ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

দাফন সেবায় নতুন মাত্রা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৪৮, ৩ ডিসেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৫:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

করোনাকালে মানবিক বিপর্যয়ের এক নতুন রূপ দেখা গিয়েছে। করোনা আক্রান্ত প্রিয়জনকে ঘর থেকে বের করে দেয়া, তাকে ত্যাগ করা, মারা গেলে সেই লাশ ফেলে চলে যাওয়াসহ অনেক হৃদয় বিদারক ঘটনা জানা গিয়েছে। এখনো অনেকে করোনা রোগের চেয়ে করোনা আতংক রোগে বেশি ভুগছেন। এমন অবস্থায় দাফন সেবা নিয়ে এগিয়ে আসে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। করোনায় যখন মৃত স্বজনকে ফেলে অনেকেই চলে গিয়েছেন, অনেকেই যখন মৃতদেহের কাছে আসতে ভয় পেয়েছেন ঠিক তখনই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা পরম মমতা নিয়ে সেই লাশের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তার শেষযাত্রাকে সম্মানজনক করে তুলেছেন।

সম্প্রতি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন শুধু করোনা আক্রান্ত নয়, যে কোনো কারণে মৃত মানুষের পাশে থাকার উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকায় এবং দেশে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে মৃত মানুষদের জন্য হাম্মাম বা গোসলখানা। যেখানে একজন মৃত মানুষকে গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে পরম মমতায় তাদের শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ এই সেবা পেতে পারেন এবং এরজন্য কোনো রকম ফি নেয়া হয় না। একেবারেই বিনা পয়সায় এই সেবা দিতে তারা প্রস্তুত। 

সম্প্রতি ৩০ নভেম্বর ২০২০ এমন একটি হাম্মাম উদ্ধোধন করা হলো ঢাকার কাকরাইলে ওয়াইএমসিএ-এ ভবনে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ওয়াইএমসিএ-র প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করেন। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন রিভ গ্রুপের গ্রুপ সিইও এম. রেজাউল হাসান। এর আগে ঢাকায় বনশ্রীতে কোয়ান্টামের প্রথম হাম্মাম উদ্ধোধন করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিধি মেনে হাসপাতাল বা বাসায় গিয়ে মৃতদের গোসল এবং ওযু করিয়ে কাফনের কাপড় পরানোর পর ডব্লিউএইচও-র নির্ধারিত বিশেষ ব্যাগে লাশ প্যাকেট করে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় সরকার নির্ধারিত কবরস্থান, শ্মশান বা নির্ধারিত সমাধিস্থলে। এরপর সাধারণ মরদেহের মতো যথাযথ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। আন্তরিক দোয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সৎকার কাজ।

২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৮৪ জনের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছা দাফনকর্মীরা। এর মধ্যে মুসিলম ২ হাজার ১০২ জন, সনাতন ৩৪২ জন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২০ জন এবং সমাধি করা হয় ২০ জনকে।

ঢাকাসহ সারাদেশে ফাউন্ডেশনের নিবেদিত ও প্রশিক্ষিত প্রায় ৭৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী অংশ নেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই স্বেচ্ছাসেবক সংখ্যা ৫১১ জন। সারাদেশকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে সেবা কার্যক্রম চালান স্বেচ্ছাসেবকরা।

দাফনকালে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় ১৫ ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী এবং মরেদেহের জন্যে প্রায় ৩০ ধরনের সামগ্রী প্রয়োজন হয়। করোনায় মৃত মহিলাদের জন্যে মহিলা টিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যে আলাদা আলাদা টিম রয়েছে।

দাফন কাজে সেবার জন্যে এ পর্যন্ত নিজস্ব ৩টি অ্যাম্বুলেন্স ও ৩টি ফ্রিজিং ভ্যান যোগ হয়েছে।

করোনা দাফন ও সৎকার কাজের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, সেফটি গ্লাস, ফেস শিল্ড, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, হেভি গ্লাভস, নেক কভার ও মরদেহের কাফনের কাপড় সবকিছুই কোয়ান্টামের নিজস্ব অর্থায়নে সংগ্রহ করা হয়। মরদেহ বহনের জন্যে বিশেষ বডি ব্যাগসহ সুরক্ষার জন্যে তিন ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়।

প্রতিটি মরদেহ দাফন বা সৎকারের পর সুরক্ষার জন্যে পিপিইসহ পরিধেয় অন্যান্য সামগ্রী কবরস্থানেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। করোনায় মৃতদের দাফনে সুরক্ষা উপকরণ সংগ্রহসহ পুরো প্রক্রিয়াটিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মান অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়।

রাজধানীর কাকরাইলস্থ কোয়ান্টাম দাফন কার্যক্রমের পক্ষ থেকে তদারকি করা হয় সারা দেশের দাফন কার্যক্রম। স্বেচ্ছাসেবকরা নিজের ঘর, সংসার, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন করোনায় মৃত লাশ দাফনে। যথাযথ নিরাপত্তা প্রস্তুতি নেয়ার ফলে এবং সকলের দোয়ায় এ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীরা সবাই সুস্থ ও সুরক্ষিত আছেন।

৭ জুন ২০২০ ঢাকার মুগদা হসপিটালে করোনায় মারা যাওয়া দুইজনের জানাজা পড়াচ্ছেন কোয়ান্টাম কর্মীরা। এসময় নিকটজনরা কাছে আসতেও ভয় পেতেন।  

দাফন সেবার সাথে জড়িত স্বেচ্ছাসেবকরা বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন পেশার। এখানে রয়েছে ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিনী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ নানা পেশার মানুষ। সবারই একটিই উদ্দেশ্য- একজন মানুষের শেষ বিদায়ে তার পাশে থাকা, তাকে মমতার সাথে বিদায় দেয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, ‘সৎকারকাজে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, আগে কোনো বিদায় স্টোরের পাশ দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় মনে মনে ভয় লাগত। আর এখন নিজেই কাফনের কাপড় প্রস্তুত করি। মৃতদেহ গোসল করানো, সৎকার করা এখন নিত্যদিনের কাজ। আসলে করোনার এই সময়ে একজন মৃতকে শেষ সম্মান জানানোর এমন কাজে যোগ দিতে পেরে সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও তৃপ্তি পাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, ২০০৪ সাল থেকে বেওয়ারিশ লাশসহ মৃতের সম্মানজনক শেষ বিদায় জানাতে কাজ করছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। ২০২০ সালে মার্চের ২৭ তারিখ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মানবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা কোভিড-১৯ দাফন কার্যক্রম শুরু করেন।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি