ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

একনজরে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:০৭, ১০ মে ২০১৮ | আপডেট: ১৯:০৯, ১০ মে ২০১৮

বিশ্বের স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর ৫৭তম দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর এর কার্যকারিতা শুরু হতে আরও বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। তবুও ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উৎক্ষেপণ হবে স্যাটেলাইট।

সবকিছু ঠিক থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে ১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবগাত রাত ৩টা) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে মহাকাশে পৌঁছে দিতে উড়াল দেবে স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেটের একটি নতুন সংস্করণ।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর ইন-অরবিট টেস্ট বা আইওটি শেষে তিন মাস পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে সেবা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে সেবা বিপণনে প্রচার-প্রচারণা ও যোগাযোগের জন্য স্যাটেলাইট কোম্পানি উদ্যোগ নিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকিগুলো অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করা হবে। অব্যবহৃত এ অংশ নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে অর্থ আয় করা যাবে। এখন দেশের টেলিভিশন চ্যানেল, টেলিফোন ও রেডিও বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়ায় পরিচালিত হয়। এতে প্রতি বছর ভাড়াবাবদ কোটি কোটি টাকা গুনতে হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে দেশের অর্থ দেশেই থেকে যাবে। একই সঙ্গে ব্যাপকভাবে মহাকাশ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টিভি বা রেডিও চ্যানেল, ফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রযুক্তি, নেভিগেশন বা জাহাজের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনাসহ বিভিন্ন কাজে এটি ব্যবহৃত হবে।

এছাড়া দূর-সংবেদনশীল তথ্য, মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে ব্যবহার করা যাবে এ স্যাটেলাইট। মহাশূন্য এক্সপ্লোরেশন, হারিকেন-ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস, গ্লোবাল পজিশনিং বা জিপিএস, গামা-রে বারস্ট ডিটেকশনের কাজেও লাগবে এটি।

এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, জাতিগতভাবে ৫৭তম দেশের কাতারে বাংলাদেশের অবস্থান সম্ভব হচ্ছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ থেকেই আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি। উৎক্ষপণের দিনটি হবে বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম একটি দিন।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। অন্যগুলো ভাড়া দেয়া হবে। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে।

২০১৩ সালে রুশ কোম্পানি স্পুটনিকের কাছ থেকে ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমার বর্তমান স্লটটি কেনে বিটিআরসি। ১৫ বছরের জন্য এ স্লট পাওয়ার জন্য গুণতে হয়েছে ২৮ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বারবার আইটিইউর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থাকলেও নিজস্ব আরবিটাল স্লট আনতে পারেনি।

মহাকাশের পথে স্বপ্নযাত্রা: ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশ জয়ের সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সেই বছর ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যার পর আর সব যাত্রার মতো এ যাত্রাও থেমে যায়। এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সরকার থমকে যাওয়া সেই যাত্রার প্রাথমিক শুরুটা করলেও ২০০১ সালে সরকার বদলে তা আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ২০০৯ এবং ২০১৪ পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ অবশেষে বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ পায়।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচিতি : ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ২৬ কু-ব্যান্ড এবং ১৪ সি-ব্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ চুক্তি : ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ-ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা সহায়তা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের থুলুজে স্যাটেলাইটটির মূল কাঠামো তৈরির কথা দেয় থ্যালেস।

সরকারের অর্থায়ন : ২০১৫ সালের মার্চে একনেকে দুই হাজার ৯৬৭.৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে। যার মধ্যে সরকারি অর্থ এক হাজার ৩১৫.৫১ কোটি টাকা এবং বিদেশি অর্থায়ন ধরা হয় এক হাজার ৬৫২.৪৪ কোটি টাকা। বিটিআরসি কৃতিত্বের দাবি আনতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি দুই হাজার কোটি টাকায় শেষ হচ্ছে।

ইতিহাসের অংশ থ্যালেস : দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ পায় ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ডিজাইন এবং নির্মাণের চুক্তি হয়। চুক্তিটি ছিল এক হাজার ৯৫১.৭৫ কোটি টাকার।

কক্ষপথ কেনা : স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়। মহাকাশে এ কক্ষপথের অবস্থান ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এই কক্ষপথ কেনা হয়।

ব্যবসায়িক পরিকল্পনা : স্যাটেলাইটটির ক্ষমতার অর্ধেক দেশের বাজারে ব্যবহার হওয়ার পর বাকিটা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সাত বছরের মধ্যে খরচ উঠে আসবে। তবে এখনও সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনার বিষয়টি জানা যায়নি।

দিগন্ত প্রসারিত কভারেজ : স্যাটেলাইটটির কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজাকিস্তান পর্যন্ত। বাংলাদেশের অবস্থান ৯০ ডিগ্রিতে হলেও বঙ্গবন্ধু-১ এর অবস্থান হচ্ছে আমাদের অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। দুটি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মিত হয়েছে গাজীপুর ও রাঙ্গামাটিতে।

উৎক্ষেপণের মাহেন্দ্রক্ষণ : গত ৩০ মার্চ বঙ্গবন্ধু-১ ফ্লোরিডা লঞ্চিং প্যাডে পৌঁছে। প্রাথমিকভাবে এর সম্ভাব্য উৎক্ষেপণ ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। পরে চলতি বছরের ৩০ মার্চসহ আরও কয়েকটি তারিখ নির্ধারণ হলেও আবহাওয়া ও কারিগরি কারণে সময় পরিবর্তিত হয়।

ন্যানো স্যাটেলাইট দিয়ে যাত্রা শুরু : ব্র্যাক অন্বেষ ২০১৭ সালের ৪ জুন দেশের প্রথম ন্যানো স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট যে লঞ্চার উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে তারাই ব্র্যাক অন্বেষা উৎক্ষেপণ করে। অন্বেষার গ্রাউন্ড স্টেশন মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই।

মর্যাদার আসন : প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, থ্যাইল্যান্ড, শ্রীলংকার নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে। এখন বাংলাদেশও মর্যাদার এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। নেপাল-ভুটান ন্যানো স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে মিয়ানমারও বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের কাজ শুরু করেছে।

সেবার পরিসর : ডিজিটাল ডিভাইড দূর করতে সবচেয়ে অধিকতর কার্যকার হবে স্যাটেলাইটি। বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অন্য দেশের স্যাটেলাইট থেকে কানেকটিভিটি কিনে ব্যবহার করছে। সেখানে নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহারে ওই কানেকটিভিটির অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। এছাড়া দুর্গম অঞ্চলে সাশ্রয়ী কানেকটিভিটি নিশ্চিতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বাধিক ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু-১।

আরকে// এআর


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি