ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

হাতিরঝিলের পরিবহন ব্যবসা

চলছে উৎকোচ আর বাটোয়ারার মহোৎসব

প্রকাশিত : ১৬:২৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৫৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হাতিরঝিল ঘিরে গড়ে উঠেছে জমজমাট এক পরিবহন ব্যবসা। প্রশাসনের কোন অনুমোদন ছাড়াই প্রাইভেট ও মাইক্রোবাসনামক পরিবহনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্র। সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে রাস্তায় চলছে ফিটনেসবিহীন ও নম্বরবিহীন গাড়ি। গাড়িগুলোতে সাময়িক পরিবহন সুবিধা পেলেও অতিরিক্ত ভাড়া আর জীবন ঝুঁকির অভিযোগ রয়েছে সাধারণ যাত্রীদের। অবৈধভাবে ও ফিটনেসবিহীন গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করায় বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি নিয়ে একাধিক মিটিংয়ের মাধ্যমে সব মহলকে বারবার বলা হচ্ছে। আশা করি এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনী মুখ খুলতে চাইছেন না। আবার পুলিশ বিষয়টি জানেন না বলেই এড়িয়ে যাচ্ছেন।এ অবস্থায় চলছে অবৈধ এ ব্যবসার টাকা ভাগবাটোয়ারার মহোৎসব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাতিরঝিল প্রকল্পের রামপুরা ও মেরুলবাড্ডা অংশ থেকে কারওয়ান বাজার পেট্রোলপাম্পের সামনে এবং সোনারগাঁও মোড়ের বিপরীত অংশ ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সামনে বটতলা মোড় থেকে রামপুরা ও মেরুলবাড্ডা পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করে প্রাইভেট, মাইক্রোবাস ও সিএনজি নামক এ পরিবহনগুলো। পরিবহনে যাত্রী উঠাতে সন্ধ্যার সময় এক প্রকার প্রতিযোগিতা ও নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যে পরিবহনে যাত্রী তুলতে এতো প্রতিযোগিতা সেই, দেখা যায় সে সব গাড়ীর বেশির ভাগেরই ফিটনেস নেই। মুড়ির টিনের মতো এসব মাইক্রোবাসের কোনোটির কাচ ভাঙা, কোনোটির বডি ভচকানো। দরজা লক হলে খুলতে হয় প্লাস ব্যবহার করে। গাড়ির ভেতরের সিটগুলো তুলে সেখানে বেঞ্চির মতো গদি পাতা হয়েছে। ছয় যাত্রী ধারণক্ষমতার একেকটি মাইক্রোতে গাদাগাদি করে টানা হচ্ছে ১৫ যাত্রী। অনেক সময় হাতিরঝিলের মাঝপথে অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এত সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও যাত্রীরা এসব গাড়ীতেই যাতায়াত করছেন।

কারওয়ান বাজার থেকে রামপুরা বা রামপুরা থেকে কারওয়ান বাজারের এ নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য আগে ভাড়া নেওয়া হতো ২০ টাকা। গত ঈদের সময় ঈদ বোনাসের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়ে রাখা হয়। যা পরে আর কমানো হয়নি। যাত্রীদের অভিযোগ এতোটুকু পথ যেখানে সময় লাগে মাত্র সাত থেকে ১০ মিনিট। সেই দূরত্বে ২৫ টাকা ভাড়া অনেক বেশি হয়ে যায়। দেখার কেউ নেই বলে সিন্ডিকেট চক্র ইচ্ছে মতো ভাড়া নিচ্ছে এবং ফিটনেসবিহীন এমন গাড়ি দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারওয়ান বাজার টু রামপুরা এবং রামপুরা টু কারওয়ান বাজারে প্রাইভেট ও মাইক্রোবাস নামক পরিবহনগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত যাত্রী বহন করে। সকালে রামপুরার বিটিভি ভবনসংলগ্ন এলাকা থেকে লাইন ধরে যাত্রী উঠায়। এ সময়ে কারওয়ান বাজার থেকে যাত্রী অপেক্ষাকৃত কম হয়। আবার দুপুরের পর থেকে শুরু হয়ে কারওয়ান বাজার টু রামপুরা মুখী যাত্রা। কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর বটতলা মোড় থেকে লাইন ধরে যাত্রী উঠানো হয়। রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা ও মাদারটেক এলাকার বাসিন্দাদের কাছে কারওয়ান বাজার যাতায়াতের জন্য এই সার্ভিসটি  পরিচিত।

মাইক্রোবাস মালিক সূত্রে জানা গেছে, এ রোডে সকাল-সন্ধ্যায় মোট ৩০টি মাইক্রোবাস চলে। একটি মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট গাড়ি দিনে ১৪ বার আপডাউন করতে পারে। একটি গাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জন যাত্রী পরিবহন করা যায়। একজন যাত্রীর ২৫ টাকা ভাড়া হিসেবে প্রতিদিন একটি গাড়িতে আট হাজার ৪০০ থেকে ৯ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। ৩০টি গাড়ীতে দিনে মোট আয় আসে দুই লাখ ৫২ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ ৯৪ হাজার টাকা। তবে মাঝে মাঝে খালি গাড়ি টানতে হয় বলে আয়ের পরিমাণ কম হয় বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাইক্রোবাসের মালিক। তার দাবি, দিনে একটি গাড়ী থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা আয় আসে। যার মধ্যে মালিক পায় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকা। আর ড্রাইভার পায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। ড্রাইভারের এ পারিশ্রমিক কারো কারো ক্ষেত্রে পার্সেন্টেস বা মোট আয়ের শতকরা হিসেবে দেওয়া হয়।

কয়েক মাস আগের চেয়ে এ মাইক্রোবাস মালিকদের লাভের অঙ্কটা এখন কম। কারণ এ পরিবহনের পাশাপাশি সম্প্রতি সিএনজিও চলছে এ রোডে। সিএনজিতে যাত্রী ওঠানোর কারণে মাইক্রোবাসে যাত্রী কমে যাচ্ছে। যার প্রভাবে আয়ও কম হচ্ছে মাইক্রোবাসে।

সূত্র জানায়, আগে মাইক্রোবাসের রমরমা এ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল মাসুদ ও তার  সহযোগী ফয়সাল, মিলন, রাজুসহ বেশ কয়েকজন সদস্যের হাতে। যারা দশ মালিক সমিতি নামেও পরিচিত। মাসুদের নেতৃত্বে এটা এতোদিন পরিচালিত হলেও সেই মাসুদকে এখন কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়ে এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলছে ফয়সাল, মিলন, রাজুসহ বাকীদের দখলে। সিন্ডিকেট চক্রটির এ পরিবহন ব্যবসায় সব মিলিয়ে প্রতি মাসে আয় হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা।

প্রাইভেট ও মাইক্রোবাসের এ সিন্ডিকেটের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে সিএনজি নিয়ন্ত্রণের আর একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য এ সিএনজি পরিচালনা করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে ২০টি সিএনজি এ রোডে যাত্রী পরিবহন করছে। যাদের ভাড়া মাইক্রোবাসের সমান। অল্প যাত্রী হলেই সিএনজি ভরে যায়, যাত্রীদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। তাই সময় বাঁচাতে এ সিএনজিতেই যাত্রীদের ঝোঁক বেশি। সিএনজিতে পরিবহন শুরু হওয়ার কারণে মাইক্রোবাসের আয় কমে গেছে বলেও জানায় মাইক্রোবাসের এক মালিক। তিনি জানান পুলিশের ওই সিন্ডিকেটের অনুমতি পাওয়া সিএনজি ছাড়া অন্য কোন সিএনজি এখান থেকে লোকালভাবে যাত্রী নিতে পারে না।

এদিকে প্রকল্প এলাকায় সেনা সদস্য, আনসার থেকে শুরু করে টহল পুলিশ থাকলেও এসব বিষয়ে কারও কোন স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ  পাওযা যায়নি। তবে রাজউকের হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রজেক্ট ডিরেক্টর জামাল আক্তার ভূইয়া বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন মিটিংয়ে কথা বলেছি। সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সমাধান টানবেন। বিষয়টি তারাই ভালো জানেন।

বিষয়টি নিয়ে কর্তব্যরত সেনা সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে, এ নিয়ে একেবারেই মুখ খুলতে নারাজ তারা। তারা বলছেন, উচ্চ পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তি ছাড়া মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। তবে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা মেজর সাদিকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চলমান মাইক্রোবাস বা হাতিরঝিল নিয়ে কোন অভিযোগ বা জানার থাকলে লিখিতভাবে দিতে হবে। আমি ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিব। তারপর এ বিষয়ে কথা বলবো।

রামপুরা পুলিশ প্লাজার সামনে এক আনসারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, অনৈতিক হলে কি হবে! পুলিশ দেখার পরেও তো কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রায় সব সময়ই যাত্রী পরিবহনে এ রাস্তায় মাইক্রো চলাচল করছে। যাত্রীদের ভোগান্তি কম হচ্ছে, ওপরে কিছু (উৎকোচ) পড়ছে, আবার সিন্ডিকেট চক্রও খাচ্ছে। সবার পাতে ঠিকঠাক মতো পড়ছে বলে অবৈধ বিষয়টিও বৈধতা পাচ্ছে।

জানা গেছে,  হাতিরঝিলের পাশের গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, রমনা, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্প থানাকে ম্যানেজ করে মাইক্রোবাস চলছে এ এলাকায়। এসব বিষয়ে প্রশাসনের মুখ বন্ধ করতে সিন্ডিকেট চক্রটি পার্শবর্তী এ ছয়টি থানাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারাও দিচ্ছেন। প্রতিটি থানায় মাসিক ২৫ হাজার টাকা বাজেট। তবে রামপুরা, গুলশান, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থানায় উৎকোচ একটু বেশিই দিতে হয়। না হলে  ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

থানাগুলোতে মাসোয়ারা দেওয়া হয় এমন অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে রামপুরা থানার ওসি প্রলয় কুমার শাহা বলেন, আমি এ উৎকোচের বিষয়টি জানি না। তবে অবৈধ মনে হলে নিউজ করে দেন। অ্যাকশান নেওয়া হবে, ট্রাফিকের মাধ্যমে গাড়িগুলো উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিরঝিলের একজন ড্রাইভার বলেন, মাইক্রোবাসগুলো বেআইনিভাবে চলছে বলেই নানা জনের কাছে নানাভাবে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়িও এ রোডে চলছে। আমি অবসর সময়ে এ রাস্তায় গাড়ি চালাই। নিজের দুটো গাড়ি চলাচল করে, তা দেখাশোনা করি। দিনে গড়ে আয় হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। বড় কথা যাত্রীদের অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। তাই তারা সন্তুষ্ট। এতে আমরাও সন্তুষ্ট।

মেরুল বাড্ডা সংলগ্ন এলাকায় হানিফ নামের এক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, কিছু করে খেতে হয়, তাই গাড়ি চালাই। না খেয়েতো থাকতে পারবো না। তবে এ রোডে গাড়ী চালানোর অনুমতি না থাকলেও আমরা চালাই এ কারণে যে, এতে যাত্রীদের ভোগান্তি কমে। আর আমরা তো বাড়তি কোন টাকা পায় না। যা  আয় করি তার সবই তো দিয়ে দিতে হয়। আমরা সাধারণ মানুষ পরিশ্রম করি তার টাকা পায় ওই কর্তারা।

 

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি