ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

নোংরার বদলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০৯, ১৯ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ১১:০১, ২১ জুলাই ২০১৭

দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, পিরিয়ডকালীন সময়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না থাকা, সাবান না থাকা কিংবা অনেক সময় পানি থাকা— এগুলো হচ্ছে দেশের বেশিরভাগ স্কুলের টয়লেটের চিত্র। তবে এর বিপরীতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ‍পৃথক ব্যবস্থা, সঙ্গে মেয়েদের জন্য পিরিয়ডকালীন সুন্দর ব্যবস্থাপনা রাখা হয়েছে রংপুর বিভাগের ৬৪ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত নতুন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটে।

‘ওয়াশ ইন স্কুল’ প্রকল্পের আওতায় রংপুর বিভাগের সব কটি উপজেলায় অন্তত একটি করে আধুনিক টয়লেট নির্মাণ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড।

রংপুরের তারাগঞ্জের বরাতী উচ্চ বিদ্যালয়। যেখানে দুটি পৃথক নোংরা টয়লেটের স্থানে নির্মিত হয়েছে পানি ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা পাকা দালান। ছাত্রীদের জন্য নির্মিত টয়লেটে পিরিয়ডকালীন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে রাখা হয়েছে বসার ব্যবস্থাও।

এমন স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মিত হওয়ায় খুশি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যেখানে ৬২৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশিই ছাত্রী।

স্কুলের সহকারী গ্রন্থাগারিক মমতা রায় বলেন, আগের নোংরা টয়লেটের স্থানে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বসার সুন্দর জায়গা আছে। নোংরা না করে পরিচ্ছন্নই রাখছে সবাই। আর আগে নোংরা টয়লেটের কারণে পিরিয়ডের সময় ছাত্রীরা স্কুলে আসতে চাইত না।

ওয়াটারএইডের এই কাজে স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা দিয়েছে রংপুর বিভাগেরই চারটি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিও, সলিডারিটি, এমজেএসকেএস ও এসকেএস।

ইউএসএইএডের পরিষ্কার টয়লেট পেয়েছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর মাঝেরহাট বালিকা দাখিল মাদ্রাসাও। দুইটি কক্ষের নোংরা টয়লেটের জায়গায় সেখানে স্থাপন করা হয়েছে শিশু ও প্রতিবন্ধীবান্ধব এবং মাসিক ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন পরিষ্কার টয়লেট।

এর ফলে আড়াইশ’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভোগান্তির অবসান হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের সুপার আবু সালেহ শেখ মো. জিকরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, বলেন, “দুই চেম্বারের টয়লেট ছিল আগে আমাদের। এখন সেখানে বড় আকারের টয়লেট হয়েছে। রিফ্রেশ রুম, সবার জায়গা, বেসিন, র‌্যাক সবই আছে এর ভেতরে। আলাদা যে মাসিক ব্যবস্থাপনা ছিল, সেটা তো আগে কল্পনাও করতাম না আমরা।”

মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যাপকিন, প্যাডসহ বিভিন্ন জিনিস থাকায় ছাত্রীরা অনেক ভোগান্তি থেকে মুক্ত হয়েছে বলে জানান মাদ্রাসার শিক্ষক রুমানা আক্তার।

তিনি বলেন, আগে প্রতিদিন দুই-তিনজন করে ছাত্রীকে ক্লাস চলাবস্থায় ছুটি দিতে হতো। যারা ছুটি নিয়ে গিয়ে ৪-৫ দিন মাদ্রাসায় আসতে পারত না। এখন এমন পরিস্থিতি আর নেই।  

সম্প্রতি রংপুর তারাগঞ্জের ও/এ দ্বিমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে নতুন নির্মিত টয়লেট পরিদর্শন করেন  ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি স্বাস্থ্যসম্মত এ ধরণের টয়লেট দেখে অভিভূত হন।

পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি সত্যি অভিভূত হয়েছি। আমার এলাকাতে এই রকম স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা হয়েছে।

স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের সঙ্গে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থায় সন্তোষ জানালেও প্রতিবন্ধীদের সুবিধায় হাইকমোডের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেন ডেপুটি স্পিকার।

তিনি বলেন, তারা (প্রতিবন্ধী) এখন স্কুলে একজন থাকুক, কিংবা ভবিষ্যতে আসুক, ব্যবস্থাটা করে রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইজলাইন সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী, দেশের স্কুলগুলোর তিন ভাগের দুইভাগ টয়লেটের ভেতরে বা কাছাকাছি সাবান বা পানির ব্যবস্থা নেই। ১৮৭ জনের জন্য একটি মাত্র টয়লেট, যেগুলোর ৪৫শতাংশ নানা কারণে তালাবদ্ধ থাকে।  মাত্র ২২ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট আছে, যার কোনটিরই মাসিক ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নেই।  মাসিক চলাকালীন ৪০ শতাংশ স্কুলছাত্রী গড়ে মাসে ৩ দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।  মাত্র ৬ শতাংশ স্কুলে মাসিক সম্পর্কে পড়ানো হয়। ৩১ শতাংশ স্কুলছাত্রী মনে করে, মাসিকের কারণে স্কুলে তাদের স্বাভাবিক লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে। ৮৬ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। মাত্র ১২ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় পরিষ্কার পানি ও সাবান দিয়ে ধোয় এবং শুকিয়ে নেয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় ৮৬ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় স্কুলে তাদের ব্যবহৃত কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড বদলাতে পারে না।

আধুনিক টয়লেট পাওয়া ৬৪টির বাইরে বাকিদের অবস্থা খারাপ বলে জানিয়েছেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়াটারএইডের কর্মকর্তারা; সরকারি গবেষণায়ও উঠে এসেছে এমন তথ্য। 

রংপুরের তারাগঞ্জের নতুন চিকলী বাজারের ফাজিলপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়; ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট থাকলেও সেটার অবস্থা অনেকটা নাজুক। নোংরা পরিবেশের এই টয়লেটের একটির ভেতরে আগে নলকূপ থাকলেও দীর্ঘদিন নষ্ট পড়ে আছে; দুই টয়লেটের কোনোটিতে পানির ব্যবস্থা না থাকায় বাইরের নলকূপ থেকে পানি ব্যবহার করতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, এই টয়লেট দুটির কোনোটি স্বাস্থ্যসম্মত না, পরিবর্তন দরকার। আমরা সুইপার দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। কিন্তু এত অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর কারণে সেটা পরিষ্কার রাখা কতটুকু সম্ভব?

স্কুলের মোট ৬৬২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৬২ জন ছাত্রীকে এত অল্প জায়গার কারণে বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকায় ভোগান্তির মুখে পড়ার কথা জানালেন স্কুলটির দশম শ্রেণির ছাত্রী সান্ত্বনা আক্তার; গ্রামীণ এলাকার এই স্কুলে সরকার নজর নেই বলেও ক্ষোভ ঝরে তার কণ্ঠে।

তিনি বলেন, লাইন ধরে টয়লেটে যেতে হয়। ভেতরে পানি নাই। বাইরে থেকে কোনোমতে পানি নিয়ে গিয়ে ভালোমতো পরিষ্কার না করে সেই হাতে টিফিন খাই আমরা। মাসিকের সময় এই সমস্যার সম্মুখীন বেশি হতে হয় বলে জানান শিরীন আক্তার।

ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে ওয়াটারএইডের কর্ম এলাকায় পরিচালিত জরিপ অনুসারে- ৫১ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে, ৩৪ শতাংশ ছাত্রী স্কুল চলাকালীন স্কুলেই প্যাড বা কাপড় বদলায়, ৮৪ শতাংশ স্কুলছাত্রী তাদের স্কুল ল্যাট্রিনের মধ্যে প্রশস্ত জায়গা, পর্যাপ্ত আলো এবং ব্যবহৃত প্যাড বা কাপড় ফেলার মতো ব্যবস্থা আছে বলে উল্লেখ করেছে, ৭৯ শতাংশ স্কুলছাত্রী মনে করে স্কুলে মাসিক বিষয়ে আরও আলোচনা বা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত, ৩২ শতাংশ স্কুলছাত্রী বলেছে, স্কুলে নারী শিক্ষকেরা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যায়গুলো নিয়মিত পড়ান।

নেকির হাট সৈয়দপুর দাখিল মাদ্রাসার ২৪৭ শিক্ষার্থীর জন্য আর তাদের শিক্ষকদের জন্য আছে মাত্র একটি টয়লেটের ব্যবস্থা; দুটির একটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট থাকায় এখন তালাবদ্ধ।

নোংরা টয়লেট ছাত্রীদের বেশি যন্ত্রণা দেয় বলে জানায় মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রোমানা আক্তার; অনেক সময় লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় শিক্ষক এলে পড়তে হয় বাড়তি বিড়ম্বনায়।

শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে ছাত্রীদের ঋতুকালীন যন্ত্রণা ও ক্লাস অনুপস্থিতি কাছ থেকে দেখেন প্রতিষ্ঠানের একমাত্র নারী শিক্ষক খালেদা বেগম। ওই সময়টাতে ছাত্রীদের ভালো ব্যবস্থাপনা দিতে না পারায় মনোকষ্টের কথা উঠে আসে তার বক্তব্যে।

তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা নাই। মাসিকের সময় দেখা যায়, তারা ছুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। এতে তাদের পড়ালেখায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে।

রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে নির্মিত স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণের খরচ ওয়াটারএইড বহন করলেও সেটার ব্যবস্থাপনার খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্বাহের কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রথমে নির্মাণের সময় ১০ থেকে ২০ শতাংশ স্কুল ম্যানেজমেন্ট থেকে নিয়েছি। সে টাকাটা নিয়ে আমরা নির্মাণে খরচ করে ফেলিনি। ওইখানে আমরা তহবিল রেখে আসছি। যাতে ওই তহবিলটা ব্যবহার করে ক্লিনিং ও ব্যবস্থাপনার খরচ স্কুলই বহন করতে পারে।

তারাগঞ্জের লক্ষ্মীপুর মাঝেরহাট বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার জিকরুল ইসলাম জানান, তার প্রতিষ্ঠানের টয়লেট নির্মাণ ব্যয় ৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা দিয়েছে ওয়াটারএইড। আর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ৯৬ হাজার টাকার রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল গঠন করেছে। এভাবে ব্যবস্থাপনা ব্যয় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া সারাদেশের জন্য মডেল হিসাবে দেখানোর চেষ্টা ওয়াটারএইডের ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি