ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

যে কারণে ব্যতিক্রম এবারের ছাত্রলীগ

প্রকাশিত : ১৭:৩২, ২ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১১:৪৮, ৪ আগস্ট ২০১৮

বহু জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘোষিত হল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এই সময় একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের নামও ঘোষণা করা হয়।

দীর্ঘদিন পর ঘোষিত ছাত্রলীগের এ নেতৃত্ব নানা কারণে হয়ে উঠেছে ব্যতিক্রম। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যায় তা নিয়ে রয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা।

বরাবরই ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। সেই জায়গা থেকে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রলীগের এ পরিষদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

এমতাবস্থায় রাজপথে অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার ভার এই নেতৃত্বের কাঁধে আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পক্ষান্তরে চলমান অস্থিতিশীলতা নিরসনেও ছাত্রলীগকে ভূমিকা রাখতে হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের নেতৃত্ব।

ইতোমধ্যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বুঝানোর ভার গতকাল প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়েছেন। তার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে কথা বলেছেন।

শোভন-রাব্বানী পরিষদ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের নতুন সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন বিগত কমিটির সদস্য রেজানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বিগত কমিটির শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। রেজানুল হক চৌধুরী শোভন কুড়িগ্রামের সন্তান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর গ্রামের বাড়ী মাদারীপুর। তিনিও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ছাত্র।

কে এই শোভন- রাব্বানী

সিন্ডিকেটের রাহুমুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী নিজে এবার ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করেছেন। তার একটাই উদ্দেশ্য যাতে করে কোনো অনুপ্রবেশকারী ছাত্রলীগে ঢুকতে না পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ব্যাপক অনুপ্রবেশের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীকে দু:শ্চিন্তায় ফেলে। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে নেতৃত্ব বাছাইয়ের সময় পারিবারিক রাজনীতি ও মতাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য জোর দেন। সেই বিবেচনায় ছাত্রলীগের নব মনোনীত সভাপতি রেজানুল হক চৌধুরী শোভন ছিলেন একেবারে পারফেক্ট।
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী পরিবারের সন্তান শোভন। শোভনের দাদা মরহুম শামসুল হক চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৬নং সেক্টর এর প্রচার বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে কুড়িগ্রাম-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে (১৯৭৭ সালে) দেশ ও দলের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে জাতীয় নির্বাচন করেন।
শোভনের বাবা, ১৯৮১ সালে ভুরুঙ্গামারী উপজেলা শাখা ছাত্রলীগ এর সভাপতি ও ১৯৯১ সালে থানা যুবলীগ এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন । ২০০১ সালে থানা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১১ সাল থেকে পুণরায় নির্বাচিত হয়ে এখনো তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
অন্যদিকে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের সন্তান গোলাম রাব্বানীও আওয়ামী পরিবারের সন্তান। গোলাম রাব্বানীর নানা মরহুম শামসুল হক মুন্সী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্থানীর ইশিবপুর পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাব্বানীর মা তাছলিমা বেগম ( ১৯ জুলাই মারা যান) রাজৈর কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯১ মেয়াদে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার মায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা এখনও এলাকাবাসীর মুখে মুখে। গোলাম রাব্বানীর বাবা একজন সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা। তার ছোট ভাই ৩৫ তম বিসিএস- এ পুলিশ ক্যাডার লাভ করেন।

কী ভাবছে বর্তমান নেতৃত্ব
ছাত্রলীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী আগামী দিনে সংগঠন নিয়ে নিজের ভাবনার বিষয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন যখন আমি মা হারানোর শোকে দগ্ধ। আমার দু:খ একটাই, আমার মা আমার এ অর্জন দেখে যেতে পারলেন না। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন,
আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দায়িত্ব নিয়েছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন। তার আগেই প্রতিটা ইউনিটে যেসব সমস্যা আছে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নতুন কর্মপরিকল্পনা সংগঠন সাজাব। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি এমন ইউনিটগুলোতে নির্বাচনের আগে সম্মেলন হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম রাব্বানী বলেন, সেক্ষেত্রে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুস্মরণ করব। অনেক ইউনিটে সম্মেলন হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেসব এলাকায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিষয়ে গোলাম রাব্বানী বলেন, এখন থেকে ছাত্রলীগে কোনো `ভাই লীগ` থাকবে না। ছাত্রলীগের নেতা একজন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগ প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করবে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের চলমান আন্দোলন সম্পর্কে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমি বারবার পুলিশ ভাইদের বলেছি, আপনারা কোনো ছাত্রের গায়ে হাত দেবেন না। তাহলে হিতে বিপরিত হবে।

প্রাধান্য পায়নি আঞ্চলিকতা

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনেকগুলো প্রথা ভাঙ্গতে হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো আঞ্চলিকতা। নানা কারণে এক এলাকা থেকে বারবার নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার নজির থাকলেও এবার সেটি ভাঙা গেছে। বিগত পরিষদের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগও মাদারীপুরের সন্তান ছিলেন। পরিষদের মধ্যে মাদারীপুর ও উত্তরবঙ্গ থেকে নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও এবার মূল নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। সম্মেলন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে রাজনীতি ঘনিষ্ট লোকজনের ধারণা ছিল আর যাই হোক উত্তরবঙ্গ- মাদারীপুর- ফরিদপুর এলাকা থেকে নেতৃত্ব আসবে না। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তাছাড়া এবার দুটি পদে একই বেল্ট থেকে নির্বাচনের ঘটনা সম্ভবত এবারই প্রথম। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি যেমন কুড়িগ্রাম থেকে নেওয়া হয় তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদকও নির্বাচিত হয় কুড়িগ্রাম থেকে। তাছাড়া এবারই দীর্ঘদিন পর বরিশাল থেকে কোনো নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু বিগত প্রত্যেকটি পরিষদে মূল চারটি নেতৃত্বের কাউকে না কাউকে বরিশাল থেকে নেওয়া হত।

সবাই এসেছেন একই ঘর থেকে

বিগত সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্ধারণে বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দেওয়া হলেও একই বিভাগ থেকে কখনও একসঙ্গে নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু এবার ছাত্রলীগের মূল দুই কান্ডারী নির্বাচিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে। শুধু তাই নয়। ছাত্রলীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক পদ দুটিও বাছাই করা হয়েছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে। যদিও বা এ নেতৃত্ব বহু জল্পনা কল্পনার ফসল তথাপি এককেন্দ্রীক নেতৃত্ব সংগঠনের বিকাশে কতটুকু লাভজনক হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।

আমি চাইলাম যারে পাইলাম না তারে

মানুষ বড় পদ চেয়ে ছোট পদ পায়। তবে ছোট পদ চেয়ে বড় পদ পাওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু তেমনই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের এই কমিটিতে। সভাপতি পদে মনোনীত হওয়া রেজানুল হক চৌধুরী শোভন শুরু থেকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী ছিলেন। শোভন নিজে ও তার সমর্থকরা সব সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছিলেন, তিনি সাধারন সম্পাদক হতে চাচ্ছেন। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে তাকে সভাপতি মনোনীত করা হলে বিস্মিত হয় অনেকেই। এমনকি তার ঘনিষ্ট সমর্থকদের মধ্যেও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
পক্ষান্তরে গোলাম রাব্বানীর নাম বিভিন্ন সময়ে সভাপতি পদপ্রত্যাশীদের নামের তালিকায় ছিল। কিন্তু তাকে করা হয় সাধারন সম্পাদক। বিগত কমিটিতেও পদানুসারে গোলাম রাব্বানী রেজানুল হক চৌধুরী শোভনের সিনিয়র ছিলেন।

ভেঙ্গে গেছে সিন্ডিকেটের রাহু


ছাত্রলীগের সাবেক এক কেন্দ্রীয় সভাপতির নেতৃত্বে একটি বলয় দীর্ঘদিন সারাদেশে ছাত্রলীগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী মনোনীত বা নির্বাচিত করার অভিযোগ থাকলেও এবার ছাত্রলীগ পুরোপুরি সিন্ডিমুক্ত হয়েছে বলে দাবি করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাদের বক্তব্য এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নিজে যাচাই বাছাই করে নেতৃত্ব নির্ধারণ করেছেন। ফলে অসাধু গোষ্টীর প্রভাবমুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তবে এর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত নেতৃত্ব কতটুকু দক্ষ তা সময়ে প্রমাণিত হবে বলেই মনে করছেন অনেকে। ছাত্রলীগের সাবেক এক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মনোনীত নেতৃত্ব কতক্ষণ নিজেদের সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত রাখতে পারে সেটাও একটা প্রশ্ন।

উল্লেখ্য গত ১১ ও ১২ মে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আড়াই মাস পর নানা জল্পনা কল্পনার মধ্য দিয়ে ঘোষিত হল ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব।

অা অা/ এআর


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি