ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

একশনএইডের গবেষণা

নারীরা সেবামূলক কাজের অর্থনৈতিক মূল্য পান না

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৪৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২১:০৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশের একজন নারী প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা সেবামূলক কাজ করলেও তার পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন পান না। কারণ দেশের নীতি ও আইনে নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও পুনর্বণ্টনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন এখনও অনেক দূরের বিষয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর নীতি পর্যালোচনা করে এমন তথ্য উপস্থাপন করেছে একশনএইড বাংলাদেশ।

যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তাদের ওপর গৃহস্থালীর সেবামূলক কাজের অসম চাপ। সরকারের নীতি ও আইনে সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির জন্য সুনির্দিষ্ট কোন উদ্যোগ নেই। ফলে ঘরের কাজকে শুধু নারীর কাজ হিসেবে দেখা হয়। এমনকি ঘরের কাজকে কাজ হিসেবেই ধরা হয় না।

শনিবার ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে “দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ: নীতি পর্যালোচনা” নামের প্রতিবেদনটি তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে নীতি ও আইনে নারীর সেবামূলক কাজের বিষয়টি কিভাবে আছে সেটি দেখা হয়েছে।

একশনএইড এই নতুন গবেণায় দেখতে চেয়েছে, ঘরের সেবামূলক কাজের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন কেন হচ্ছে না। যেহেতু একটি দেশের যে কোন সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের নীতি ও আইনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেকারণে  গবেষণাটি করতে গিয়ে একশনএইড দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের বিভিন্ন নীতির পর্যালোচনা করেছে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার মো. হেলাল উদ্দিন। প্রতিবেদনটি করতে গিয়ে দেশগুলোতে নারীরা কি পরিমাণ কাজ করেন সেটিও দেখা হয়েছে। নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতে নারীরা ঘরে সেবামূলক কাজে কি পরিমাণ সময় দেন, যার মূল্যায়ন হয় না, তার জরিপ করা হয়। একশনএইড-এর পাওয়ার প্রকল্পের আওতায় করা এই গবেষণায় দেখা যায়, নেপালের নারীরা গৃহস্থালীর সেবামূলক কাজে দৈনিক ৬.৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। বাংলাদেশের নারীদের প্রতিদিন ৬.৩ ঘণ্টা সময় দিতে হয় সেবামূলক কাজে। আর ভারতের নারীরা ব্যয় করেন দৈনিক ৫.১ ঘণ্টা। যেখানে এই কাজে পুরুষরা সময় দেন যথাক্রমে নেপাল ২.২ ঘণ্টা, বাংলাদেশ ১.১ ঘণ্টা এবং ভারতে মাত্র ০.৪ ঘণ্টা। এই বিষয়ে পাকিস্তানের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

আইএলও-এর মানদণ্ড অনুযায়ী একজন ব্যক্তির সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা কাজ করার কথা। কিন্তু এই তিন দেশের জরিপ বলছে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সময় কাজ করছে, এজন্য তারা সময় সংকুলানের চাপে পড়ছে। এ কারণে নারীরা ঘুম, বিশ্রাম বা ব্যক্তিগত সেবার জন্য কম সময় পাচ্ছে।

গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান গবেষক ড. সিমিন মাহমুদ বলেন, এমনিতেই নারীরা ঘরের অনেক কাজ করেন। পাশাপাশি আরও অনেক কাজ করতে হয় তাদের। গবেষণা বলছে, সবমিলিয়ে পুরুষের চাইতেও বেশি কাজ করেন নারীরা। ফলে ঘরের কাজ নিয়ে অসম চাপে পরেন নারীরা। যা তাদেরকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয় নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের অনেকগুলো নীতি ও আইন আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ  জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, জাতীয় শ্রমিক নীতি ২০১২, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি। এই নীতিগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে পরিবারের সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও পুনর্বণ্টনের কোন বিষয় নেই। যা নারীর ক্ষমতায়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। আবার রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক দলিল বাজেট কিংবা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাপকাঠি ডিডিপিতেও সেবামূলক কাজের বিষয়ে স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন নেই। ফলে ঘরে যখন একজন নারী অমূল্যায়নের শিকার হন, তখন তার আর যাবার কোন জায়গা থাকে না।

একশনএইড বাংলাদেশ-এর পর্যবেক্ষণে বেড়িয়ে আসে, তৃণমূল নারীরা যখন মজুরী ভিত্তিক শ্রমে প্রবেশ করে তখন তাদেরকে দ্বিগুন কাজের চাপ মোকাবিলা করতে হয়। তাদেরকে গৃহস্থালীর কাজ, শিশু ও বয়স্কদের সেবা এবং মজুরী শ্রমের দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জ সম্মুখীন হতে হয়।  এক্ষেত্রে নারী ও কিশোরীরা তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সুসম কাজ ও বিশ্রামের সময় ইত্যাদি মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত হন। গৃহস্থালীর সেবামূলক কাজে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে বাংলাদেশের নারীরা নিরাপদ ও সম-মজুরীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না।

গবেষণার প্রতিবদন ও পরিবারে নারীর সেবামূলক কাজ নিয়ে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, আমরা গৃহস্থালীর কাজকে সম্মান করি না এবং ধরে নেওয়া হয় যে এটা নারীর কাজ। এমনকি আমরা মনে করি এসব কোন কাজই না। অর্থনীতিতে স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে সমাজে এবং পরিবারে এই কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে না। একদিকে নারী পরিবার বা সমাজে তার কাজের মূল্যায়ন পান না। অন্যদিকে রাষ্ট্র তার নীতি ও আইনে মূল্যায়নের বিষয়টি উপেক্ষা করছে। ফলে নারীরা ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনিন আহমেদ বলেন, নারীর ঘরের সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন ও র্স্বীকৃতি না থাকায় তার ক্ষমতায়নের পথে বাঁধা তৈরি হচ্ছে। তাই এই কাজের একটা আলাদা হিসাব করতে হবে এবং সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট। যাতে সমাজে বা রাষ্ট্রে তার মূল্যায়ন করা যায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও নারীদের দেখানো হয়েছে গৃহস্থালী কাজ করার মূল ব্যক্তি হিসেবে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলে মেয়েদের পড়ানো হয় গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং ছেলেদের পড়ানো হয় কৃষি ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন লিঙ্গ বৈষম্য করা ঠিক না”।

গবেষণায় পরিবারের সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়নে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান সার্ক, ইউনেসক্যাপ ও ইফাদ-এর বিভিন্ন নীতি কাঠামোসমূহের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সার্ক এর বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সার্ক ও ইউএন উইমেন-এর মধ্যে সম্মতি স্মারক চুক্তি, সার্ক সামাজিক চার্টার, সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ, সার্ক জেন্ডার পলিসি এ্যাডভাইজরি গ্রুপ ইত্যাদি। যেগুলো নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গৃহস্থালীর সেবামূলক কাজের নেতিবাচক প্রভাবকে উপেক্ষা করেছে।

অনুষ্ঠানে সার্ক ও বিমসটেক-এর মহাপরিচালক মো. শামসুল হক বলেন, সার্ক-এর বেশ কিছু নীতিতে নারী উন্নয়নের কথা বলা আছে। তবে নারীর ঘরের কাজের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট উদ্যোগ দরকার। তা না হলে তারা পিছিয়ে পড়বে। এজন্য সামাজিক আন্দোলন করা দরকার। এটা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করা উচিত। যেখানে সরকারকে নীতি ও আইনের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে হবে। নারী উন্নয়নে যাতে দক্ষিণ এশিয়াকে নেতৃত্ব দিতে পারি সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে।

সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, পুরুষদের বুঝতে হবে যে, এটা আমারও সংসার, এখানে আমারও কাজ করার আছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকারি পর্যায়ে স্বীকৃতি দিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার জাতীয় পর্যায়ে কৃষির যে উন্নয়ন হয়েছে তার অনেকাংশে নারীর অবদান রয়েছে। নারীরা পিছিয়ে নেই। তাই আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা উচিত।

গবেষণায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, নারীর গৃহস্থালির সেবামূলক কাজকে স্বীকৃতি, হ্রাস এবং পুনর্বণ্টনের বিষয়কে আঞ্চলিক নীতি-কাঠামো এবং জাতীয় নীতিসমূহে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে; যেমন জিডিপিতে এই শ্রমকে বিবেচনায় আনা। কাজসমূহ পুনর্বণ্টনের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে নারীবান্ধব কিছু সেবা যেমন- শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের পরিচর্যার বা সেবার বিনিময় বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান, নবায়নযোগ্য জ্বালানীসহ রান্নার প্রযুক্তি প্রণয়ন, স্বাস্থ্য সেবা, পানি-স্যানিটেশন-পরিচ্ছন্নতা সেবা প্রদান ইত্যাদি।

সুপারিশে আরও বলা হয়, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর পরিচয়কে যে সব আন্তঃসম্পর্কীয় বিষয় প্রভাবিত করে সে বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের আইন ও নীতিতে যুক্ত করা দরকার। এজন্য এমন কৌশল/পদক্ষেপ নিতে হবে যা গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ, নারী নির্যাতন, জলবায়ু সহনশীল টেকসই কৃষি চর্চা এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের আন্তঃসম্পর্ককে নিয়ে কাজ করবে। এছাড়া সরকারকে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীর শারীরিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। নারীদের জন্য নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ, নির্যাতন ও যৌন নিপীড়ন মুক্ত অবস্থা, তার চলাফেরা ও অংশগ্রহণে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

 

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি