ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভার্চুয়াল ভাইরাসের আসক্তিতে বিপর্যয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:০৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৪১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পৃথিবীর তিন ভাগ মানুষের এক ভাগই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। অভ্যস্ততার এই অবস্থা অনেক সময়ই পৌঁছে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। আর এর একটা ব্যাপক প্রভাব পরছে সমাজে; আমাদের ব্যক্তি জীবনে। গবেষকরা এই ভার্চুয়াল আসক্তিকে বলছেন ‘ভার্চুয়াল ভাইরাস’। আসক্তির দিক থেকে একজন মাদকাসক্ত আর একজন অনলাইন আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

ডিজিটাল কোকেন

অনলাইন আসক্তিকে মনবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল কোকেন’। নতুন কোন নোটিফিকেশন, চ্যাট মেসেজ অথবা মেইলের জন্য একটু পর পরই অনলাইনে ঢু মারছেন এই কোকেনে আসক্ত ব্যক্তিরা। ফেসবুক যারা ব্যবহার করেন তাদের অনেকেই বলেছেন একটু পর পর তাদের ফেসবুকে ঢুকে দেখতে ইচ্ছে করে নতুন কোন নোটিফিকেশন আসল কী না? আর একবার ঢুকলে কীভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায় তা যেন তারা টেরই পান না!

ব্রেইন স্ক্যান ফলাফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি আর অনলাইন আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়। তাদের মধ্যে মস্তিষ্কের একই রকমের ছবি দেখা গেছে। দুদলের মানুষেরই মস্তিষ্কের সামনের দিকের হোয়াইট ম্যাটারগুলো ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখা যায় ব্রেইন স্ক্যানে।

মানুষের আবেগ, মনযোগ আর সিদ্ধান্তগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইনের এই হোয়াইট ম্যাটার অংশ। আর তা ক্ষয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে এই ক্ষমতাগুলোই দিন দিন কমে যাচ্ছে। কাজেই সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার আমাদের আবেগকে ভারসাম্যহীন করতে পারে। নষ্ট করতে পারে আমাদের মনযোগ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্যকে।

মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরণের কেমিক্যাল নিঃসরণ ঘটে প্রতি মুহুর্তে। কিন্তু হঠাৎ যদি এমন কিছু ঘটে যা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো তখন আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় এই ডোপামিনের প্রবাহ এবং ভালোলাগাকে আরও বাড়াতে ব্রেইন তখন ঐ কারণটাকেই বাড়াতে বলে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই ডোপামিন এবং ভাললাগার সাময়িক এই অনুভূতিকে ক্রমাগত বাড়াতে চাওয়া; এটার নামই আসক্তি।

মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “সত্যিকারের মাদকাসক্তির সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আসক্তির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।”

মনযোগের ক্ষমতা নষ্ট

কেউ কেউ মনে করেন কাজের মাঝে একটু পর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢু দিলে দক্ষ মাল্টি টাস্কার হয়ে ওঠা যায়। ধারণাটি সম্পূর্ণরুপে ভুল। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশন আর মাল্টি টাস্কিং দুটি দুই জিনিস।

গবেষণায় দেখা গেছে, খুব বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যে মানুষেরা, একাধিক কাজে দক্ষতা তাদের অন্যদের চেয়ে কম। বরং তাদের মনযোগ এত বেশি বিক্ষিপ্ত যে এর ফলে তাদের স্মৃতিশক্তিও লোপ পাচ্ছে অন্যদের চেয়ে দ্রুত।

ফ্যান্টম ভাইব্রেশন

মাঝে মাঝে আমাদের মনে হয় যে, আমাদের সাথে থাকা মুঠোফোনটি হয়তো বেজে উঠল। অথবা পকেটে থেকে ভাইব্রেশন দিল। কিন্তু মুঠোফোনটি হাতে নেওয়ার পর দেখা গেল আদতে কোন ফোন আসেনি। তবে এই রকম মনে হওয়াকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ফ্যান্টম ভাইব্রেশন। আর যারা এধরনের অনুভূতি অনুভব করেন তারা এই ফ্যান্টম ভাইব্রেশন অথবা ভৌতিক কল সিনড্রোমে আসক্ত।

গবেষকেরা এর কারণ হিসেবে বলছেন, অধিক সময়ে মোবাইল ফোনের অতি ব্যবহার মস্তিষ্কের ভেতরে যে হেলোসিনেশন তৈরি করেছে তাই এই ফ্যান্টম ভাইব্রেশন অনুভূতির কারণ।

একটা জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যত জন ছাত্রছাত্রীকে এই অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে তাদের ৯০ শতাংশেরই এই ফ্যান্টম ভাইব্রেশনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।   

স্মার্টফোন আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, একটু পর পর নিজের অজান্তেই মোবাইল হাতে তুলে নেই দেখার জন্য যে কেউ এসএমএস দিল বা মেইল করল কী না? বা সোশ্যাল মিডিয়াতে নতুন কিছু এল কী না?

আত্মকেন্দ্রিকতা

শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তবতা যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই আমাদেরকে অসামাজিকই করে তুলছে।  অন্তত গবেষকদের ধারণা এমনই। আমাদেরকে করছে বিচ্ছিন্ন আর স্বার্থপর। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষের সাথে কথা বলে তখন ৩০ থেকে ৪০ ভাগ নিজের বিষয়ে কথা বলে। কিন্তু একজন মানুষ যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলে তখন ৮০ ভাগ সময়ই নিজের ব্যাপারে কথা বলে।

এ বিষয়ে মনবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা সবাই কম বেশি সেলফি তুলি। সামাজিক মেলবন্ধনে এর দরকারও আছে। কিন্তু তা যখন অসচেতন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে করা হয় তখন তা এক ধরনের মানসিক রোগ। এ ধরনের মাত্রাতিরিক্ত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সেলফি তোলার রোগের নাম হচ্ছে-স্যালিফাইটিস”।

আর এ ধরণের সেলফি তোলার প্রবণতা থাকা ব্যক্তিরা অন্যদের থেকে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয় বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “মূলত আমাদের মধ্যে অনেকেই আমরা আত্মপ্রেম বা আত্মতুষ্টিতে ভুগি। আমরা যেখানেই থাকি না কেন সেখানেই নিজেকে বড় করে উপস্থাপন করতে চাই। এতে আশপাশের মানুষেরা কে কী ভাবল অথবা তাদের ওপর কী প্রভাব পরল তা আমলে নেই না। আমরা বুঝে উঠতে পারি না যে কোথায় কখন কী করা যায় আর যায় না। এ ধরনের মানসিকতার যারা আছেন তাদের মধ্যেই এমন সেলফি তোলার প্রবণতা বেশি”।

স্বপ্নভঙ্গ

আমরা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিচয়, তা থেকে প্রেম বা পরিণয়ের কথা শুনি। কিন্তু এদের একটি বড় অংশই সম্পর্কটা আর টিকিয়ে রাখতে পারে না স্বপ্নভঙ্গের কারণে। কারণ ভার্চুয়াল জগতের মানুষ আর রক্তমাংসের মানুষ বেশিরভাগ সময়ই এক হয় না।

অনলাইনে যে তরুণকে অসাধারণ প্রেমিক পুরুষ মনে হয়েছিল বাস্তবে তাকে বদমেজাজী, হিংসুটে সঙ্গী হিসেবে আবিষ্কার করা খুব বিচিত্র কিছু নয়। তেমনি অপসারদের মত দেখতে ফেসবুকের আকর্ষণীয় তরুণীটিও যে বাস্তবে এমন হবে তা কে নিশ্চয়তা দিতে পারে?

শুধু প্রেম-ভালবাসাই নয় বরং পরকীয়া অথবা পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি হওয়ার মত অসামাজিক কার্যকলাপের অন্যতম মূল কারণ এই সাইবার জগত। মনবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, “একটু গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাব যে, একটি ছেলে একসঙ্গে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেমে লিপ্ত। আবার একটি মেয়েও একাধিক ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িত। বিবাহিতরাও এমন করছেন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন। এ বিষয়গুলো কেন হচ্ছে? এ বিষয়গুলো হচ্ছেই আমাদের অসতর্ক এবং অসচেতন ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে”।

সাইবার বুলিং

অনলাইনে ঢুকে গালিগালাজ, অশ্লীল ভাষা বা আক্রমণাত্মক মন্তব্য ও হুমকি পেয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন অথবা অনলাইনে গেম খেলেছেন এমন শতকরা ৭৯ জন মানুষই সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছেন। এবং এদের একটা বড় অংশই কম বয়সী শিশু কিশোরেরা; যাদের জীবনে এর অনেক বিরুপ প্রভাব পরেছে।

যৌন হয়রানি, অর্থনাস, সম্মানহানি এমনকি আত্মহত্যায় বাধ্য হওয়ার মতও ঘটনাও ঘটছে কারও কারও ক্ষেত্রে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঘটে যাওয়া এসব অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের আওতাধীন সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ইউনিটের প্রধান উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান ইটিভি অনলাইনকে জানান, গত বছর ২০১৭-তে শধু এক ঢাকা মহানগরীতেই আইসিটি অ্যাক্ট এবং পর্নোগ্রাফি অ্যাক্টের আওতায় মামলা হয়েছে প্রায় ২৪৬টি। এদের মধ্যে সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশনের কাছে ৭৬টি মামলার তদন্তভার আসে। চার্জশিট এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মধ্যে মোট ২৪টি মামলার তদন্ত কাজ শেষ করে পুলিশের এ বিশেষায়িত এ বিভাগ।

তবে বাস্তবে সাইবার অপরাধের সংখ্যা আরও অনেক বেশি যার বেশিরভাগই আইনী আওতার বাইরে থেকে যায়। উপ-কমিশনার আলিমুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু এ বিষয়গুলো অনেক স্পর্শকাতর তাই অনেক সময়ই ভুক্তভোগী থানা-পুলিশে যেতে চান না। আবার অনেকে প্রাথমিক পর্যায়ে আইনের সাহায্য নিলেও পরবর্তীতে তার থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। যে কারণে তথ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময়ই তদন্তের ফলাফল আসামির দিকে যায়”।

বিশেষজ্ঞদের মতামতা এবং এসব পরিসংখ্যান থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা পুরো ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত এবং অসচেতন ব্যবহারের ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। অতএব, তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দেহেরর সুস্থতা, মনের সুস্থিরতা আমাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে।

 

এসএইচএস/টিকে


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি