ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘আমিই সেই মেয়ে’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৭:১৬, ১৭ অক্টোবর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

ঘিরে আছে আমাকে এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী। আমার সঙ্গে স্বধৃতচিত্র (সেলফি) তোলায় ব্যস্ত সবাই। সবে শেষ করেছি আমার বক্তৃতা ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। সেই ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন এক নারী।

আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটু  মুখে বললেন, 'চিনতে পারছেন, স্যার'? দু'সেকেন্ড লাগল চিনতে। তারপর সহাস্যে বললাম, 'বেতারে নিউজিল্যান্ডের ওপর একটা কথিকা প্রচারের পরে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আপনার তখন সবে বিয়ে হয়েছে'। চোখের কোনে চিক চিক করা অশ্রুবিন্দু নিয়ে মহিলাটি স্মিতমুখে বললেন, 'আমিই সে মেয়ে' -মনে পড়লো ব্রততী বন্দ্যেপাধ্যায়ের আবৃত্তিটি।

খুব সম্ভবত ১৯৯০ সালের দিকের কথা। নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম কাজে। তখন আমি বাংলাদেশ বেতারের 'দর্পণ’ অনুষ্ঠানে 'যা না বললেই নয়'- নামে একটি পাক্ষিক কথিকামালা উপস্থাপনা করি। নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ঐ অনুষ্ঠানে 'থাকব ঢাকায়, ঘুরব বিশ্বময়' নামে একটা কথিকা পড়েছিলাম। মূল কথা ছিল- আমরা যাব নানান জায়গায়, কিন্ত আমাদের শেকড় থাকবে এ ঢাকা শহরেই।

অনুষ্ঠানটি প্রচারের পরের দিনই এই মেয়েটি (তখন তরুণীই ছিল সে) আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। শিক্ষার্থীই ছিল সে আমার। গা'ভর্তি গয়না, হাতে মেহেদী, পরনে বেনারসী শাড়ী- দেখেই বুঝেছিলাম, সবে বিয়ে হয়েছে মেয়েটির।

তার কাছ থেকে জানলাম যে, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে বিয়ের ক'দিন পরেই তার স্বামীকে চলে যেতে হয়েছে বিদেশের কর্মস্থলে। মেয়েটি আমার কথিকাটি শুনেছে এবং একটা নাম না জানা কষ্ট সে অনুভব করেছে তার প্রবাসী স্বামীর জন্য। বলতে বলতে বেনারসীর আঁচলে চোখ মুছেছিল মেয়েটি। কেন এ আর্তি তা সেও জানে না, কিন্তু পুরো কথিকাটিই সে ধারণ করে রেখেছে।

সামনে দাঁড়ানো নারীটির দিকে তাকিয়ে এই সব চিত্র সচল চলচিত্রের মতো আমার চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। 'কতদিন পরে দেখা, বলুন তো? কেমন আছেন আপনারা?' জিজ্ঞেস করলাম আমি। 'চলছে কোনও রকমে', ক্লান্ত ভাবে বলেন নারীটি। 'বিদেশে স্বামীর কাছে গিয়েছিলেন আপনি'? হেসে জিজ্ঞেস করি আমি। 'না স্যার, প্রবাসী স্বামীর ঘর করার ভাগ্য আমার হয়নি।' ক্লিষ্টহাসি হেসে জানান তিনি- সে হাসি কান্নার চেয়েও করুণ। 

'বিদেশে কাজ করে, সুদর্শন, শিক্ষিত- এমন ছেলে পেয়ে আমার মধ্যবিত্ত পরিবার আনন্দে আটখানা। নিজের সব সঞ্চয় উজাড় করে দিয়ে মা-বাবা আমার বিয়ে দিলেন। মনে কত আশা, কত স্বপ্ন- মেয়ে বিদেশে যাবে, সুখে থাকবে। ক'মাস পরেই জানা গেলো যে, ঐ ছেলেটির আগের একটি বিদেশী স্ত্রী আছে, সন্তান আছে', অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন ভদ্রমহিলা।

'এ আঘাত বাবা সইতে পারলেন না। ক'দিন পরেই তিনি আমাদের ছেড়ে গেলেন। এরপর বিধবা মা আর চারটি ছোট ভাইকে নিয়ে শুরু হলো আমার জীবন সংগ্রাম। ছোটখাটো একটা চাকুরী নিলাম, শহরের বাইরে একটা কম ভাড়ার বাসা নিলাম। তারপর দীর্ঘ পথযাত্রা। ভাইদের মানুষ করলাম। তারা চলে গেল নিজ নিজ জীবন গড়তে। নিজের দিকে আর তাকাবার সময় হয়নি। তারপর একদিন মা'ও চলে গেলেন। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম', তার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে আসে।

'কিন্তু অবাক করা ব্যাপার কি জানেন, স্যার? ঐ অল্প সময়ের চেনা-জানার মধ্যেও আমার ওকে ভালো লেগেছিল, ভালোও বেসেছিলাম আমার বিশ বছরের কুমারী হৃদয় দিয়ে', এবার তার চোখ দিয়ে জলধারা নামে। 

চোখের জলের ফাঁকেই একটি মিষ্টি হাসির ঝিলিক উঠে আসে। ‘যখন জানলাম আপনি বলবেন এখানে, তখন ভীষণ ইচ্ছে করছিল আপনাকে আবার দেখতে। কেন জানেন? আমি কখনো বিদেশে যাইনি, দেখিনি বাকী পৃথিবী- হয়তো এ জীবনে ওটা আর হবেও না- যদিও আমার বিদেশ দেখার ভারী শখ', কিশোরীর মতো লাজুক হেসে বলেন তিনি।

'কিন্তু সত্যি কথা কি জানেন স্যার, আমার বিশ বছর বয়সে আপনার লেখা আর বলা আমাকে প্রথম বিদেশ চিনিয়েছে। এবং আজও আমি আপনার রেকর্ড করা কথাগুলো শুনি। বিদেশে আমি যাইনি, যাবোও না কখনো হয়তো, কিন্ত আপনি বিদেশেকে আমার কাছে পৌঁছে দেন প্রতিনিয়ত। আমার আর কোনও ক্ষোভ নেই, স্যার'। তার চোখে জল এসেছে কি না বুঝিনি, বোঝা সম্ভবও ছিল না, কারণ আমার চোখদুটোই তখন ঝাপসা হয়ে এসেছে।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি