ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি জাতি: বঙ্গবন্ধু

প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক

প্রকাশিত : ১১:৫৪, ৩ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৯:০৬, ৬ আগস্ট ২০২১

বাংলাদেশের মানুষ একটা জাতি, কারণ তারা একটা জাতি হতে চায়, অন্য কিছু নয়। জাতি হিসেবে মৃত বা জীবন্ত ঐতিহ্যের যা-কিছু তাকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করেছে, তার কোন তালিকা এই জাতিসত্তাকে ব্যাখ্যা করতে বা অস্বীকৃতি দিতে পারে না।

এই জাতিকে তৈরি করেছে তার অনমনীয় গর্ব, সুখে-দুঃখে আট কোটি মানুষের সঙ্গে একই পরিচয় বহন করা, অন্য কিছু নয়, শুধু বাঙালি হতে চাওয়ার জেদ।

একজন জ্ঞানী গ্রিকের মতে, দেশপ্রেম হচ্ছে পাহাড়-নদী ঈশ্বর প্রদত্ত প্রকৃতি এবং জনগণসহ নিজের দেশকে ভালোবাসা। কোন পুরুষ একজন নারীর প্রেমে অথবা একজন নারী অপর পুরুষের প্রেমে এই কারণে পড়ে না যে- সেই বিশেষ নারী বা পুরুষটি হচ্ছে তাদের নিজ নিজ প্রজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু তবুও নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে পড়ে এবং তাদের জীবনের সবচেয়ে মহান কাজ সূচিত করে।

অ্যাসিরীয়, কালদীয়, মিসরীয়, গ্রিক, রোমান, আরব, ইরান বা ইদানিংকালের লাল রাশিয়ার অবদান, যার প্রকৃতি নিয়ে মস্কো ও পিকিং এমনকি ঢাকাতেও উত্তপ্ত বিতর্ক রয়েছে, যেসব ঐতিহ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে খুব বেশি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। এদের সঙ্গে যৌথভাবে বা আলাদাভাবে তুলনা করলে আমাদের জাতির দেয়ার মতো কিছুই নেই।

তথাপি যা আমাদের একত্রে ধরে রেখেছে, পরিণত করেছে এক জাতিতে, তা হচ্ছে আমাদের শুধু এই জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার ঐকান্তিক কামনা। এটাই আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকে আমাদের যুগের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। জাতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে, জাতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিচার করতে, যে চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুর মতো আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের পিছন কাজ করেছে, তার গভীরে যাওয়া প্রাসঙ্গিক।

কি কারণে তিনি জাতির জীবনে দাগ কাটতে পেরেছেন? বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার পেছনে তার দাবিগুলো কি? যাই করুন না কেন, বঙ্গবন্ধু কেন সেগুলো করেছিলেন? কেন মানুষটি তার নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে এত অসচেতন ছিলেন? সামান্যতম সতর্কতা দিয়েই করুণ পরিণতির মধ্যে সমাপ্ত এই নিচুস্তরের নির্মম নাটককে এড়ানো যেত। কিন্তু নাটক কি শেষ হয়েছে? এই জাতির বিশ্লেষণ এই বিষয়টি সবাইকে যত্নের সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। 

অবশ্য যত উঁচুদরের বীরই হোন না কেন, কেউই দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়ে বীর থাকে না। এই ব্যতিক্রমটি বাদে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমে বিহ্বল ছিলেন। দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে যত ব্যাপক করে তোলা যাক না কেন, বঙ্গবন্ধু ততখানিই তার দেশকে ভালোবাসতেন। যে প্রেম তাকে বিহ্বল করেছিল, তা দেশের প্রতি যে হালকা আবেগ আমরা অনুভব করি এবং যাকে দেশপ্রেম হিসেবে চালিয়ে থাকি, তার থেকে অনেক বেশি আলাদা।

বঙ্গবন্ধু একজন ভালো মুসলমান, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় বিশুদ্ধবাদী মুসলমান ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি মুসলিম লীগের একজন অনুগত সদস্য ও পাকিস্তান সৃষ্টির ধারণার সোৎসাহী সমর্থক ছিলেন এবং এই ধারণাকে বাস্তবায়িত করতে কাজে অংশগ্রহণও করেছিলেন। শেষের অনেক আগেই তিনি তার অন্তিম এবং চিরন্তন ভালোবাসার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলেন। পৃথিবীর সেই ছোট্ট অংশটার প্রেমে তিনি বিহ্বল ছিলেন- যার নাম হচ্ছে বাংলাদেশ।

এ ধরনের ভালোবাসা বিপজ্জনক হতে পারে। বঙ্গবন্ধুই তার প্রমাণ। এ ধরনের আবিষ্ট বিহ্বল ভালোবাসা একজনকে অন্ধ করে তোলে, বিশেষ করে সেই ভালোবাসার প্রতিদান পাওয়ার সময়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত যে সময়ে দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। 

বঙ্গবন্ধু এবং শুধু বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক- যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকরা একসঙ্গে জড় হয়েছিল। কিন্তু এটা কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না। ওই অন্ধকার দিনগুলোতে, ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি জনতা, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে লুকানো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক। 

এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস তার আগে অন্যান্য আরও প্রতীক ছিল। কিন্তু ১৯৭১-এর প্রতীক এবং তার আগের প্রতীকগুলোর মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে। শুধু দুটো উদাহরণ নেয়া যাক। গান্ধী এবং জিন্নাহ। দু’জনের প্রত্যেকেই কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। 

জিন্নাহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, যুক্তিতে দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ জননেতা, যিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে উদ্দেশ্য সঠিক মনে করেছেন তার পক্ষে কাজ করেছেন এবং তাকে প্রায় সফল পরিণতিতে নিয়ে গেছেন। পরিপাটি নয় এমন কোন আবেগ, যেমন প্রেম জিন্নাহকে প্ররোচিত করবে- সেটা ভাবা বেশ কঠিন।

গান্ধী ছিলেন আলাদা। তিনি প্রেমের কথা প্রচার ও প্রতিপালন করেছেন। অবশ্য তার কাছে প্রেম ছিল ধর্ম- সব মানুষের ধর্ম। তিনি ছিলেন সর্ব বিশ্বের। এটা একটা নেহায়েত দুর্ঘটনা যে, তিনি ভারতীয় ছিলেন। তার গভীর ধর্মীয় চেতনাকে বাদ দিয়ে তার রাজনীতির পর্যালোচনা করা অর্থহীন। জাগতিক অনেক কিছুই তিনি করেছেন। আর কখনই রাজনীতির তিনি বাইরে ছিলেন না। কিন্তু তিনি যাই করুন না কেন, তা করেছিলেন ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে। একান্ত ইতিবাচক অর্থে তিনি ছিলেন একজন মধ্যযুগীয় মানুষ। জাগতিক জীবন যদিও আকর্ষণীয়। 

উভয়েরই ছিল কোটি কোটি ভক্ত। এইসব জনতার কেউই গান্ধী বা জিন্নাহকে তাদের নিজেদের একজন বলে ভাবতে পারত না। এটাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিন্নাহ বা গান্ধীর পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু জাতি আর তার নিজের মধ্যে একটা অবিভাজ্য মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশকারী এই কোটি কোটি জনতা যারা কার্যক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল না, তাদের মিল ছিল কোথায়? এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় জাতি-পরিচয়ে আত্মবিলুপ্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এই জনতাই পাকিস্তানি জাতি সৃষ্টির উন্মাদনার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল। এটাই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সারবস্তু।

ব্যাপার এমন ঘটেছিল, যারা ভারতীয় এক জাতিসত্তার নিজেদের বিলীন করতে চাননি, তারা ছিলেন মুসলমান। অবশ্য পাকিস্তান ধারণার এটাই মুখ্য বিষয় ছিল না। এ কারণেই দেখি শাসনতান্ত্রিক পরিষদে জিন্নাহর প্রথম ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে এখানকার জনগণ আর হিন্দু-মুসলমান বা খ্রিস্টান নয়। এখন থেকে সবাই পাকিস্তানের নাগরিক।

দেখা গেল, ১৯৭১ সালের মধ্যে এই জনগণেরই এক ব্যাপক অংশ আর পাকিস্তানি জাতিসত্তার ভেতর নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে রাজি নয়। পাকিস্তানি বা ভারতীয় জাতি থেকে পৃথক একটা সত্তা বজায় রাখার ইচ্ছার মধ্যেই। আমার মতে, রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭১ সালের এ দেশের সংগ্রামী জনসাধারণের প্রকৃত মিল। 

ইংরেজ, ফরাসি এবং অন্য ইউরোপীয়রা সমগ্র ইউরোপকে এক জাতিতে পরিণত করার হিটলারি অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন। কোন একদিন হয়তো সমগ্র ইউরোপ মিলে এক জাতি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে ইউরোপককে এক জাতি ধরে চিন্তা করলে ইউরোপের বাস্তব অবস্থা অনুধাবনে আমাদের তেমন কোন সুবিধা হবে না। মূল সমস্যা প্রধানত রয়েছে ইংরেজ, ফরাসি বা ইতালীয় সমস্যা হিসেবে। এইসব পৃথক সত্তার শ্রেণী চরিত্র এক হলেও স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট।

প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। এই উপমহাদেশের সমগ্র অঞ্চল বা কোন বিশেষ অংশের সঙ্গে ধর্ম বা সমাজের শ্রেণীগত কাঠামোর দিক দিয়ে আমাদের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচয় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের অদম্য ইচ্ছাই এসব কিছুকে অতিক্রম করেছে। এই আকাঙ্ক্ষারই প্রতীক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু এবং এটাই এই বিশেষ মানুষটি আর জনতার মধ্যে গড়ে তুলেছিল এক অবিভাজ্য মেলবন্ধন। 

বঙ্গবন্ধুর স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে তার গুণের তালিকা প্রস্তুত করা বা তার ত্রুটি-বিচ্যুতির ওপর স্ফীতবাক হওয়া অপ্রাসঙ্গিক। জনতা তাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল, কারণ তার মধ্যে তারা জাতি হিসেবে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখার যে গভীর ইচ্ছা তার বহিঃপ্রকাশ দেখেছিল। 

[১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতামালায় প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক শীর্ষক ভাষণ দেন। নাতিদীর্ঘ ওই ভাষণে স্বভাবত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু কথা বলেন। তার সেই ভাষণ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার কিছু কথা এখানে প্রকাশিত হলো। প্রফেসর রাজ্জাকের ওই ভাষণটি ছিল ইংরেজিতে। এখানে তানভীর মোকাম্মেলের অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।]

(এই লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেয়া)

লেখক: বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী।

এএইচ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি