ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

সমস্যা যখন ফেসবুক!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১৪, ২২ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৩২, ২২ এপ্রিল ২০১৮

রাফসান মাহমুদ ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কর্মঠ ও সময়জ্ঞান সম্পন্ন হওয়ায় অফিসেও সে আদর্শ। তবে সম্প্রতি বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে রাফসানের। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে বিছানায় গেলেও হাতে থাকে এন্ড্রয়েড ফোন। প্রথমদিকে কিছুক্ষণ ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করেই ঘুমিয়ে পড়তো রাফসান। তারপর আস্তে আস্তে সময়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। আগে নিয়মিত রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমালেও এখন প্রায়ই ঘুমাতে যায় প্রায় শেষ রাতের দিকে। এতে আগের মতো আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না রাফসান। তাই অফিসে পৌঁছতেও দেরি হচ্ছে তার। নিত্যদিন অফিসে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় শুনতে হয় বসের বকুনি। তবে একপর্যায়ে শুরু হয় আল্টিমেটাম।

রাফসান বুঝতে পারে তার এই সমস্যার জন্য দায়ী ফেসবুক। রাত বারোটার পর চ্যাট করতে তাঁর খুব ভালো লাগে। সে বুঝতে পারে তার ঘুমের ক্ষতি হচ্ছে। অফিসে যেতে দেরী হবে। কিন্তু সে নিরুপায়।

অরন্য ও মাহী প্রেম করে পরিবারের অসম্মতিতে বিয়ে করেছেন। দু`জনের পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি এ বিয়ে। দু`জনেই রাজধানীর দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন। ভালোবাসার সংসারটি দুজনে মিলে সুন্দর করে সাজাচ্ছেন। দুজনই সুখী। তবে ইদানীং তাদের সেই ভালবাসায় ফাটল দেখা দিয়েছে। মাহী খেয়াল করে অরন্য বাসায় ফিরেই আগের মতো তার সাথে কথা বলেনা। কার সাথে সারাক্ষণ চ্যাট করে। রাতে ঘুমানোর সময়ও হাতের এন্ড্রয়েড মোবাইটি তার সঙ্গী। একদিন মাহী গোপনে অরন্যের ফোনটি তার হাতে নেয়। তারপর মাহীর পৃথিবী ঘুরতে থাকে। এই ছেলের জন্যই কী আমি এক কাপড়ে সবাইকে ছেড়ে এসেছি? তারপর কান্নাকাটি, ভুল বুঝাবুঝি। অরণ্য স্বীকার করে, সে ভুল করেছে। সে এটাও বুঝতে পারে এই ভুলের জন্য দায়ী ফেসবুক।

নাদিয়া`র সমস্যাটা একটু অন্যরকম। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সে। ফেসবুকের কল্যাণে তার সাথে পরিচয় হয় মাহফুয নামের এক তরুণের। প্রথমে হাই-হ্যালো, তারপর দীর্ঘ আলাপ। এরপর আবেগের কাছে ধরাশায়ী হওয়া। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যেদিন তাদের দুজনের মধ্যে দেখা হবে সেদিনই তারা বিয়ে করবে। বিয়েটাও হয়তো হয়ে যেতো। যদি না নাদিয়ার মায়ের কাছে বিষয়টা ধরা না পড়তো। নাদিয়ার মা খবরটা নাদিয়ার বাবার কানে পৌঁছান। নাদিয়ার বাবা চৌকস সরকারি কর্মকর্তা। খোঁজ খবর নিয়ে আবিষ্কার করলেন, মাহফুয নামে ছেলেটির দেওয়া সকল তথ্য মিথ্যা। মাহফুয তার আসল নাম নয়। সে যে ইউনিভার্সিটির কথা তার প্রোফাইলে লিখেছে সেই ইউনিভার্সিটি দূরের কথা, এসএসসির গণ্ডিও পার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মেয়েদের সঙ্গে ফ্রড করে, প্রেমের ফাঁদে ফেলায় তার কাজ। এরই দায়ে ছেলেটি আগেও একবার পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিল। অবশেষে নাদিয়া বুঝতে পারে, তার আজকের অবস্থার জন্য দায়ী ফেসবুক।

কেবল রাফসান, অরণ্য, নাদিয়া-ই নয়। প্রতিদিন আমাদের চারপাশে এরকম হাজারো ঘটনার জন্ম হচ্ছে। যার জন্য কোনো না কোনো ভাবে দায়ী ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণে নানা ধরণের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইমো, স্কাইপি এখন খুব পরিচিত নাম। তবে নানা কারণে আমাদের দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফেসবুক। শুধু আমাদের দেশে নয়, বাণিজ্যিকভাবে সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে দাপুটে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফেসবুক অন্যতম। মার্ক জুকারবার্গ ও তার বন্ধুদের এ আলোচিত আবিষ্কারটি একদিকে যেমন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করেছে, অন্যদিকে তেমনি জন্ম দিয়েছে নানা সমস্যারও।

‘উই আর সোশ্যাল ও হুটস্যুট’ নামক প্রতিষ্ঠানের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এখানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করে। আর বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহার করছে ১২০ কোটি মানুষ। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে ফেসবুকে আসক্তি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সমাজে নৈতিকতার স্খলন দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে সামাজিক অবক্ষয়। শুধু তাই নয়, এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও।

ফেসবুকের ক্ষতিকর প্রভাবের অন্যতম উদাহরণ রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা। তেমনি একের পর এক ব্লগার হত্যার জন্যও ফেসবুকে উস্কানি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি করে বেশ কয়েকবার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ফেসবুকে। যা আইনগত দিক খেকে দন্ডনীয় অপরাধ। একই ভাবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে অন্যের সম্মানহানি করা, কারো চরিত্র হনন করার জন্যও সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুককে বেছে নেওয়া হচ্ছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বা পারিবারিক, সামাজিক শত্রুতা হাসিলের জন্য ফেসবুকে অপপ্রচার চালিয়ে অন্যের সম্মানহানি করা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, ‘অনেকেই অন্যকে হেনস্তা করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া আইডি খোলেন । বিশেষ করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে হেনস্তার পরিমাণ অনেক বেশি। তারা ওই আইডির মাধ্যমেই অশালীন মন্তব্য ও আপত্তিকর ছবি আপলোড করেন। মোবাইল ফোনে আপত্তিকর এসএমএসও পাঠানো শুরু করেন। এমন অনেক মামলা আমার কাছে আসে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফেসবুকে পরিচিতজনদের দ্বারাই তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার’। 

ফেসবুক আসক্তি:
ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে একসময় ফেসবুকে নির্ভরশীল হয়ে পড়া ও বেশকিছুক্ষণ ফেসবুকের বাইরে থাকতে না পারাই ফেসবুক আসক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে এমন ফেসবুক আসক্তের পরিমাণ বাড়ছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।

অর্থব্যায়:
ফেসবুক ব্যাবহারে ফলে বাড়ছে আর্থিক ব্যায়। মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলোর নানা ধরণের চমকদার বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে পা ফেলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অনেকেই। এমনকি সীমিত আয়ের মানুষরা এর দ্বারা বেশি ক্ষতির শিকার।

চোখ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এন্ড্রয়েড ফোন ও পিসি থেকে নির্গত রশ্মি চোখ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের জন্য তা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

কাজের ক্ষতি:
ফেসবুকের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো কাজের ক্ষতি। পড়াশুনা, অফিসের কাজ, পারিবারিক কাজসহ প্রচুর সময় নষ্ট হয় ফেসবুকের পেছনে। সামষ্টিকভাবে আমরা বছরে ফেসবুকের পেছনে কী পরিমাণ সময় নষ্ট করি, তার পরিমাণ কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

পড়ালেখার ক্ষতি:
ফেসবুকের ক্ষতির শিকার শিক্ষার্থীসহ জ্ঞানপিপাসুরাও। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফেসবুক আসক্তির ফলে একদিকে যেমন তারা পড়াশুনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের স্মৃকিশক্তিও লোপ পাচ্ছে। বিশেষ করে, তাদের মস্তিস্কের বড় একটা অংশ দখল করে নিচ্ছে ভার্সুয়াল জগৎ।

এএ/ এমজে/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি