ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

বই থেকে নেওয়া

জাতির উত্থান

প্রকাশিত : ১৮:৪৫, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১১:৩২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

কোন জাতিকে যদি বলা হয় – তোমরা বড় হও, তোমরা জাগ- তাতে ভালো কাজ হয় বলে মনে হয় না। এক- একটা মানুষ নিয়েই এক-একটা জাতি। পল্লীর অজ্ঞাত-অবজ্ঞাত এক-একটা মানুষের কথা ভাবতে হবে।

মানুষকে শক্তিশালী, বড় ও উন্নত করে তোলার উপায় কী? তাকে যদি শুধু বলি – তুমি জাগ-আর কিছু না, তাতে সে জাগবে না। এই উপদেশ-বাণীর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত আছে। এইটে ভালো করে বোঝা চাই।

একটা লোক জাতীয় সহানুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার টাকা তুরস্কে পঠিয়েছিলেন। তিনি যখন অগণ্য আর্ত মানুষের বেদনা-কাহিনী গাইতে গাইতে ভিক্ষার ঝুলি স্কন্ধে নিয়ে পথে বের হতেন তখন প্রত্যেক মানুষের প্রাণ সহানুভূতি বেদনায় ও করুণায় ভরে উঠত। এই ব্যক্তি কিছুদিন পর তার এক নিরন্ন প্রতিবেশীর সর্বস্ব হরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। মানুষের এই ভাবের জাগরণ ও বেদনা – বোধের বেশি মূল্য আছে বলে মনে হয় না। কোনো জাতির যখন পতন আরম্ভ হয়, তখন দেশসেবক –যে কেউ থাকে না তা নয়। স্বাধীনতার মমতায় কেউ প্রাণ দেয় না, তা বলি না, যারা মন দেয় তাদের মন ভিতরে ভিতরে অন্ধ হতে থাকে। জাতিকে খাঁটি রকমে বড় ও ত্যাগী করতে হলে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে বড় ও ত্যাগী করতে হবে কী উপায়ে? দেশের মানুষের ভিতর আত্নবোধ দেবার উপায় কী? প্রত্যেক মানুষ শক্তিশালী-উন্নতহৃদয় – প্রেম-ভাবপন্ন-সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবন, অন্যায় ও মিথ্যার প্রতি বিতৃষ্ঞ হবে কেমন করে? জাতির প্রত্যেক বা অধিকাংশ মনুষ এই ভাবে উন্নত না হলে জাতি বড় হবে না।

প্রত্যেক মানুষের ভিতর জ্ঞানের জন্য একটা স্বাভিাবিক ব্যাকুলতা জন্মিয়ে দেওয়া চাই। সংসার এমনভাবে চলেছে., যাতে সকলের পক্ষে বিদ্যালয় বা উচ্চজ্ঞানের যোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। অথবা সারা ছাত্রজীবন ধরে বিদ্যালয়ে জ্ঞানলাভ করা হয়ে ওঠে না।

কেউ বাল্যে পিতৃহীন হয়, কারো পিতা জ্ঞানালোচনাকে বিশেষ অবশ্যক কাজ মনে না করে ছেলেকে স্কুলে পাঠান না, কেউ পাঠাভ্যাসকালে উদ্ধত ও দুর্মতি হয়ে পাড়াশোনা ত্যাগ করে , কেউ বিদেশি ভাষার নিস্পেষণে বোকা ভেবে পড়াশোনা বাদ দেয়।

পাঁচ হাজার ছাত্রের মধ্যে পঞ্চাশজন ছারা বাকি সব ছেলেই সময়ে ঘ্গানান্ধ, হীন ও মৌন মূক হয়ে যায়। ইহা জাতির পক্ষে কত ক্ষতির কথা।

মনুষ্যত্ব লাভের পথ জ্ঞানের সেবা। জীবনের সকল অবস্থায়-সকল সময়ে – আহার স্নানের মতো মানুষের পক্ষে জ্ঞানের সেবা কারা প্রয়োজন।

উন্নত,ত্যাগী,শক্তিশালী,প্রেমিক,সত্য ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবন মানুষ বিদ্যাহীন বা অল্পশিক্ষিতি মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না। মানুষের বা জাতিকে বড় হতে হলে বস সময়ই তাকে জ্ঞানের সেবা করতে হবে।

দেশের সকল মানুষকে জ্ঞানী করে তোলার উপায় কী? জাতির জীবনের মেরুদন্ড ও জ্ঞান। এই দুটি চাপা রেখে জাতিকে জাগতে বললে সে জাগবে না।

বুদ্ধির দোষে হোক বা অবস্থায় চক্রে হোক, কোনো দেশে যদি বহু মানুষ অশিক্ষা অল্পশিক্ষা বশত অমার্জিতচিত্ত এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন হয়ে পড়ে তাহলে সে জাতির জীবন টেকসই হবে না। এই সব লক্ষ মৌন অত্নায় স্পন্দন আনবার এক উপায় আছে, কোটি বদ্ধ মুখে ভাষা তুলে দেবার এক পন্থা আছে। সকল দেশে সকল সময়ে সেই পন্ধা কার্যকরী হয়ে থাকে। সেই পন্টধা না থাকলে কোনো জাতি বাঁচত না-উন্নত হওয়া স্বল্প অপেক্ষা অসম্ভব হত।

জাতিকে শক্তিশালী করতে প্রত্যেক সময়ে মানুষ এই পন্ধা অবলম্বন করেছে। গ্রিক জাতি, রোমান জাতি, বর্তমান ইউরোপীয় জাতি-এই পথকে অবলম্বন করে শেষ্ঠস্থান অধিকার করেছেন।

যারা এই পথকে অবহেলা করে নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা কর, তারা একটা অসম্ভব কাজ আরম্ভ করে।

এই পথ আর কিছু নয় –দেশের বা জাতির সাহিত্যের পুষ্টিসাধন। যে সমাজে সাহিত্যের কোনো আদর নাই তাহা সাধারণত বর্বর-সমাজ। কথা কাগজে ধরে অসংখ্য সনুষের দৃষ্টির সম্মুখে ধরার নাম সহিত্য-সেবা। এই যে কথা এ কথা সাধারণ কথা নয়,এই কথার ভিতর দিয়ে জীবনের সন্ধান বলে দেওয়া হয়, পুণ্যের বানী ও মোকেষর কথা প্রচার করা হয়।, বর্তমান ও অন্মি সুখের দ্বার মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই কথার ধারা গান ও গল্প , কখনও কবিতা ও দশূন, কখন ও প্রবন্ধ ও বিঞ্গানের রুপ নিয়ে মানুষের সম্মুখে রঙিগন হয়ে ,মধুরভাবে দেখা দেয়।

দুর্গত কন্টাকাকীর্ণ আধাঁর পথে কেউ যদি প্রদীপ না নিয়ে চলতে থাকে কিংবা আলোর যে আবশ্যকতা আছে , এ কথা উপহাসের সঙ্গে অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কী বলা যায়?

কোনো জাতি সহিত্যেকে অস্বিকার বা অবহেলার চোখে দখে উন্নত হতে চেষ্টা করলে সে জাতি উদেও উন্ন হবে না।

শিক্ষিতকে আর শিক্ষিত, ভাবুককে আর ওগভীর করবার জন্য, দেশের অশিক্ষিত শিক্ষাকেন্দ্রের বাহিরের লোক গুলিকে শক্তিলঅলী, জ্ঞানী ও মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন করবার জন্য পথপ্রদর্শক তারাই। তারাই জাতি গঠন করেন। গ্রিস, আরব,হিন্দও ও ইউরোপীয় শক্তি সভতার জন্মদাতা তারাই।

প্রত্যেক দেশের সাহিত্যের ভিতর দিয়া এইসব শিক্ষিতশ্রেণী জাতিকে উর্ধে টেনে তোলেন। ক্ষুধাতুর আর্ত তাদের স্পর্শে রাজা হয়ে ওঠে, পল্লির কৃষক, দূর অজ্ঞাত-কুটিরের ভিখারি, জমিদারের ভৃত্য, দরিদও গো- যান চালক, অন্ধকারের পাপী , বাজারে দরজি, নগরের ঘড়ি, নির্শাতা, নাবাবের, ভৃত্য, গ্রাম্য উরুটে যুবক শ্রেনী তাদেরই মন্ত্রে মাহপুরুষ হয়।

এই মন্ত্র গ্রহণ করাবার উপযোগী তাদের কিছু শক্তি অর্থাৎ কিছু বর্ণ জ্ঞান থাকা চাই। এরাই জাতির মেরুদন্ড ছোট বলে এদিগকে অস্বীকার করলে জাতি প্রাণ শক্তিহীন হয়ে পড়ে।

জাতিকে শক্তিশালী , শ্রেষ্ঠ , ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও কঠিন ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কার্য সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দুষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটা জাতির মানসিক ও পার্থিব পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুস্ংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে একটা  বিনয়মহিমোজ্জল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে। মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই সে ধর্ম মনে করে, আত্নমর্যাদা জ্ঞান সম্পন্ন হয় এবং গভীর পুষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট শক্তি জেগে ওঠে।

ইংরাজের বিরাট শক্তির অন্তরালে বহু লেখকের লেখনী শক্তি আছে। বস্তত লেখক বা জগতের পন্ডিতবৃন্দ র্নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে বিশ্বের সকল অনুষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে গতি প্রদান করেন। তাদের অজানা হস্তের কার্য ফলে অসংখ্য মানুষ মরুভূমে সাগর রচনা করেন, সাগরবক্ষে পাহাড় তোলেন- জগৎ সভ্যতার নির্মাতা হারাই।

কোনো দেশের মানুষ যদি এই লেখক শ্যেণীর বা দেশীয় সাহিত্যের প্রতি প্রদ্ধা পোষণ না করে তবে তারা বড় হীন। জাতির ভিতরকার সকল পন্ডিতকে হত্যা কর- সমস্ত জাতিটা শক্তিহীন হয়ে পড়বে।

কোনো সভ্য জাতিকে অসভ্য করবার ইচ্ছা যদি তোমার থাকে তাহলে তাদের বইগুলি ধ্বংস কর, সকল পন্ডিতকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

লেখক, সাহিত্যিক ও পন্ডিতরাই জাতির আন্তনা। এই আত্নাকে যারা অবহেলা করে, তারা বাঁচে না।

দেশকে বা জাতিকে উন্নত করতে ইচ্ছা করলে সাহিতৌর সাহায্যেই তা করতে মানব মঙ্গলের জন্য যত অনুষ্ঠান আছে, তার মধ্যে এইটিই প্রধান ও সম্পূর্ণ।

জাতির ভিতর সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি কর, আর কিছুর আবশ্যক নাই।

কোনো দেশকে সভ্য ও মানুষ করবার বাসনা তোমার আছে? তাহলে বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যকে উন্নত করতে তুমি চেষ্টা কর।  মাতৃভাষার সাহায্য সাহিত্যকে উন্ন করতে চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি সাহিতৌ মানব- সাধারণের কোনো কলৗাণ হয় না।দেশীয় সাহিত্যকে উন্ন করতে হবে, আবার বিশ্বের উন্ন সাহিত্যের সার সংগ্রহ করতে হবে। নিজেদের যা কিছু আছে তাতেই সন্তষ্ট থাকলে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

সহিত্যের শক্তিতে দেশের প্রত্যেক মানুষ শক্তিশালী মহাপুরুষ হতে পারে। মানুষের সমল বিপদের মীমাংসা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই হয়ে থাকে। জাতি যখন দৃষ্টিসম্পন্ন ও ঞ্গনী হয়, তখন জাগবার জন্য সে কারো আহ্বানের অপেক্ষা করে না, কারণ জাগরণই তার স্বাভা।।

 

**লেখাটি ডা. লুৎফুর রহমানের উন্নত জীবন গল্পগ্রন্থ সংকলিত।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি