ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

আজ ১৫ই আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:৩৩, ১৫ আগস্ট ২০১৭ | আপডেট: ১০:৪৩, ১৫ আগস্ট ২০১৭

‘‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর রৌদ্র ঝরে/চিরকাল গান হয়ে/নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা/যার নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে/মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’’

প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার নায়ক কোন মহাপুরুষ তা কাউকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয় না। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি যদি হয় ১৫ আগস্ট তবে মনে পড়ে যাবে সেই দিনের কথা। শ্রাবণের অন্তিম দিনে সেদিন বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল বুকের তাজা রক্ত। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বিশাল বুক থেকে তাজা রক্ত ঝরেছিল ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। সেদিন ধানণ্ডির ৩২ নম্বর রোডে এই বাংলাদেশেরই কতিপয় লোভী, বিশ্বাসঘাতক কুলাঙ্গার ও পথভ্রষ্ট সেনা সদস্য বাঙালি জাতির অসংবাদিত নেতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাঙালি জাতির ললাটে এঁকে দেয় কলঙ্কের তিলক।

বাঙালি জাতির এতো বড় একজন নেতা আর কোনোদিন জন্মাবে না। বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বন্ধু এই মহৎ হৃদয় মানুষটির দেশের সাথে ছিল আত্মার আত্মীয়তা। এই ভালোবাসা এই আত্মীয়তাই ছিল তার শক্তির উৎস! জনগণের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা এই মানুষটির বৈষয়িক কোনোকিছুর প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। মানুষের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। জনগণের ভালোবাসাই ছিল তার একমাত্র সম্পদ।

বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষকে, তাঁর মতো একজন মহান নেতাকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে এমন কথা কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। কারণ, বাংলার মানুষের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। সে কারণেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ঘনিষ্ঠজনদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনের মতো সুরক্ষিত স্থানে না থেকে তিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন ধানমণ্ডির অরক্ষিত নিজ বাড়িতে। তিনি একবারও ভাবেননি যে কোনো বাঙালি তার প্রাণনাশ করতে পারে।

স্বাধীনতাবিরোধী ওই ঘাতকচক্র যেভাবে বঙ্গবন্ধুও তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে তা পৃথিবীতে বিরল ও মর্মান্তিক ঘটনা। মার্টিন লুথার কিং, লিংকন, লুমুম্বা, কেনেডি, মহাত্মাগান্ধী, ইন্দিরাগান্ধীর মতো নেতারাও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কাউকেই বঙ্গবন্ধুর মতো সপরিবারে হত্যা করা হয়নি!  সেই কালরাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, জামালসহ ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকদের বুলেট থেকে শেখ রাসেলের মতো ছোট্ট শিশুও রেহাই পায়নি!  বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যে কাজটি করার দুঃসাহস করেনি, সেটিই করেছে বাঙালি নামেরই কিছু কুলাঙ্গার। দেশের মানুষের জন্য সবকিছু উজার করে দিয়েও স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশকে গড়ে তুলতে তিনি যখন দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তখনই ঘটানো হয় এ নৃশংস ঘটনা। পরিসমাপ্তি ঘটে একটি ইতিহাসের। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলার মাটিও মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকরা। কিন্তু যাঁর স্থান কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে তাঁকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলে কার সাধ্য?

সেই বিভিষীকাময় কালো রাতের পর ৪২টি বছর কেটে গেছে, জনসংখ্যা বেড়েছে অনেকগুণ। কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলার জনপদের ধূলিকণা ভুলতে পারেনি বিষাদময় ১৫ই আগস্টের কথা! স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অশ্রুভেজা, কলঙ্কময় এই দিনটি বাঙালি জাতির শোকের দিন!

একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ। যাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণিল, যাঁর কণ্ঠে ছিল জাদু। তাইতো তিনি ফিরে আসেন প্রতিটি উৎসবে, আনন্দ-বেদনায়। তিনি যে মৃত্যুঞ্জয়ী।

আগস্ট মানেই শোক, আগস্ট মানেই শোকে আপ্লুত বাঙালির কান্নাভেজা পরম বেদনা। আগস্ট এলেই শ্রদ্ধায় অবনত হয় বাঙালিরা। ডুকরে কেঁদে ওঠে বাঙালি জাতির হৃদয়। চারদিকে কেবলই স্রোত নামে শোকস্তব্ধ মানুষের। মানুষ কাঁদে। বেদনায় গান গায়। নামে শোকের মিছিল। কালোয় কালোয়, শোকে শোকে বেদনাবিধুর হয়ে ওঠে গোটা দেশ, দেশের মানুষ।

পিতাহীন দেশে, সঙ্কটে উপনীত বাঙালি তাই এখনও আশ্রয় খোঁজে তাঁরই আদর্শে।

নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে কিছু বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর রাজনীতিক এবং বিপথগামী কিছু সামরিক কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সংবাদমাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-কে দায়ী করা হয়।

পরদিন ১৬ আগস্ট এই মহাপুরুষের মরদেহ তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র পনের মিনিটে সামরিক তত্ত্বাবধানে লোক দেখানো দাফন করা হয় হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটিকে, অন্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। যা ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট সংসদে রহিত করা হয়। এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের কার্যক্রম। বহু কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য খুনিদের এখনো দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি সরকার। তাই এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের তপ্ত হৃদয়ে এখনো বইছে ক্ষোভের বহ্নি শিখা।

বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী এমন এক বীরের নাম, যিনি জীবনের শেষক্ষণেও ছিলেন দৃঢ়চেতা। তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে মৃত্যু ঘটে একজন মহান জাতীয়তাবাদী নেতার। যিনি তার জাতিসত্তা বাঙালিত্বের চেতনায় এই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে জাগ্রত করেছিলেন। আজীবন লড়াই করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হওয়ার নয়। তাই আজো মানুষের চোখে অশ্রু বঙ্গবন্ধুর স্মরণে। ঠিক তেমনভাবে যেমনভাবে বলেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, ‘এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী/ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি/হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা/এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।’

জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। শোক দিবস সামনে রেখে এ মাসের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করছে। সরকারিভাবেও পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি।

আজ সরকারি ছুটি। সরকারি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং আলোচনাসভার আয়োজন করা।

সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এ ছাড়া ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের শাহাদতবরণকারী সদস্য ও অন্যান্য শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ এবং দোয়া করবেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সমাধিস্থলে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলো জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে কর্মসূচি পালন করবে।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশে মসজিদগুলোতে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।

এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু একাডেমী এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বক্তৃতার আয়োজন করবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবসে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ছয়টায় ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, সকাল সাড়ে সাতটায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে।

এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।

ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি