ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

সংশপ্তক

ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান

প্রকাশিত : ১৬:০০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৬:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঝালের চোটে শিষ টানতে টানতে হেঁসেল থেকে বেরুতেই জুঁই দেখল আবুল বাশার টেবিলে মাথা গুঁজে কী সব হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত।


ফুউউউ...। ওগো শুনছ। ফুউউউ...। উফ্ আমার দিকে তাকাও তো একটু। এত সাত সকালে কি সব হিসাব-টিসাব নিয়ে বসেছ। কাল ঈদ, তোমার তো একটু বাজারে যেতে হবে চট করে। বেশ কিছু জিনিসপত্র কেনা এখনও বাকি। কেনাকাটায় ফাইনাল টাচটা না হলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাব আমি।

টেবিলের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে আবুল বাশার জুঁইকে বলল- কি এত ফুউ... ফুউ... করছ। মরিচ-টরিচ খেয়েছ নাকি গোটা কয়েক।

-কী সব অদ্ভুত কথা যে বল মাঝে মধ্যে। গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মরিচ খাব কেন শুধু শুধু। আগামীকালের জন্য গরুর মাংস কষাচ্ছিলাম। ভুলবশত মরিচ ঢেলে ফেলেছি বেশি। মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে গিয়েই মুখে যেন আগুন ধরে গেল। আমারই যদি এ অবস্থা হয় ছেলেটা যে কীভাবে তরকারি মুখ তুলবে ভেবেই অস্থির হচ্ছি। কাগজপত্র, কলম এগুলো গুটিয়ে রেখে আবুল বাশার চেয়ারটা ঈষৎ ঘুরিয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকাল। চোত-বোশেখের পাকা বাঙ্গির মতো গায়ের রং জুঁইয়ের। গৌরবর্ণ শরীরের অনেকটাই ঘামে ভেজা। টিয়া রঙের জমিনের ওপর লাল পেড়ে শাড়িতে আজ বেশ মানিয়েছে তাকে। লাল পাড়ের সঙ্গে ম্যাচ করা লাল রঙের ব্লাউজটা জায়গায় জায়গায় ঘামে ভিজে লেগে আছে শরীরের সঙ্গে। ব্লাউজের আড়ালে বায়াস্য পাখির গায়ের রঙের অন্তর্বাসের ফিতেগুলো সে জন্য অনেকটাই স্পষ্ট। ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভ্রমরের পাখার মতো কুচকুচে কালো কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত অবাধ্য চুলগুলো খোঁপা করে তাদের আজ একেবারে কাবু করে রেখেছে জুঁই।

-কষা মাংসের ঝাল কমানোর জন্য একটি উপায় আমি তোমায় বাতলে দিতে পারি কিন্তু। এই বলে আবুল বাশার চেয়ার ছেড়ে জুঁইকে পেছন থেকে আলত করে জড়িয়ে ধরল।

-এই কী হচ্ছে এসব। ছাড় বলছি। ছেলেটি পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। এক্ষুনি চলে আসবে কিন্তু। বুড়ো বয়সে ভীমরতি।

-আচ্ছা ভীম বুড়ো বয়সে কার সঙ্গে রতি করেছিল। বলত। স্মিত হেসে বলল আবুল বাশার।

-আমি কি জানি। ভীম কারও সঙ্গে আদৌ রতি করেছিল নাকি করেনি। এসব তো জানার কথা তোমার। রোজ রাত জেগে এত এত যে পড়।

-তুমি অবশ্য ঠিকই বলেছ। মহাভারত তো আমি পড়েছি। কিন্তু সত্যি সত্যি মনে পড়ছে না যে ভীম বুড়ো বয়সে কার সঙ্গে এসব করেছিল। আচ্ছা তুমি আমাকে বুড়ো বললে কেন। এই তো গত বছর আমি সবে মাত্র তিপান্ন অতিক্রম করলাম। পঞ্চাশ অতিক্রম করলেই কি মানুষ বুড়ো হয়ে যায়? আর শোন বার্ধক্যকে আমি কখনও ভয় পাই না। দেশের যা অবস্থা তাতে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মরে যাওয়াই ভালো। তা হলে আর এসব গুম, খুন-হত্যা, রাহাজানি, ব্যভিচার সেই সঙ্গে বিবিধ অনাচার স্বচক্ষে দেখতে হয় না। তবে কি জানো যৌবনের মতো বার্ধক্যও জীবনের আর একটি অধ্যায়। বার্ধক্যে জীবনকে উপভোগ করতে হয় ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে। তখন অনিবার্যভাবেই দৃষ্টি হয় সুদূর প্রসারিত। যৌবনে মানুষ যেমন সৃষ্টি, সম্ভোগ ও অতৃপ্তি নিয়ে ব্যাপৃত থাকে। পড়ন্ত বেলায় এসে মানুষের আচরণও হয় ঠিক একেবারে উল্টো। তখন সে হয় ধিরস্থির শান্ত ও নির্লিপ্ত। মানুষ বুঝতে পারে অন্তিম শয়নে পৃথিবী থেকে আসলে কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না সে। বরং রেখে যায় তার কৃতকর্মের ফল।

-আজকালকার সব বিত্ত ও শক্তিশালী পৌঢ় মানুষজন দেখে কি তোমার আসলে তাই মনে হয় যে, তারা ধিরস্থির, শান্ত, নির্লিপ্ত ও তৃপ্ত। পরিহাসের স্পষ্ট আভাস জুঁইয়ের কণ্ঠে।

-আমি শুধু বাংলাদেশের মানুষদের উপলক্ষ করে এ কথা বলছি না। আমার বক্তব্যের প্রেক্ষাপট বিশ্বজনীন।

-আচ্ছা তুমি এই যে এত এত বই পড়। একেবারে যাকে বলে জ্ঞানের আধার। বিদ্যার ঢেঁকি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তো এত ভালো রেজাল্ট করলে। কিন্তু লাভটা হল কী। জীবনে তো কিছুই করতে পারলে না। তোমার এত পড়াশোনা জীবনে কি কাজে লাগল বলত। একটি দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করলে কিছুদিন। মালিকপক্ষের সঙ্গে মনমালিন্য করে অবশেষে সেটিও একদিন ছেড়ে দিলে দুম করে। তোমার মতো ব্যর্থ জ্ঞানী কি সমাজে আর আছে দুটি?

-আবুল বাশার মনে মনে ভাবে। সত্যি কথাই তো বলেছে জুঁই। তার চেয়ে খারাপ রেজাল্ট করে তার সতীর্থ বন্ধুরা আজ বাস করে প্রাসাদতুল্য বাড়িতে। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে দাবড়ে বেড়ায় সর্বত্র। কিন্তু সবাইকে দিয়ে তো আর সবকিছু হয় না। জুঁই সেটি কিছুতেই মানতে চায় না। আবুল বাশারের মাঝে মাঝে মনে হয় জুঁই কেন যে তাকে ভালোবাসল। কিংবা বিয়ে করে ঘর বাঁধল। এর কারণ কি এটাই যে, ক্লাসে সে ছিল সেরা ছাত্র। নাকি আবুল বাশার ভালো কবিতা আবৃত্তি করত এবং মাঝে মধ্যে পত্রিকা-টত্রিকাগুলোতে তার কবিতা বেরোত। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল বলে জুঁই হয়তো ধরেই নিয়েছিল যে, তার ভবিষ্যৎ হবে নিশ্চিত ও সমৃদ্ধ। কিন্তু বিধিবাম। জীবনে কিছুই হলো না তার। ভাগ্য ভালো যে ছাত্রী হিসেবে জুঁইও ছিল অসাধারণ। তাই তো লেখাপড়া শেষ করেই ভালো বেতনে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে ও। ওর বেতন দিয়েই তো আজকাল সংসারটা অন্তত চলছে। আবুল বাশার নিজে যৎসামান্য যা করে সেটিকে অবশ্য কাজ বলা চলে না। অন্য কারও দৃষ্টিতে নয় এটি স্বয়ং আবুল বাশারের-ই অভিমত। আর সে জন্য সে তার কাজের কথা কাউকে বলতেও সাহস করে না।

-এই চুপ করে কি এত ভাবছ বলত। জুঁই আবুল বাশারের শরীরে আলত স্পর্শ করে জানতে চায়।

-অন্যমনস্কতা কেটে গিয়ে সম্বিত ফিরে পায় আবুল বাশার। না মানে এমনি কিছু একটা ভাবছিলাম। সে তোমার না জানলেও চলবে। কই দাওনা বাজারের ব্যাগটা এনে। বাজারটা সেরে আসি ঝটপট। আচ্ছা সিসিম কি ঘুমাচ্ছে নাকি এখনও।

-ঘুমাবে না আবার। ঈদ উপলক্ষে কলেজ তো বন্ধ। আজ তো আর কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। সে জন্যই বোধহয় আয়েস করে ঘুমাচ্ছে।

শরীরে ইস্ত্রি করা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি গলিয়ে নিউমার্কেটের দিকে রওনা হলেন আবুল বাশার। রিকশাযোগে নিউমার্কেটের দিকে যেতে যেতে তিনি লক্ষ করলেন ঈদ উপলক্ষে পুরো শহর ব্যস্ততায় যেন একেবারে নুয়ে পড়েছে। সকালে যদিও আকাশে ঈষৎ মেঘের আভাস ছিল বটে। কিন্তু বেলা গড়াতেই সেই মেঘ কেটে গিয়ে রোদে ঝলমল করছে চারদিক। সেই সঙ্গে গরমও পড়েছে ভয়ানক। অসহ্য উত্তাপে কুলকুল করে ঘামছিলেন তিনি। নীলক্ষেতের সামনে আসতেই দেখা গেল ফুটপাতের পাশে রাস্তার প্রান্তে দুটি সারমেয় পশ্চাদদিক থেকে যুগলবন্দি হয়ে কুঁইকুঁই করছে। ওরেব্বাস! ভাদ্র মাস আসতে না আসতেই এ অবস্থা! আবুল বাশারের অজান্তেই ঠোঁট ফসকে কথাগুলো বেরিয়ে আসে। ফুটপাতের ওপাশের হোটেল থেকে কেউ একজন এক গামলা হাড়মাংস সুদ্ধ এঁটেকুটো রাস্তার ওপর ফেলতেই মাদি কুকুরটি ওর সঙ্গীকে টেনে নিয়ে ধাবমান হয় রাস্তার ওপর পতিত এঁটেকুটোগুলোর দিকে। আর তখনই কুকুর দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একটি অপরটি থেকে। চারদিক ভিড়ে ভিড়াক্কার হলেও নীলক্ষেতের সেকেন্ড হ্যান্ড বই দোকানিদের অলস সময় কাটাতে দেখা যায়। সেখানে তেমন ভিড় নেই। ঈদ উপলক্ষে হয়তো বই কেনা বা পড়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বেশিরভাগ ইঁদুরেদের। বরং ভিড় উপচে পড়েছে রিকশাভ্যানে বিক্রীত শার্ট, প্যান্ট, জাঙ্গিয়া, গেঞ্জি কিংবা সস্তা দামের প্লাস্টিকের সেন্ডেল এ সবের ওপর। প্রচণ্ড গরমের কারণে ডাব বিক্রেতাদেরও পয়মন্ত অবস্থা। ডাব বিক্রি হচ্ছে ধুমিয়ে। আবুল বাশারও বেশ তৃষ্ণার্থ। একবার ভাবলেন রিকশা থামিয়ে একটু ডাবের পানি খেয়ে নিলে ভালো হয়। তৃষ্ণাটা অন্তত নিবারণ করা যায়। কিন্তু রিকশাওয়ালার ভাবগতিক খুব একটা সুবিধের মনে হলো না। ঈদ উপলক্ষে সবাই ব্যস্ত। যত বেশি খেপ তত বেশি আয়। আবুল বাশার সরাসরি চলে এলেন নিউমার্কেটে। প্রথমেই তাকে সারতে হবে কিছু টুকটাক কেনাকাটা। তারপর কাঁচাবাজারে গিয়ে সেখান থেকে করতে হবে বাদবাকি সদাই।

নিউমার্কেটের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে যখন এসব সাত পাঁচ ভাবছিলেন। ঠিক তখনই লক্ষ করলেন একটু দূরে জুতার দোকানের সামনে হট্টগোল ও বেশকিছু মানুষের জটলা। মা গো... বাবা গো... আমারে ছাইড়া দেন আমি আর করুমনা। এসব বলে কেউ একজন আহাজারি করছে। কচি কণ্ঠনিঃসৃত আর্তচিৎকারের নিনাদে মূর্ছিত হচ্ছে আশপাশ একটু ধাতস্ত হতেই আবুল বাশার বুঝতে পারলেন জনাবিশেক লোক একটি কিশোর ছেলের ওপর ভয়ানক প্রহারে লিপ্ত। কেউ লাঠি হাতে, কেউ আবার শুধু হাত ব্যবহারের মাধ্যমেই তাদের শরীরের শক্তিমত্তা প্রকাশে ব্যস্ত- কিল, ঘুষি, চড়-থাপ্পড় কিছুই বাদ যাচ্ছে না। একটু কাছে এগোতেই দেখা গেল ছেলেটির মুখের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। গায়ের জীর্ণ মলিন শার্টটি ছিঁড়ে ছত্রখান। পঁচিশ-ত্রিশজনের মতো লোক ছেলেটাকে ঘিরে রাখলেও আসলে মারপিটে লিপ্ত আছে চার-পাঁচ জনের মতো। বাকি লোকগুলো নামাজে দাঁড়ানোর মতো করে বুকের কাছে হাত দুটো বেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। আবুল বাশার বোঝার চেষ্টা করলেন আসলে হচ্ছেটা কী? পাশের দোকানের জনৈক কর্মচারী (মালিকও হতে পারে) শ্লেষ মিশেল কণ্ঠে বললেন- ‘আর বইলেন না, জুতা চুর। ঈদের আগে এইসব চুরগুলার কামই হইল দোকানে দোকানে চুরিচামারি করা। এইবার চুর বুঝতেছে কত চাউলে কত ধান। আরে কথায় আছে না- চুরের দশদিন আর দোকানির একদিন। এখন সেই একদিনের হিসাব লওয়া হইতেছে।’

-ভাই থামান না, ছোট একটি ছেলে। মরে টরে যেতে পারে। আবুল বাশারের বুকটা হুহু করে ওঠে।

-কি যে বলেন। চুরের শরীল হইল বিলাইয়ের শরীল। যতই মারেন-পিটেন একটু পরেই দেখবেন ঝাড়া দিয়া উইঠা দৌড় দিব। তখন সে দিব্যি সুস্থ মানুষ।

-আবুল বাশারের কানে লোকটির কথাগুলো বিষবৎ শোনায়। তিনি একাই এগিয়ে যান জটলার দিকে। এই যে ভাই, ছেলেটিকে আর কত মারবেন। দয়া করে থামেন এবার। মুখের চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলল আবুল বাশার।

-ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলল- আপনি কে ভাই। জুতা কি আপনার দোকান থেকে চুরি করছে। আপনার এত দরদ উতলাইতেছে ক্যান, বুঝলাম না তো।

-আবুল বাশার বিপন্নের মতো বলল- দেখেন ভাই একজোড়া জুতার জন্য তো ছেলেটির প্রাণটাই যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। ওকে মাফ করে দিন এবার। জুতা জোড়ার দাম না হয় আমিই দিয়ে দিচ্ছি। এই বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাজার দুয়েকের মতো টাকা মুঠো ভরে বের করে আনলেন আবুল বাশার।

-ভিড়ের মধ্য থেকে আরেকজন বলল- জুতা চুরি করছে এই ছ্যামড়া। আর টাকা দিতে চাইতাছেন আপনি। ব্যাপারটা তো বুজগতিক মনে হইতেছে না।

একজন বলল- আরে এই ব্যাটাই হইল এই পাতি চোরের ওস্তাদ। দূরে দাঁড়াইয়া থ্যাইকা এই ছ্যামড়ারে দিয়া চুরি করাইতেছিল। এখন আসছে ভুজুং ভাজুং দিয়া শাগরেদরে ছাড়াইয়া নিতে। ব্যাটারে ধর। এই বলে ভিড়ের একাংশ এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আবুল বাশারের ওপর। আবুল বাশারের হাতের টাকাগুলো সব পত্র মর্মরের মতো শব্দ না করেই শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল দিগি¦দিক। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো মারের বর্ষণ শুরু হল আবুল বাশারের শরীরে।

কোন এক ভালো মানুষের ছেলে হয়তো মারামারি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে খবরটি সন্তোর্পণে পৌঁছে দিয়েছিল পুলিশের কাছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ দু’জনকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল থানায়। তারপর তাদের নিক্ষেপ করল গারদে। ওসি খোদাবক্স আবুল বাশারকে জিজ্ঞেস করলেন- কি মিয়া এসব কামধামে আছ কতদিন। ওস্তাদ সাগরেদ মিলে ভালোই তো চালাচ্ছ মনে হয়। মাল কড়ি যা জমিয়েছ সেখান থেকে এখন ছাড় কিছু আমাদের জন্য। আবুল বাশার প্রতিউত্তরে বলল- আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। জুতা তো আমি চুরি করিনি। চুরি করেছে এই ছেলেটা। আমি তো ওকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম মাত্র।

খোদাবক্স বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন- প্রথম প্রথম সবাই এ কথাই বলে। পশ্চাদদেশে গো-বেড়েন পড়লেই মুখ দিয়ে ফরফর করে সব বেরিয়ে আসবে। চিন্তা করো না চান্দু। তা কি করো তুমি? আবুল বাশার বলল- এখন কিছু করি না। দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতাম এক সময়। বছরখানেক আগে ছেড়ে দিয়েছি চাকরি। এখন সম্পূর্ণ বেকার। খোদাবক্স ঝাঝালো কণ্ঠে বলল- ভুয়া সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে আসলে তো করো চুরি, তাই না। এসব আমাদের কিছুই অজানা নয়। টাকা পয়সা জমিয়েছ কেমন? আমার সাফ কথা, এখান থেকে ছাড়া পেতে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। তোমার লোকজনদের খবর দাও। টাকা নিয়ে আসতে বল। তা না হলে মারের চোটে শরীরের হাড্ডি মাংস আলাদা হবে।

গারদখানার ছোট এই প্রোকষ্ঠের ভেতর ভয়ানক গরম। গলগল করে ঘাম ঝরছে আবুল বাশারের তামাটে শরীর থেকে। ঘামে ভিজে সাদা পাঞ্জাবিটার যে অংশটুকু লেপ্টে আছে শরীরের সঙ্গে সে অংশটুকু কচি তালের শাঁসের মতো দেখাচ্ছে। কক্ষের এক কোণে হাঁটু ভেঙে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আবুল বাশার স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে বলল- তোর নামটাই তো জানা হল না এখনও। কি নাম রে তোর? থাকিস কোথায়? চুরিদারির মতো এমন বাজে কাজ করতে গিয়েছিলি কেন। তোর যে শরীর-স্বাস্থ্য তাতে তো যে কোনো একটা বয়-বেয়াড়ার কাজ জুটিয়ে নেয়া এমন কোনো কঠিন কিছু নয়।

ছেলেটি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল- আমার নাম সনু। আমরা থাকি কেরানীগঞ্জ বস্তিতে। বাপজানের একজোড়া জুতা দরকার। এ জন্য চুরি করতে গেছিলাম। এ পর্যন্ত বলে অঝরে কাঁদতে শুরু করে সনু। তিন-চার দিন কামলা দিয়া পাঁচশ টাকাও তো গুছাইতে পারলাম না। কী করুম।

তোর বাবার জুতার প্রয়োজন? কিন্তু কেন? আবুল বাশার ঈষৎ কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় সনুর কাছে। বাপজান মাছ, মুরগি, তরিতরকারি এগুলো ফেরি করে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তায় মেলা পানি জমছে। ড্রেনের পচা পানিতে হাঁইটা হাঁইটা বাপজানের পায়ে হাজা হইছে। সেন্ডেল জোড়াও একেবারে নষ্ট হইয়া গেছে। বাপজান পায়ের বিষে হাঁটতে পারে না। আমার আরও তিনডা বোইন আছে ছোড ছোড। মা, বোইনসহ পরিবারে পাঁচ-ছয়জন মানুষ। বাবায় কামে যাইতে পারে না বইলা দুই-তিন দিন ঘরে খাওন নাই। বাপজান কইল একজোড়া জুতা থাকলে কষ্ট কইরা হইলেও কামে যাওন যাইত। আমি দোকানের সামনে দিয়া যাইতেছিলাম। দেখলাম দোকানের সামনে অনেক জুতা সাজাইয়া রাখছে। ভাবলাম একজোড়া জুতা হইলেই তো বোইনগুলার মুখে খাওন জুটব। এই জন্য..। কথা আর এগোয় না সনুর মুখ দিয়ে। আবুল বাশার মনে মনে ভাবে সরকার রাতদিন উন্নয়নের মহাফিরিস্তি দিয়ে মুখে ফেনা তুললেও দেশের অনেক মানুষ যে কত কষ্টে আছে সেটি এ সনুকে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

এএসপি মনিরুল জিপ থেকে নেমে সিঁড়ির পাশে গারদখানার সামনে দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন দোতালায়। আবুল বাশারের কালো মোটা ফ্রেমের চশমার স্বচ্ছ গ্লাস ভেদ করে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মনিরুলের ওপর। তিনি মনিরুলকে উদ্দেশ করে বললেন- এক্সকিউজমি, এক গেলাস পানি পাওয়া যাবে। মনিরুল লোহার গারদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিছুটা স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি রাজনীতি-টাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবুল বাশার বললেন- না। তা হলে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী। জুতা চুরির অভিযোগে এ যুবকটির সঙ্গে আমাকেও ধরে আনা হয়েছে এখানে। আসলে আমি গিয়েছিলাম মারের হাত থেকে ছেলেটিকে উদ্ধার করতে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে আবুল বাশার। মনিরুল ইসলাম সাগ্রহে জানতে চায়, আপনি কী করেন। মানে আপনার পেশা জানতে চাইছি। আপাতত এখন কিছু করি না। বছরখানেক আগে কাজ করতাম একটা পত্রিকায়। ও আপনি তাহলে সাংবাদিক। বলতে পারেন একরকম- আবুল বাশার নির্লিপ্তভাবে বলে কথাগুলো। আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করুন। দেখছি আপনার জন্য কী করা যায়।

এএসপি মনিরুল আবুল বাশারকে ডেকে পাঠালেন তার নিজের খাস কামরায়। আবুল বাশারের দিকে ইশারা করে বললেন, বসুন চেয়ারটায়। ওসি খোদাবক্সকেও ডেকে আনা হয়েছে রুমে। তিনিও দাঁড়িয়ে আছেন টেবিলের একপাশে। মনিরুল ইসলাম ওসির দিকে তাকিয়ে বললেন- সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও তুমি ওনাকে কেন গারদে ঢোকালে। ওসি আমতা আমতা করে বলল, আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ওনার ওই পত্রিকা তো এক বছর আগেই উঠে গেছে। সে জন্য ভাবলাম উনি হয়তো মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমাদের ধাপ্পা দিচ্ছে। এএসপি মনিরুলের পাল্টা প্রশ্ন- উনাকে দেখতে কি জুতা চোর মনে হয়? ভাগো এখান থেকে-

ওসির প্রতি ধমক লাগালেন মনিরুল। আবুল বাশারকে উদ্দেশ করে বললেন, আচ্ছা আপনার নাম তো আবুল বাশার তাই না। আপনার নামেই আরেকজন উপন্যাসিক আছেন চেনেন নাকি তাকে। কি যে অসাধারণ তার লেখা। আমি তার একনিষ্ঠ গুণমুগ্ধ বলতে পারেন। ভাবছিলাম ঠিকানা পেলে এক সময় গিয়ে দেখা করে আসব তার সঙ্গে।

আবুল বাশার মনিরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে ভাবলেসহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ওনার কোন কোন উপন্যাস পড়েছেন আপনি। মনিরুলের চটপট উত্তর- উজানভাটি, চোরাবালি, একটি নক্ষত্রের পত্তন প্রভৃতি উপন্যাসগুলো পড়া আছে।

একটু নড়েচড়ে বসে আবুল বাশার বলল- আপনার মনে ধরেছে বলেই বলছি। ওগুলো আমারই লেখা উপন্যাস। আমিই সেই অখ্যাত লেখক, আবুল বাশার।

কী বলছেন আপনি? মনিরুল ইসলামের চোখে মুখে বিস্ময়ের বিচ্ছুরণ।

এএসপি মনিরুল ইসলাম চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে ভাবমুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, কী সৌভাগ্য আমার! আমি তো আমার চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার অতি প্রিয় লেখক আজ আমারই সামনে বসে! মনিরুল কপট অভিমানী গলায় বললেন, তখন যে বললেন কিছুই করেন না আপনি। এটা কেন বললেন? অন্য উপন্যাসগুলোর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। শুধু আপনার উজানভাটি উপন্যাসই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে শতশত বছর। হ্যাঁ, এই তো সপ্তাখানেক আগেও একটি মিটিংয়ে আমাদের আইজি মহোদয় আপনার উজানভাটি উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

আবুল বাশার লজ্জায় রক্তিম হয়ে বললেন, দেখুন, আপনাদের মতো কিছু পড়–য়া মানুষের কাছে আমার দু-একটি উপন্যাস হয়তো ভালো লেগেছে। উপন্যাসগুলোর ভাগ্যে খ্যাতি জোটেনি এতটুকুও। আমার প্রকাশক সাহেব উপন্যাসখানা ছেপেছিলেন এক হাজার কপির মতো। কিন্তু তিনশ কপিও তো বিক্রি হল না। তা হলে কী করে বলি যে আমি একজন লিখিয়ে, লেখালিখি আমার পেশা।

মনিরুল ইসলাম উল্লোসিত গলায় বললেন, এই কথা, জানেন তো শেক্সপিয়রের লেখা জনপ্রিয় হতে দু’শ বছর লেগেছিল। এসব ইতিহাস কি আর আমি আগে জানতাম। বিসিএস পরীক্ষা দিতে গিয়ে পড়তে হয়েছিল এসব। রাজসিক আদর আপ্যায়ন শেষে মনিরুল ইসলাম বিদায় জানালেন তার প্রিয় লেখককে।

আবুল বাশার বাড়ি ফিরে এলেন খালি হাতে। তার হাতে বাজারের ব্যাগ না দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে জুঁই। তুমি কেমন মানুষ গো? কাল ঈদ। অথচ তুমি ফিরে এলে খালি হাতে। আর তোমার একি অবস্থা! ছিনতাইকারী- টিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলে নাকি। আবুল বাশার জুঁইকে সব কিছু খুলে বলল। সব শুনে জুঁই নির্বাক ও নিস্তব্ধ। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় স্বামীকে কি-ই বা আর বলা যায়। বাড়ির সবার ঈদ কাটল নিরানন্দ ও নিরাসক্ততায়।

আবুল বাশারের সঙ্গে যা যা ঘটেছে সেগুলো নিয়ে তিনি এতটুকুও উচ্চবাচ্য করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সবকিছু ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে। কিন্তু তিনি যা চাইবেন সবকিছু সে রকমই হবে তেমন তো কথা নয়। জুঁই স্বয়ং নিজে ফোন করে আবুল বাশারের সতীর্থ বন্ধুদের সবকিছু জানালেন। ঈদের একদিন পর কয়েকটি সংবাদপত্র ফলাও করে সবিস্তারে সংবাদটি ছাপল। দু’দিন পরের ঘটনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলতেই আবুল বাশার দেখলেন সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে ওসি খোদাবক্সকে। খবরটি পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল আবুল বাশারের। পুরো দিন ঘরের ভেতর পায়চারি করলেন একা একা। আর ভাবতে লাগলেন কী করা যায়।

আইজি বদরুল আলম খন্দকার অফিস কক্ষে বসে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এমন সময়ে বেয়ারা এসে বদরুল সাহেবকে জানালেন- এক সাংবাদিক সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে অপেক্ষা করছে বাইরে। বদরুল আলম বেয়ারাকে ইশারা করে তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন।

রুমে ঢুকেই হাতখানা বাড়িয়ে আইজি সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে নিজের পরিচয় দিলেন আবুল বাশার। তারপর বললেন- পেশায় আমি সাংবাদিক হলেও একটু আধটু লিখালিখিও করি।

আইজি সাহেব চোখে মুখে প্রসন্নতা এনে বললেন, আরে বসুন বসুন। আপনার উপন্যাস আমি পড়েছি কয়েকটা। দুর্দান্ত ও অনবদ্য। আপনার মতো গুণী মানুষের সঙ্গে যা হয়েছে সত্যি সেটি দুঃখজনক। ওই ওসিকে কিন্তু সাময়িকভাবে সাসপেন্ডও করা হয়েছে ইতিমধ্যে। আপনি এখন সন্তুষ্ট নিশ্চয়ই।

আবুল বাশার বললেন, আসলে আমি এ কারণেই এসেছি আপনার কাছে। সাসপেন্ড অর্ডারটি বাতিল করতে হবে।

কী বলছেন? কিন্তু কেন? আবুল বাশার মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধিত করে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, আমি কারও পেটে লাথি মারতে চাই না। এ রকম আরও শতশত খোদাবক্স পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। একজনকে ছাঁটাই করে কী করবেন। তাতে কি সব অনাচার বন্ধ হয়ে যাবে। জানি হবে না। যদি সম্ভব হয় দেশের এ পুলিশ ডিপার্টমেন্টটাকে একটি ইন্সটিটিউশনে রূপান্তরিত করুন। পারবেন।

বদরুল আলম বললেন, সেটি কি আর আমার একার হাতে সাহিত্যিক সাহেব। চাইলে সেটি পারেন আমাদের ওপরওয়ালারা। যা হোক, আপনার এ সিদ্ধান্তে আমি মুগ্ধ হলাম।

লেখক : আইনজীবী, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল :  barristershaifur@yahoo.com
//এআর


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি