ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কিয়েক্টা অবস্থা!

সরদার রেজাউল করিম

প্রকাশিত : ১২:৫৯, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

মানুষের জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা থাকে, থাকতে পারে, যা একান্তই গোপন, খুবই সংবেদনশীল। এইসব ঘটনা কাউকে বলা যায় না, কারো সাথে শেয়ার করা যায় না, একান্তে গুমড়িয়ে গুমড়িয়ে বহন করতে হয়। কাউকে বললেও সে এগুলোর প্রতিক্রিয়া বা চাপ অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। তেমনি একটা ঘটনা আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। যেহেতু ঘটনা অনেক আগের এবং সব বিষয় তামাদি হয়ে গেছে, উপরন্ত ঘটনার নায়ক বা খলনায়ক যাই বলি না কেন তিনি আর দেশেই থাকেন না, তাহলে মনে হয় বলতে অসুবিধে নেই। 

১৯৯৫ সাল। আমি তখন ঢাকায় একটা প্রাইভেট করপোরেট অফিসে চাকুরি করি। ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের পূর্বপাশের বাড়িটা আমার অফিস। চিটাগাং থেকে কেউ গেলে সময় করে দু’টাকার টিকেট কেটে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর দেখিয়ে আনি। তখন দু’সপ্তাহ পর পর বাড়ি আসতাম। সাথেই সোবাহানবাগে চিটাগং এর তখনকার দিনের সবচেয়ে ভালো বাস ‘দ্রুতি সার্ভিসে’র গাড়ি ছাড়ে। আমার জন্য সুবিধাই হয়েছে। অফিস করেই পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার বাস ধরতে পারলে রাত সাড়ে দশটা, এগারোটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়, ভাড়া ১৫০ টাকা, তাই কোন টেনশন নাই।

একদিন বৃহস্পতিবার এভাবেই বিকাল পাঁচটার বাসে উঠে বসি। মাথার উপর মালামাল রাখার ব্যাকেটে আমার সেই ঐতিহাসিক ব্রীফকেস। ঐতিহাসিক বলছি এ কারণে যে, আমি যখন ১৯৮৭ সালে বিসিক এ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে জয়েন করি এবং আগ্রাবাদ বিসিক ভবনে বসি তখনই প্রথম রোজার ঈদের সময় ঈদের বোনাস পেয়েছি এক বেসিক= ১৬৫০ টাকা। সেই টাকা পুরোটা দিয়ে বিসিক ভবনের সামনে তখন যে ঝুপড়ি ঘরের মার্কেট ছিল (দুবাই মার্কেট) সেখান থেকে এই ব্রীফকেসটি কেনা হয়।

কথিত আছে যে, ঐ মার্কেটে বিদেশি সব জিনিসপত্র পাওয়া যেত, সত্য মিথ্যা জানি না, কিন্তু আমার ব্রীফকেসটা পেয়েছিলাম একদম অরিজিনাল জাপানি। ভিতরে জাপানি সীল ছাপ্পর মারা। আজ প্রায় ৩৩ বছর হয়ে গেল, এখনো ব্রীফকেসটা আগের মতোই আছে। এখন ব্যবহার হয়না কেউ এ জাতীয় ব্রীফকেস এখন ব্যবহার করে না বলেই। তো, আজ বাসের ব্যাকেটে রক্ষিত এই ব্রীফকেসের ভিতরে আমার বাবার সারা জনমের পরিশ্রমের ফল, তাঁর রিটায়ারমেন্টের সকল চূড়ান্ত হিসাব নিকাসের দু’টি চেকসহ আমার বাবার চাকুরির সার্ভিস বুক। 

বাবা তখন সীতাকুণ্ড উপজেলার এলজিইডিতে কাজ করতেন, চাকুরি আরও প্রায় ৫/৬ বছর আছে। কিন্তু তখন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসাতে অনেক নতুন রাজনৈতিক কর্মী কন্ট্রাক্টর হিসেবে উপজেলায় কাজ শুরু করেন। তো, বাবার ডিপার্টমেন্টে সকল উন্নয়ন কাজ। এতে স্থানীয় নতুন কন্ট্রাক্টরগণ বাবার সমনে কাজের জন্য যেতে সমিহবোধ করতেন, অনেক সময় বাবাও বিব্রতবোধ করতেন। তো, পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হলো যে, বাবার এখন আর চাকরি করার দরকার কি! 

তাই তিনি স্বেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে দিলেন এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় তাঁর ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্সসহ সকল ফাইলপত্র, সার্ভিস বুক, আমাকে পাঠিয়ে লালমাটিয়ায় এলজিইডি হেড অফিসে তাঁর এক পরিচিত জনের কাছে আমাকে যোগাযোগ করে তাঁর ফাইনাল পেম্যান্টগুলো নিয়ে আসতে বলেন এবং আমি সেই মোতাবেক আব্বার সকল কাজকর্ম শেষ করে আজ দুটো চেকের মাধ্যমে প্রাপ্ত আব্বার সারা জীবনের জমানো সবকিছু আমার সেই ব্রীফকেসের ভিতরে নিয়ে মনে মনে খুবই উৎফুল্ল হয়ে বাড়ী ফিরছি। আসলে সারাজীবন আব্বা আমাদের জন্য যা করেছেন আমরা কেউ তার ছিটেফোঁটাও তাঁর জন্য করতে পারবো না কখনো। তাই তাঁর এ কাজটুকু আমি করতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত। বিশেষ করে, কষ্ট করে ঢাকায় আব্বাকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি, আমিই তাঁর সব কাজ শেষ করতে পেরেছি- এটা আমার জন্য পরম সুখের। তাই মনে মনে মহা খুশি।

যাত্রাপথে অনেকটা ঝিম মেরে ছিলাম। সাধারণত, ফেনী পার হলেই মনে হতো চিটাগাং এসে পৌঁছেছি। তাই ফেনীর পরে আর ঝিম মেরে বসে থাকা যায় না, ভিষণ উৎসুক্য কাজ করে। বসে বসে অন্ধকার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ পিছনের সিটের দুই ভদ্রলোকের কথা কানে এলো। তারা বেশ জোরেই কথা বলছিলেন, শুনতে না চাইলেও শুনতে হবে এ রকমই। হঠাৎ একজনের কথা বুঝতে পেরে কান খাড়া করলাম। শুনলাম তিনি চিটাগাং কমার্স কলেজের অধ্যাপক এবং মিরেরসরাই নিজামপুর কলেজের এক ষ্টান্ড করা ছাত্রের ভগ্নীপতি। এবার তাকে আমি ভালো ভাবে, খুব ভালো ভাবে চিনলাম, তিনি,,,,,,। না, থাক, নামের দরকার নেই। শুধু এটুকু বলি, তিনি একসময় সীতাকুণ্ড কলেজেও ছিলেন একাউন্টিং এর শিক্ষক  হিসেবে, এখান থেকে তিনি কমার্স কলেজে। 

শুধু এটুকু বুঝেই মনে মনে তার প্রতি আমার একরাশ ঘৃণার উদ্রেক হলো। কারণ আমাদের বাড়ির একজন, যিনি আজীবন একজন সৎ লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি তখন কমার্স কলেজের কর্মচারি ছিলেন। তাকে এই শিক্ষক সাহেব সামান্য চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এবং শিক্ষকের প্রভাব খাঠিয়ে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন। যদিও কলেজের সবাই তাকে চিনতেন কিন্তু একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পক্ষে তখন কেউ প্রতিবাদ করেননি। যা হউক, সেখানে তদন্ত কমিটি হলো এবং তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন এবং চাকরিতে আবার বহাল হয়ে পরে নিয়ম মোতাবেক অবসরে গেছেন। তো, এই ব্যক্তির জন্যই এটা হয়েছে মনে মনে ভেবেই আমি তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলাম। তিনি ঠিক আমার পিছনের সিটে ছিলেন এবং মিরসরাই কমলদহ নামক জায়গায় তিনি তার ব্যাগ ও ব্রীফকেস নিয়ে নেমে গেলেন। বিপত্তি বাজলো তখন যখন আমি সীতাকুণ্ডে নামার সময় আমি দেখলাম আমার ব্রীফকেসটি নেই, সেই জায়গায় অপেক্ষাকৃত ছোট একটা ব্রীফকেস পড়ে রয়েছে! 

হটাৎ আমার মাথাটা অন্ধকার হয়ে গেলো! কার সাথে ব্রীফকেস বদল হলো? তার সাথে না অন্য কারো সাথে!  মনে মনে চিন্তা করলাম, কুমিল্লায় নাস্তা খেয়ে ছাড়ার পর গাড়ি আর কোথায় থেমেছে বলে মনে পড়ছে না। গাড়ির সুপারভাইজারও বললেন গাড়ি আর কোথাও থামেনি, অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি প্রফেসর আমার ব্রীফকেস নিয়ে গেছে তারটা ফেলে! এত রাতে কি কইতে ইচ্ছে করে? তার বাড়ি এখানে নয়, তার ঠিকানা বা কোথায় কার বাড়িতে তিনি বেড়াতে গেছেন কিছুই জানি না। শুধু  একটা মাত্র সূত্র আছে- তার শ্যালক কয়েকবছর আগে নিজামপুর কলেজ থেকে ষ্টান্ড করছে। কাকে কি বলবো! বাবাকে কি বুঝ দেব কিছুই মাথায় আসছে না। বাবার সারা জীবনের সঞ্চয়, তার চাকুরির সার্ভিস বুক, সবকিছু তার মধ্যে! আমার কোথাও ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে! এত রাতে কোথায় যাব, কার কাছে সাহায্য চাইবো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। 

সেই ছোট্ট ব্রীফকেসটা নিয়ে টলতে টলতে বাড়ির পথ ধরলাম। জানি, মা পথ চেয়ে বসে আছেন, বাবাও ঘুমাবেন না আমি না যাওয়া পর্যন্ত। বউ মেয়েদের কথা তখন আমার মাথায় নেই,,,,। বাড়ি পৌঁছে মায়ের সাথে দেখা করে, আব্বার সাথে দেখা না করেই পরিশ্রান্তের দোহায় দিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। রুমে ঢুকেই বউকে ইশারা করলাম কোন কথা নয় এখন, ঘুমাবো। কি খেলাম না খেলাম, দ্রুত বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারারাত দু’চোখ এক করতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছে সেই প্রফেসর নিলে কালকে তাকে বের করে ফেলবো, কিন্তু যদি তিনি না হন? তাহলে কে? কার কাছে যাব? শেষ পর্যন্ত যদি পাওয়া না যায় তবে আমার বাবার এতগুলো টাকার কি হবে? সার্ভিস বুকসহ সেখানে, এই কষ্ট তিনি কিভাবে মেনে নেবেন? সারা জীবন তাঁর উপর দিয়ে চলে গেলাম, এখন তাঁর এই বয়সে আমার কারণে তিনি এত বড় কষ্ট কিভাবে সহ্য করবেন! 

সারারাত একদম ঘুমাতে পারিনি। খুবই ভোরে উঠে পড়লাম। মুরাদপুর বাজারে দেখি একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, পরিচিত, গ্রামের ছেলে। উঠে পড়লাম, বললাম- চল। তারপর মিরসরাই কমলদহ গিয়ে শুধু যেটুকু তথ্য আমার কাছে আছে সেটুকু ব্যবহার করলাম, একজনকে বললাম,  ভাই, এখানে কয়েকবছর আগে নিজামপুর কলেজ থেকে একটা ছেলে স্ট্যান্ড করছে, তাদের বাড়ি কোনটা? স্ট্যান্ড তো সবসময় করে না, আর তখন স্ট্যান্ড এর কদর ছিল, মানুষ গুরুত্ব দিতো, মনে রাখতো। তিনি চিনলেন এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে যথাযথ পথনির্দেশ দিলেন। আমি এক বুক আশা এবং আশংকা নিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছি। যদি তিনি আমার ব্রীফকেস না আনেন বা যদি অস্বীকার করেন! কারণ স্বার্থের জন্য তিনি কি করতে পারেন সেটা আমার ভালো জানা আছে। খুব সকালেই আমি প্রফেসরের শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে গেলাম এবং ট্যাক্সি থেকে নেমে জানতে চাইলাম এখানে কালকে কোন মেহমান আসছে কিনা ঢাকা হতে! 

খবর দেয়ার সাথে সাথে একদম ভিতর বাড়ি থেকে সেই প্রফেসর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন, তাকে দেখেই এবং বুঝেই মাথা আমার সপ্তমে উঠে গেল! সে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছে, আর সরি সরি বলছে! আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে গেল, তখনই তার স্ত্রী এসে স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে আমার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে হাতজোড় করে ধরে আমি আপনার ছোট বোন বলে কয়ে আমাকে এক প্রকার জোর করেই তিনি তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার তখন দম বের হবার মতো অবস্থা! মাঝে মাঝে মনে হয় মহান সৃষ্টিকর্তা মহিলাদের মধ্যে কেমন গুণ দিয়ে পাঠিয়েছেন, সেই মহিলা একদম ছোট বোনের মতো আমার সামনে পায়েসের পেয়ালা ধরে বিনয়ের সাথে খাবার জন্য অনুরোধ করছেন। তার স্বামীকে আর আমার কাছে আসতে দেননি। জোর করে পায়েস খাওয়ালেন তিনি। 

ব্রীফকেসটা সামনে এনে রাখলেন। বললেন, ভাইয়া খুলে দেখুন সব ঠিক আছে কিনা, আমরা খুলিনি কিন্তু।  তারপর তার স্বামী আসলেন সামনে, আবারও সরি বললেন, বললেন খুব উত্তেজিত ছিলাম কাল, তাই খেয়াল করিনি। আমি তার মুখের দিকে তাকাতে তার স্ত্রী বললেন, ভাইয়া, আমাদের ব্রীফকেসে চারটা আমেরিকার ভিসা আছে। কালকে ভিসাগুলো হয়েছে, সে ভিসা পেয়েই হুশ জ্ঞান হারিয়ে নিজেরটা রেখে আপনার ব্রীফকেস নিয়ে এসেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না দয়া করে।
 
কি আর করা, আমি আমার ব্রীফকেস নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। কথা হলো তারা আজই চিটাগং চলে যাবে, সীতাকুণ্ডে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আমি তাদের ব্রীফকেস রেখে যাব, তারা যাবার পথে সেখান হতে তাদের ব্রীফকেস নিয়ে যাবে। আমি ব্রীফকেস নিয়ে বাড়ি ফিরলাম, দেখি কেউ তখনও  ঘুম থেকে উঠেনি। আমি আস্তে করে ব্রীফকেস নিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। বউ তো হতভম্ব! রাতেও তাকে কিছু বলিনি। ভোরে উঠে কোথায় গেছি সেটাও জানে না। তখন শুধু তাকেই বিষয়টা জানিয়েছি, এখন পর্যন্ত আর কেউ জানে না। কিন্তু কতদিন আর নিজের কাছে চেপে যাব, তাই জানালাম সবাইকে, যদি কেউ কিছুটা কোন দিক দিয়ে সতর্ক হোন!

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি