ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

যত টেস্ট তত কমিশন

বাড়তি টেস্টের বোঝায় সর্বশান্ত হচ্ছেন রোগীরা

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৪:৫২ পিএম, ২ আগস্ট ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৫৮ পিএম, ৪ আগস্ট ২০১৮ শনিবার

সালেহা বেগম, বয়স ৫৭। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কোনোমতে খেটে খেয়ে সংসার চলে তাঁর। র্দীঘদিন ধরে জরায়ু সমস্যায় ভোগছেন। এলাকায় বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে এর আগে চিকিৎসা নিয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটা বেসরকারি হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে ১৫ দিন আগে। ডাক্তার তাকে দেখে ৬ থেকে ৭ টা টেস্ট ধরিয়ে দেন। টেস্টের সেই রির্পোট সংগ্রহ করতে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ওই রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যেসব ওষুধ দেন তা খেয়ে কোনো কাজ হয় নি।

উপান্তর হয়ে সালেহা ধার দেনা করে চিকিৎসা নিতে আসেন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।

বর্হিবিভাগের ডাক্তার তার আগের কোনো রির্পোট না দেখে নতুন করে ১০টা টেস্ট দেন। ১০ টেস্টের রির্পোট সংগ্রহ করতে আবার ১২ হাজার টাকা গুনতে হয়। টেস্ট করানো ও রির্পোট সংগ্রহ করতে চলে যায় তিন দিন।

রির্পোট দেখে ডাক্তাররা তাঁর তেমন কোনো সমস্যা পাননি বলে জানান। সালেহার সঙ্গে কথা হয় একুশে টিভি অনলাইনের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, কেন এতগুলো টেস্ট করানো হলো। আমার বাবার জন্মেও  এতো টেস্ট করানো হয়নি। এতো পরীক্ষা করেও ডাক্তার আমার কোনো রোগ পাননি। এটা কেমন কথা! এত টেস্ট দেখে শুধু অবাকই হননি, রীতিমতো বিস্মিতও তিনি। টেস্টগুলো নাড়াচাড়ার পর ডাক্তার রিপোর্টগুলোর বেশিরভাগই নরমাল বলেন। তখন সালেহা মনে প্রশ্ন জাগে এগুলোর আদৌ প্রয়োজন ছিল?

এমন অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় টেস্টের বোঝা কেবল সালেহা-ই বহন করেছেন এমন নয়। অপ্রয়োজনীয় টেস্টের ভারে ন্যূজ বেশিরভাগ রোগী-ই। অনেকে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন।

বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রাইভেট চেম্বার ঘুরে দেখা গেছে দু’একজন ছাড়া বেশিরভাগ চিকিৎসকই রোগীকে ধরিয়ে দিচ্ছেন টেস্টের লম্বা লিস্ট। পরামর্শ দিচ্ছেন পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে। এর কারণ প্রতিটি টেস্টের জন্য চিকিৎসকরা পান একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন। ১৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন টেস্ট রেফার করা ডাক্তাররা। মানে যত টেস্ট তত কমিশন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবথেকে বেশি লাভ এমআরআই, সিটিস্ক্যান, টর্চ স্ক্রিনিংসহ রক্তের কিছু টেস্টে। শিশুদের স্নায়ু সমস্যা নির্ণয়ে রক্তের টর্চ স্ক্রিনিংয়ের ফি বেসরকারি হাসপাতালে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা। মস্তিষ্কে বা মেরুদন্ডে এমআরআই টেস্ট ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। মস্তিষ্ক, টেস্ট বা পেটের সিটিস্ক্যান ফি সাড়ে তিন হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কমিশন বাণিজ্য করতে গিয়ে অনেক সময় ঘটছে টেস্ট জালিয়াতির ঘটনাও। এটি করছেন কিছু অর্থোলোভী চিকিৎসক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক।

যেমন ধরুন একজন রোগী চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর রোগের বর্ণনা শুনে মনে হলো টেস্টের প্রয়োজন নেই। কিন্তু টেস্ট ছাড়া রোগীকে ছেড়ে দিলে তো চিকিৎসকের ঝুলিতে কমিশন পড়বে না, তাই প্রেসক্রিপশনে কয়েকটি টেস্ট লিখে তার ওপর টিক চিহ্ন দিয়ে পাঠাচ্ছেন নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। টিক চিহ্ন’র মানে হলো কাঁচামাল খরচ করে শুধু শুধু আর এসব পরীক্ষার দরকার কী? রিপোর্টে নরমাল লিখে দিলেই চলবে। বিনিময়ে টেস্টগুলো বাবদ কমিশন পেলেই হলো। তবে এ ধরনের প্রতারণা সাধারণত কিছু কমিশনলোভী চিকিৎসক ও অখ্যাত ডায়াগনস্টিক সেন্টারই করে থাকেন।

এ তো ডাক্তারদের কথা। নগর-মহানগরগুলোতে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো করছে আরও জালিয়াতি। ওইসব স্থানে বেশ কয়েকটি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেখেন একজন বিশেষজ্ঞ। অনেক সময় রিপোর্ট দেখার সময়ও পান না, নরমাল লিখে দিয়ে দায়িত্ব সারেন। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে রিপোর্ট দেখার দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তি রিপোর্ট দেখেন না। দেখেন শিক্ষানবিসরা। কখনো কখনো প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের নামের উপর সই করে দেন স্টাফরা। এভাবে সমানতালে চলছে টেস্ট বাণিজ্য।  

অভিযোগ রয়েছে একেকটি টেস্টের জন্য বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন পেয়ে থাকেন চিকিৎসক। তাদের এ ধরনের প্রবণতায় রোগীরা খুবই বিরক্ত এবং বাড়তি টেস্টের খরচে তারা সর্বশান্ত হয়ে পড়ছেন।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, সবাই এমন অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেয় এ কথা ঠিক নয়। ডাক্তার নামধারী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে যারা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত টেস্ট দিয়ে থাকেন। ডাক্তারদের  বিবেচনায় রাখতে হবে অনেকেই গ্রাম থেকে গরীব রোগী ঢাকাতে আসে চিকিৎসা নিতে আসে। রোগীর রোগ বিবেচনায় নিয়ে যে টেস্ট্র না দিলেই নয় সেটা দেওয়া উচিত।

টেস্টের উপর ডাক্তারের কমিশনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আবদুল্লাহ বলেন, সবাই বেশি টেস্ট দিয়ে কমিশন খায় এমন কথা ঠিক নয়। কিছু ডাক্তার কমিশন খায়। যে কারণে একটু বাড়তি টেস্ট দেয় এটা সত্যি কথা। তবে এ বিষয়ে আমাদের সর্তক থাকা উচিত। রোগীর আর্থিক সার্মথ্যের কথা বিবেচনা করে টেস্ট দেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসির) রেজিস্ট্রার ডা. জাহেদুল হক বাসুনিয়া একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, এমন কোনো অভিযোগ আমরা এখনও পাইনি। তবে এটা শাস্তিযোগ অপরাধ।। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করারও ক্ষমতা রয়েছে বিএমডিসির।

টিআর/ এআর