ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

জীবন মঙ্গলময় হোক

মোহাম্মদ মাসুদ খান

প্রকাশিত : ১৮:১০, ১৪ নভেম্বর ২০২২

তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর। লেখক এমনকি নাট্যকার হিসাবেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস কেউ পড়েননি কিংবা তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র দেখেননি এমন মানুষ দূর্লভ।

সময়টা এপ্রিল, ১৯৯২ সাল। ১৭-১৮ এপ্রিল শিশু একাডেমীতে জাতীয় শিশু কিশোর সংঠন শাপলা শালুকের আসরের জাতীয় সন্মেলনের সময় নির্ধারিত হয়েছে। সন্মেলনে অতিথি হিসাবে কবি শামসুর রাহমান, নাট্যশিল্পী ফেরদৌসি মজুমদার, যাদু শিল্পী জুয়েল আইচ সহ অনেক গুণীজন কে অতিথি হিসাবে ইতোমধ্যে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

শাপলা শালুকের আসরের কেন্দ্রীয় পরিচালক ফজল-এ-খোদা মিতা ভাই আমাকে দ্বায়িত্ব দিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিককে সন্মেলনে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ দেবার জন্য। আমি তখন সংগঠনটির মহানগর পরিষদের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক। তাই আমার উপর অর্পিত গুরু দ্বায়িত্ব পালন করতে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে গেলাম সেই লেখকের বাসায়। সাথে ছিলেন ছড়াকার ওয়াসিফ-এ-খোদা। যদ্দুর মনে পড়ে দোয়েল চত্বর পার হয়ে সামান্য পুর্ব দক্ষিণে তিন চার মিনিট পথ হেঁটে কার্জন হলে পৌঁছালাম। ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকাটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত অনেক গুলো লাল ইটের ভবন গড়া। তারই একটি ভবনে শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটরের বাসা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে দরজায় কড়া নাড়লাম।  একজন মহিলা এসে দরজা খুললেন যিনি সম্ভবত ঐ বাসার সহকারী। 

তাকে জিজ্ঞেস করলাম স্যার আছেন? মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন তিনি। স্যার সহসাই দরজায় আমাদের সামনে আসলেন। মেরুন রং এর শার্ট ও লুঙ্গী পরিহিত আর হাতে সিগারেট। তিনি আমাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলেন, তৎক্ষণাৎ আমরা সন্মেলনে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণের একটি পত্র তাঁর হাতে তুলে দিলাম। কবি ও গীতিকার ফজল-এ-খোদা’র নিজ হাতে লেখা পত্র খানা খুলে তিনি দরজায় দাঁড়িয়েই পড়া শুরু করলেন, সাথে সাথে না সুচক মাথা নাড়ছেন। এক মিনিটের মধ্যে পড়া শেষ করে কোন রকম ভনিতা না দেখিয়ে সরাসরি বললেন, ‘তোমাদের সন্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারবো না’, এমন কথা শুনে আমরা হতাশ হলাম। তখন ওয়াসিফ-এ-খোদা ভাই ফজল-এ-খোদা’র লেখা ‘নামে যার কেঁপে ওঠে’ নামক একটি কবিতার বই তাঁর হাতে দিলেন। বইটি দেখে তিনি বললেন ‘এই বই দিয়ে আমি কি করবো ?’  স্যার বইটি আপনাকে আমাদের পরিচালক ফজল-এ-খোদা উপহার দিয়েছেন- আমি উত্তর দিলাম। ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে আমি বইটি পড়বো, ওনাকে আমার সালাম দিও, তোমরা এখন যাও, আমার ক্লাস আছে।’  

পাঠকগণ এতক্ষণ নিশ্চই বুঝে গেছেন কে এই মানুষটি? হ্যাঁ তিনি স্পষ্টভাষী মানুষ গল্পের যাদুকর অমর কথা সাহিত্যিক লেখক হুমায়ুন আহমেদের কথাই বলছি।     

আরেক দিনের কথা। রমজান মাস ও একুশে বই মেলা একই সময় পড়েছে। সময়টা ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। ইফতারির পর মেলায় অপেক্ষাকৃত কম দর্শনার্থী। তবে লক্ষ্য করলাম দুটি স্টলে অসম্ভব ভীড়, যে স্টল দুটির অবস্থান পুকুরের উত্তর পাড়ে। কৌতূহলবশত সেখানে গিয়ে দেখি স্টল দুটিতে লেখক হুমায়ুন আহমদের বই বিক্রি হচ্ছে। একটি তে আবার স্বয়ং হুমায়ুন আহমেদ বসে আছেন আর তাঁর ভক্ত ও পাঠকগন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন প্রিয় লেখকের একটি অটোগ্রাফ নেবার জন্য। আমিও সেই দলে শামিল হলাম। হুমায়ুন আহমেদ যে স্টলে বসে আছেন তার পাশের স্টল সম্ভবত পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে তাঁর লেখা উপন্যাস সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ড কিনলাম। বইটি কিনে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেবার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনি অটোগ্রাফে সবাইকে লিখছেন “একুশের শুভেচ্ছা”। অটোগ্রাফ নেবার জন্য যখন আমার পালা এলো তখন আমি তাঁর লেখা উপন্যাস সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ড তাঁর হাতে দিলাম, বইটি দেখে তিনি আমাকে বললেন “তুমি কি আমার এই বই প্রথম কিনলে?” হ্যাঁ আমি উত্তর দিলাম, তবে অবাক হলাম কিভাবে তিনি বুঝলেন যে আমি তাঁর লেখা বই এই প্রথম কিনেছি। 

তিনি যখন বইটিতে অটোগ্রাফ দিতে যাবেন তখন আমি তাঁকে থামালাম এবং বললাম “স্যার একুশের শুভেচ্ছা” এই কথা লিখবেন না”। আমার কথা শুনে হুমায়ুন আহমেদ কিঞ্চিৎ অপ্রস্তত হয়ে আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?” “কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ি না” আমার উত্তর , তারপর জিজ্ঞেস করলেন “তোমার নাম কি?”  “মাসুদ” আমি বললাম। সিগারেটে ফুঁক দিয়ে কিছুক্ষন ভেবে প্রিয় লেখক লিখলেন, ‘মাসুদ - জীবন মঙ্গলময় হোক -  হুমায়ুন আহমেদ ১৩/০২/৯৫।’ 

জীবন্ত কিংবদন্তী লেখকের সাথে কথা বলতে পেরে, সাথে অটোগ্রাফ নিয়ে আনন্দে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম কিভাবে তিনি বুঝতে পারলেন যে আমি তাঁর লেখা বই প্রথম কিনেছি। পরে অবশ্য বাসায় ফিরে রহস্যের জট খুলেছে যখন ছোট ভাই শিপু বললো ‘ভাইয়া হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস প্রথম খণ্ড কেনো কিনলি? এই খণ্ডের সবগুলো উপন্যাসই আমার পড়া”। বুঝলাম কেনার সময় ভীড়ের মধ্যে বিক্রেতা প্যাকেটে ভুল করে দ্বিতীয় খণ্ডের বদলে প্রথম খণ্ড দিয়ে দিয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় খণ্ডের কাভার দেখতে প্রায় একই রকম বলে আমিও ব্যাপারটা কেনার সময় বুঝতে পারিনি, আর হুমায়ুন আহমেদও প্রথম খণ্ড দেখেই অনুমান করেছিলেন যে আমি তাঁর লেখা বই প্রথম কিনেছি।

গত ১৩ নভেম্বর ২০২২ ছিলো কালজয়ী এই মহান লেখকের ৭৪ তম জন্ম বার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক, গল্পকার, নাট্যকার ও চলচিত্রকার হুমায়ুন আহমদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর পরকালীন জীবন মঙ্গলময় হোক, এই কামনা পরম করুনাময়ের দরবারে। 

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি