিণা বাতাস, শীতের কুয়াশা ও বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টি। যেন প্রকৃতির সহজ রূপায়ন। তাছাড়াও সীতাকুন্ডের ঐতিহাসিক ক্ষেতের আইলে করা শিম চাষ। এই গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও কৃষি-কর্মকান্ড অবলোকন করতে রাজধানী ও চট্টগ্রাম শহর থেকে বিভিন্ন পর্যটক, শিক্ষানুরাগী ও গবেষক এখানে আসতে পারে।

জাহাজভাঙ্গা শিল্প ও ভারি শিল্পকারখানা অবলোকন

সীতাকুন্ডের সমুদ্রতীরে রয়েছে দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙ্গন ও রিসাইক্লিং শিল্প। ইউরোপ ও আমেরিকার পুরোনো জাহাজগুলো এখানে ভাঙ্গা হয়। এ জাহাজভাঙ্গা শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠেছে বিশাল শিল্পপল্লী। জাহাজভাঙ্গা শিল্প থেকে সংগ্রহকৃত লোহা বাংলাদেশের লোহার সিংহভাগ চাহিদা মেটানো হয়। প্রতিবছর হাজার হাজার দেশীয় ও স্থানীয় পর্যটক জাহাজভাঙ্গা শিল্প দেখা ও পুরোনো ব্যবহার্য ও এন্টিক সামগ্রী সংগ্রহ করার জন্য সীতাকুন্ডে আসেন।

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ভারি শিল্পকারখানাগুলো সীতাকুন্ড অবস্থিত। সম্প্রতি সরকার সীতাকুন্ডের পাশবর্তী উপজেলা মীরসরাইকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। যার ফলে ভারি শিল্পকারখানাগুলো এখানে গড়ে ওঠছে। এ ভারি শিল্পকারখানা দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পর্যটক, শিক্ষানুরাগী ও গবেষক এখানে আসতে পারে। যদি পর্যটক, শিক্ষানুরাগী ও গবেষকদের জন্য মানসম্পন্ন দক্ষ গাইড, পরিবহন, থাকা-খাওয়া ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তবে এখানে দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকরাও এ শিল্প দেখতে ও গবেষণা করতে ভিড় জমাবে।

স্থানীয় পর্যটন বাজার বিশ্লেষণ ও সম্ভাবনা

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের পর্যটনখাতে অপার সম্ভাবনা দেখছে বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি)। ২০১৫ সালে জিডিপিতে এ খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪০৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন টাকা এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মোট অবদান ৮০৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন টাকা বা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পর্যটন খাত হতে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে আয় করেছে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা যা মোট রপ্তানি আয়ের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এই আয় ২০২৬ সাল নাগাদ বেড়ে হবে ২ হাজার ২৪০ কোটি। ডব্লিউটিটিসি এক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে বিশ্বের যে ২০টি দেশ পর্যটনখাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করবে, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ। কেন না উন্নত পর্যটনশিল্প বিকাশের সকল উপাদানই বাংলাদেশের প্রাাকৃতিক সহজলভ্যতায় বিরাজমান। বিশেষ করে সীতাকুন্ডে পরিবেশবান্ধব পর্যটন এর যে সমস্ত নিয়ামক দরকার সব কিছুই এখানে রয়েছে। এখন শুধু দরকার সমন্বিত উদ্যোগ, পর্যবেক্ষণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে নিবিড়চর্চা। প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় দশ হাজারের অধিক পর্যটক সীতাকুন্ড এর প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয উপভোগ করতে ভিড় জমায়। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ, সুবিধা ও সঠিক তথ্যের অভাবে পর্যটকেরা বিমুখ হচ্ছে ও মানসম্পন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যার ফলে রাষ্ট্র হারাচ্ছে রাজস্ব ও স্থানীয় কমিউনিটির আর্থ-সামাজিক অবস্থার স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন হচ্ছে না। অথচ যথার্থ উদ্যোগ ও সমন্বয় ঘটালে এ খাত থেকে প্রচুর রাজস্ব আয় ও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করাও সম্ভব। তাছাড়াও এখানে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। গ্রামীণ জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অবলোকন ও গবেষণার রয়েছে বিশেষ সুযোগ। উল্লেখ্য, প্রাথমিক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহর থেকে সীতাকুন্ডের পর্যটন স্থানসমূহে একজন পর্যটক ভ্রমণ করলে তার খরচ হয় জনপ্রতি ১৫০০ টাকা। আর রাজধানী ঢাকা থেকে ভ্রমণ করলে ব্যয় হয় জনপ্রতি ৫০০০ টাকা। যদিও রয়েছে যোগাযোগের অমসৃণতা, স্বাচ্ছন্দ্যতা, বিশ্বাস ও আশ্বস্ততার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও ভোগান্তির বিষয়। নেই ভালোভাবে রাতযাপনের সুযোগ ও স্থানীয় দক্ষ পর্যটক গাইড সুবিধা। প্রস্তাবিত এসব স্থানে ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোর সমন্বয় ও সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এ খাত থেকে প্রতিবছর প্রচুর রাজস্বআয় অর্জন করা সম্ভব। সম্ভব বৈদিশিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করা। তাছাড়াও এ খাত থেকে অর্জিত আয় হতে পারে স্থানীয় জনগণের বিকল্প আয়ের অন্যতম উৎস।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার শিল্পাঞ্চল সীতাকুন্ডের দৃষ্টিনন্দন এসব জায়গাতে যদি পর্যটকদের জন্য মানসম্পন্ন পরিবহন,পরিচ্ছন্ন থাকা- খাওয়া ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়- তাহলে অনাবিল ও নৈসর্গিক শোভা অবলোকন করতে দেশি-বিদেশি ভ্রমণপাগল মানুষগুলো বার বার সীতাকুন্ডে ছুটে আসবে।

উপসংহার

সীতাকুন্ডে রয়েছে পর্যটক আর্কষণের সম্ভাব্য সকল প্রাকৃতিক উপাদান। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লালনভূমি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পরিকল্পিত টেকসই উন্নয়ন ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত অংশগ্রহণই একমাত্র নিশ্চিত করতে পারে ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন। এর ফলে যেমন নিশ্চিত হবে পরিবেশের সংরক্ষণ ও স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন। সরকার ২০১০ সালে একটি পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, সেখানে বহুমাত্রিক পর্যটনের কথা বলা হয়েছে। বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড। পর্যটনশিল্পের বিকাশের ওপর বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। দেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থান ঘটবে ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসা’র অন্যতম মূলনীতি। সেই মূলনীতিকে লালন করে ইপসা বিগত তিন দশকের অধিক সময় ধরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে উন্নয়ন কর্মসূচি সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করে আসছে। পাশাপাশি সমস্দ সীতাকুন্ড ও মীরসরাই কমিউনিটিভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন এর প্রসারে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। ইপসা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশকে সত্যিকারের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কমিউনিটিভিত্তিক পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্পকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা খুবই জরুরি।  

লেখক- প্রধান নির্বাহী, ইপসা

এসি