ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চিরস্মরণীয় এক মহীয়সী নারী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৩৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ঊনিশ শতকের চিন্তাবিদ ও লেখক। বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী।

ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লে­ষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়।

১১৫ বছর আগের কথা। সমাজে নারীর কোনো অবস্থান ছিল না। বাড়ির চৌহদ্দি পেরোতে পারত না তারা। তাদের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো তখনো জ্বলে ওঠে নি। সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসে এক তরুণ লেখিকা তুলে ধরলেন সমাজের বিপরীত চিত্র— নারীরাও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমাজে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নির্মম সত্য প্রকাশ করলেন মতিচূর, অবরোধ-বাসিনী, পদ্মরাগ ইত্যাদি সৃজনশীল লেখায়। তার শত বছর আগের সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবতা। নারীদের মাঝে শিক্ষা ও জাগরণের স্বপ্ন বুনতে যিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন, তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।    

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দে অভিজাত জমিদার পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষাদানে তার অনীহা ছিল। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার আদলে মেয়েরা যেন কোরআন-হাদীস পড়তে পারে এবং ধর্মাচার পালন করতে পারে, সেজন্যে তাদের আরবি ও ফারসি শিখিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বেগম রোকেয়া ও তার বোন হুমায়রা ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের রাতে মোমবাতির আলোতে তাদের বাংলা ও ইংরেজি ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখান।

কিশোরী বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী অবাঙালি খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন রোকেয়ার চেয়ে ২০ বছরের বড় ও বিপত্নীক। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের, পারস্পরিক শ্রদ্ধার। পড়াশোনার প্রতি স্ত্রীর তীব্র আগ্রহ দেখে তার লেখালেখির প্রতিভাকে বিকশিত করতে সাখাওয়াত হোসেনের ছিল নিরন্তর উৎসাহ। পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের পাশাপাশি সাহিত্য অঙ্গনে পদচারণার মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া পেয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ। স্বামীর সান্নিধ্যে তিনি ইংরেজিতেও দক্ষ হয়ে ওঠেন।

স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। ইতোপূর্বে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে অকালেই মারা যায়। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী।

সাহিত্যচর্চার সূচনা
সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘পিপাসা’। বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ১৯৫০ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা ‘সুলতানাজ ড্রিম’ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়।সবাই তাঁর রচনা পছন্দ করে।তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

জ্ঞান অর্জন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে ফরজ
ইসলাম নারীর যে অধিকার দিয়েছে তা সম্পর্কে বেগম রোকেয়া অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই এবং এটি উভয়ের জন্যেই ফরজ—এই সত্যটি তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন।

এ উপলব্ধি থেকেই ১৯০৯ সালে তিনি ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন স্বামীর মৃত্যুর পর। যার শুরুটা হয়েছিল একটি বেঞ্চ, পাঁচ জন ছাত্রী এবং শিক্ষিকা স্বয়ং বেগম রোকেয়াকে নিয়ে। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতে নেমে পড়েন। সমাজে নারী শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞা ও প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতায় একসময় ভাগলপুর ত্যাগ করতে হলো তাকে। পাড়ি জমালেন কলকাতায়। লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, জানতেন—জ্ঞান ছাড়া মুক্তি নেই। শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলে নারীরা সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না।

মনোবলই ছিল একমাত্র পুঁজি
তার বয়স তখন ৩০। কলকাতায় নতুন পরিবেশ, আত্মীয়স্বজন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি বা বাড়ির বাইরে কাজের অভিজ্ঞতাও ছিল না। একমাত্র পুঁজি ছিল মনোবল ও সাহস। তা দিয়েই নতুন করে আরম্ভ করলেন স্কুলের কার্যক্রম। এবারে দুটি বেঞ্চ, আট জন ছাত্রী। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারগুলো তখন মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরোধী ছিল।

ফলে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে বেগম রোকেয়ার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল, বাড়ির বাইরে পড়তে গিয়ে যদি মেয়েদের পর্দা নষ্ট হয়ে যায়! বেগম রোকেয়া নিশ্চিত করেছিলেন যে, তার স্কুলে কঠোরভাবে পর্দা মানা হবে এবং তা-ই হতো। তিনি নিজেও বোরকা পরে বাইরে বের হতেন।

১৯০৯ সালে তার স্বামী মারা যান। স্কুলের জন্যে তার দেয়া ১০ হাজার টাকাসহ রোকেয়ার মোট সঞ্চয় ছিল ৩০ হাজার টাকা। এ অর্থ জমা ছিল তৎকালীন বার্মার একটি ব্যাংকে। মেয়েদের স্কুল চালু হওয়ার দুই-এক বছরে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়। পুঁজিশূন্য এবং সহযোগিতাহীন এমন পরিস্থিতিতেও তিনি দমে যান নি। হারান নি তার দৃঢ় মনোবল।

গড়ে তুললেন মুসলিম নারী সঙ্ঘ
একপর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, একা বড় কাজ করা যায় না। সঙ্ঘ গড়তে হবে। নারীদের সংগঠিত না করলে এই শিক্ষালয় টিকিয়ে রাখা যাবে না। সে চিন্তা থেকেই ১৯১৬ সালে গড়ে তুললেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে মুসলিম নারী সঙ্ঘ। শিক্ষাবঞ্চিত নারীদের আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তোলাই ছিল এর লক্ষ্য। এ-ছাড়া নারী জীবনের বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি হস্তশিল্প এমনকি নারীদের শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন তিনি, যা তার দূরদর্শী চিন্তারই প্রতিফলন।  

একজন নারীকে আল্লাহর রসুল (স) যে-সব অধিকার দিয়ে গেছেন, তা আদায়ে বাস্তব জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই—সেটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। তাই ধীরে ধীরে সমাজসেবায় মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেন নিন্দা গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুৎ সকলেই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’

লালন করতেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতিনিয়ত বাধা অতিক্রম করেই সামনে এগিয়েছেন সমাজ-সংস্কারক বেগম রোকেয়া। সকল সংকটে সবসময় তিনি সমাধানের কথা চিন্তা করতেন। দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস, সাহসের সাথে নিন্দা গ্লানি অপমান সহ্য করার ক্ষমতাই এ ক্ষণজন্মা নারীর সবচেয়ে বড় গুণ। তিনি সবর করতে জানতেন। প্রতিকূলতাকে নীরব কাজ দিয়েই জয় করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—প্রতিভার মৃত্যু নেই এবং কাজের কখনো বিনাশ হয় না।

যে কয়জন ছাত্রী তার স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, তারা প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে সমাজের টীকাটিপ্পনি লোকনিন্দা জয় করে বাংলার নারী জাগরণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কলকাতা সরকারি মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, এর অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন বেগম রোকেয়ার ছাত্রী।

কর্মময় মৃত্যু
১৯৩২ সাল। বেগম রোকেয়ার বয়স তখন ৫২ বছর। রুটিনমাফিক কর্মব্যস্ত দিনের শেষে রাতে যথারীতি টেবিলে বসে লিখছিলেন। ৯ ডিসেম্বর ভোরবেলা কলম হাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

তার সেই অসমাপ্ত লেখা ‘নারীর অধিকার’। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ় সংকল্পে কাজ করতে করতে স্রষ্টার ডাকে সাড়া দেয়া—এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত! শিক্ষিত জাতি নির্মাণে প্রাণান্ত প্রয়াসের কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ মহীয়সী নারী।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি