ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সিজারিয়ান ডেলিভারীতে কখন সম্মত হবেন?

ডা. উম্মুল খায়ের মাহমুদা

প্রকাশিত : ০৬:৪৩ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৬:৪৪ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৮ বুধবার

একজন গর্ভবতী মা ও বাচ্চা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকলে সাধারণত যোনিপথে সন্তান প্রসব করেন। এই স্বাভাবিক অবস্থার অন্যথা হলেই বিকল্প চিন্তার অবকাশ দেখা দেয়। বর্তমান বিশ্বে বিকল্প চিন্তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে সিজারিয়ান ডেলিভারী।

সিজারিয়ান ডেলিভারী হলো মাকে অর্ধেক বা পুরো অজ্ঞান করে মার পেটের নিচের দিকে ও জরায়ুর নিচের দিকে কেটে বাচ্চা বের করা। সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকিপূর্ণ হয়।

তবে প্রাকৃতিক উপায় সর্বোত্তম। কারণ এতে শুধু লেবার পেইন সহ্য করা ছাড়া আর তেমন কোন সমস্যাই হয়না। মা পরের দিন সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে যান।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নরমাল ডেলিভারীর এতো উপকারিতা সত্বেও কেন সিজার করতে হয়। এবিষয়ে সবারই পরিস্কার ধারণা থাকা উচিত। এটা জানলে অনেক অনাকাংখিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। প্রসূতির পরিবার বুঝতে পারে কোন প্রয়োজনে সিজার হচ্ছে আর কোন প্রেক্ষাপটে সিজার করা উচিত না।

সিজারিয়ার ডেলিভারী করার নির্দেশনাগুলো দুটো বড় ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

এক. যখন নরমাল ডেলিভারী একেবারেই অসম্ভব। যেমন:

ক. জরায়ুমুখ প্লাসেন্টা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে থাকে।

খ. মায়ের কটিদেশ ও মায়ের মাথার আকারের বড় অসামঞ্জস্য।

গ. তলপেটে বড় টিউমার।

ঘ. জরায়ুর মুখে ক্যান্সার।

ঙ. যোনিপথ সরু হওয়া।

দুই. নরমাল ডেলিভারী সম্ভব কিন্তু তা মা বা বাচ্চা উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন-

ক. স্বল্পমাত্রায় মায়ের কটিদেশ ও বাচ্চার মাথার অসামঞ্জস্যতা।

খ. পূর্বে সিজারের ইতিহাস থাকলে।

গ. বাচ্চার অবস্থা খারাপ হলে।

ঘ. প্রসব চলাকালে মায়ের জরায়ু ঠিক মতো কাজ না করলে।

ঙ. মা ও বাচ্চার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে।

চ. মায়ের রক্তক্ষরণ হলে।

ছ. গর্ভে আড়াআড়িভাবে বাচ্চার অবস্থান থাকলে।

জ. নির্দিষ্ট সময়ের পরও সবরকম চেষ্টা সফল না হলে।

ঝ. পূর্বে গর্ভে বা প্রসবের সময় বাচ্চা মারা গেলে।

ঞ. অতিরিক্ত প্রেসার বা একলামসিয়া হলে।

ট. মায়ের ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ হলে।

ঠ. পূর্বে ভেসিকো ভাজিনার ফেস্টুলা সেলাই করলে।

উপরোক্ত নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু কিছু সিজার elective করা হয় সব ধরণের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে। আবার কিছু সিজার emergency করা হয় মা বা বাচ্চা বা উভয়কে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য।

গত দশ বছরে সিজারিয়ান ডেলিভারীর রেট দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। এই বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান। যেমন:

১. আগের চেয়ে এখন অপারেশন করা অনেক বেশী নিরাপদ। চিকিৎসাবিদ্যায় উন্নতি, রক্তসঞ্চালনের সুবিধা বৃদ্ধি ও ভাল কার্যকর এন্টিবায়োটিক।

২. হাইরিস্ক প্রেগন্যান্সি নির্ণয় বেশি হচ্ছে।

৩. বাচ্চা ঝুঁকিতে আছে কিনা তা নির্ণয়ে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে।

৪. প্রাথমিক সিজারিয়ান ডেলিভারীর রেট বাড়ছে।

৫. উল্টো বাচ্চা ভ্যাজিনালি করা হচ্ছে না।

৬. আগের চেয়ে ত্রিশ বৎসরের বেশি বয়সের মা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ডায়াবেটিস, হাপারটেনশন বেড়ে যাচ্ছে।

৭. ছোট পরিবারে বিশ্বাসী হওয়ায় গর্ভবতী মা, তার পরিবার বা ডাক্তার নরমাল ডেলিভারীর ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।

৮. মায়ের অনুরোধে সিজার বাড়ছে।

৯. মা বা বাচ্চার ক্ষতিতে মামলার ভয়ে সিজার বাড়ছে।

নরমাল ডেলিভারীকে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়। যথা:

প্রথম ধাপে জরায়ুর মুখ খোলা থেকে শুরু করে পুরোপুরি খোলা পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ সেমি পর্যন্ত খোলা।

দ্বিতীয় ধাপে যোনিপথ পুরোপুরো খোলা থেকে বাচ্চা যোনিপথ থেকে বের হওয়া পর্যন্ত।

তৃতীয় ধাপে গর্ভফুল বের হওয়া পর্যন্ত।

এর মধ্যে প্রথম স্টেজে চার সেমি পর্যন্ত জরায়ু মুখ খোলা পর্যন্ত পর্যায়টা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে চার সেমি থেকে active phase শুরু হয়। Active phase ৪ ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। হলে তা নরমাল। তবে এর বেশী দীর্ঘস্থায়ী হলে আমরা খেয়াল করি কোন সমস্যা আছে কিনা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। যদি দুই ঘণ্টা পরও নরমাল ডেলিভারী না হয় তাহলে আমরা সিজারিয়ান ডেলিভারীর ব্যবস্থা করি। লেবার পেইন শুরু হওয়ার ১৮ ঘণ্টা পর পর্যন্ত স্থায়ী হলে তা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয় বিধায় সিজার করা হয়।

[লেখক পরিচিতি: ডা. উম্মুল খায়ের মাহমুদা একজন প্রসূতি, স্ত্রী ও বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন। তিনি শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মাতুয়াইল- এ গাইনী বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়াও রাজধানীর পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে তার চেম্বার রয়েছে।]

email: mahmudak50@gmail.com

অনুলেখক: আলী আদনান।