ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘বাড়ী যাও, বাড়ী চলো’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৮:৩৪, ২২ মে ২০২০

ছ’ বছরের লেখক, অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ ও লেখক ৩মাস আগে; এবং প্রয়াত অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদের।

ছ’ বছরের লেখক, অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ ও লেখক ৩মাস আগে; এবং প্রয়াত অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদের।

বরিশালের খৃষ্টান গোরস্তানের সামনে অনেক দুপুরে আপনি কেন দাঁড়াতেন? কি ভাবতেন?’ - একজন জানতে চেয়েছিলেন আমার সাম্প্রতিক একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে। দাঁড়াতাম। কারণ, সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে আর নানান কথা ভাবতে আমার খুব ভালো লাগে। সেই খৃষ্টান সমধিস্থলটি ছিল কৈশোরে আমার এক ভাবনার জায়গা।

আসলে, সে সময়ে বরিশাল শহরে আমার বেশ ক’টি ভাবনা-স্থল ছিল - ‘ভাবনা-স্থান’ও বলা যায় তাদের। আমার কৈশোরের বহু সময় কাটিয়েছি এসব ভাবনা-স্থানে - যেখানে আমার মনে হতো, ভাবনার আকাশে সত্যিকার অর্থে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার’ মানা নেই। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’র মতো আমার কল্পনার পাখীরা ডানা মেলতে পারে ভাবনার নি:সঙ্গ আকাশে।

আমার একটা ভাবনা-স্থান ছিল জিলাস্কুলের সেই সুবিশাল সিঁড়ি। সেখানে বসে বসে আমি দেবদারু গাছের পাতার চাকচিক্য দেখতাম, নারকেল পাতার ঝির ঝিরে শব্দ শুনতাম। কোনার দিকের জামরুল গাছের নীচের চাপকলের পানি নেয়ার শব্দ শোনা যেত। সেটা পেরিয়ে চোখ চলে যেত তারিক ভাইদের একতলা বাড়ীর পেছনের পুকুরের জলে। শান্ত কালো জলের ওপরে গোলাপী শাপলারা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে থাকতো। একটি ফড়িং বারবার ঘুরে ঘুরে একটি ফুলের ওপরে বসার চেষ্টা করতো। দূরে প্রধান শিক্ষকের আবাসনের সামনে পুকুরে ফুটবল শেষে স্নানরত খেলোয়াড়দের হল্লা ভেসে আসতো। আস্তে আস্তে সূর্য্য ঢলে পড়ত গাছ-পালার ওপারে, বেড়ালের থাবার মতো কালো ছায়ার ছোপ এখানে-ওখানে, ঘরে ফেরা পাখীদের কল-কাকলী আকাশে-বাতাসে। কেমন যেন ঘোর লেগে যেত। সম্বিৎ ফিরে পেতাম মনসুর নানার ধমকে, ‘দেখতাছি, এহানে বইয়্যা আছো ঘন্টাখানেক। ব্যাফারটা কি? ওঠো, যাও বাড়ী যাও’।

আমার দ্বিতীয় ‘ভাবনা-স্থান’ ছিল স্টীমার ঘাট। খুব ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যেতাম সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা শেষে সিল-গালা করা খাতার মোড়ক পাঠাতে সেখানে যেতেন বাবা। কি সুন্দর যে ছিল বরিশাল স্টীমার ঘাট। সারা রাস্তা ধরে ঝাউ আর পামের সারি - লেডিস পার্ক আর বেলস্ পার্কের দিকে চলে গেছে। কয়লার কুচি বিছানো ঘাটের জমি দিয়ে - হাঁটলে কুচ্ কুচ্ শব্দ হয় পায়ের নীচে। মাঝে মাঝে দেখতাম ‘অস্ট্রিচ’ বা ‘গাজী’ স্টীমার ঘাটে বাঁধা। বাপস্, কি বড় তারা। ভাবতাম, কেমন করে তারা চলে, কত কয়লা খায়, এতো যে লোক ওঠে, কোথায় যায় তারা। ওই যে নথ পরা কিশোরীটি, তাকে কি আমি আর দেখবো এ জীবনে? ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোট ছোট ঢেউগুলো কূলে এসে ভেঙ্গে পড়ত। কীর্তনখোলার বিশালত্ব দেখে অবাক লাগতো। হঠাৎ করে প্রধান ডাকঘরের পেছনের বুদ্ধ নারকেল গাছের মাথায় অসংখ্য বাদুড় ‘ওঁয়াও’, ‘ওঁয়াও’ করে উঠতো। আমি ভয় পেয়ে বাবার হাত শক্ত করে ধরতাম। তিনি খুব নরম স্বরে বলতেন, ‘ভয় কি? আমি তো আছি। চলো, এবার বাড়ী চলো’।

সোনালী সিনেমা হলের সামনে এলেই এক বিশাল ভাবনা আমাকে পেয়ে বসতো - আচ্ছা, এই যে এতো ছবি দেখায়, তা কোথা থেকে আসে? আমি হলের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মূল ফটকের দু’পাশের সিমেন্টের বোর্ডে প্রদর্শিত ও প্রদর্শিতব্য ছায়াছির বিজ্ঞাপিত ছবি আঁকা দেখি। ঐ তো একদিকে ফুটে উঠছে ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবির বিজ্ঞাপন - কি যত্নে ফুটে উঠছে সুচিত্রা-উত্তমের ছবি। আমি ভাবি, কি মায়াময় তারা, প্রেমিক-প্রেমিকা তাঁরা। ছায়াছবি যে কল্পনা, তাই মনে থাকে না। যেদিন প্রথম শুনি এই সমীকরনে দীননাথ সেন বলে এক বযক্তি আছেন, আছেন গৌরী দেবী বলে এক মহিলা, তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায়। এই সব ভাবনার স্রোত যখন আমার বইছে, তখন আমার কাঁধে কার হাতের মৃদু ছোঁয়া। তাকিয়ে দেখি, বাবার বন্ধু সুকুমার কাকু (সোনালী সিনেমা হলের মালিক প্রয়াত শ্রী সুকুমার দাস। আমি কিছু বলার আগেই তিনি এক আইসক্রীমওয়ালাকে ডাকেন। আমার জন্যে দু’আনা দিয়ে কেনা হয় একটি মালাই আইসক্রীম। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মোলায়েম স্বরে বলেন, ‘রোদে থেকো না। যাও, বাড়ী যাও।’

আমাকে এক অমোঘ টানে টানতো শীতলাখোলা। বগুড়া রোড আর বি.এম. স্কুল রোডের মোড়ে এক বিশাল বটগাছের তলায় সেই বিগ্রহ। যদ্দূর মনে পড়ে একটি অবরুদ্ধ খাঁচা ছিল সে বিগ্রহের পাশে। সেটার ধার দিয়ে খাল বয়ে যেতো। শুনেছিলাম, দেবী খুব জাগ্রত। আমি দেবীর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। কি সুন্দর দেবীর চোখ, তাঁর গয়না। আমার বহু সময় কেটে গেছে ঐ ‘জাগ্রত’ কথাটা ভেবে ভেবে - তিনি তো জেগে নেই। তা’হলে কেমন করে তিনি জাগ্রত? মাঝে মাাঝে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম দেবীর দিকে। তখন ভুলে যেতাম আশ-পাশ - রাস্তার ওপারে কালীতলার কালীমূর্তির কথা, অদূরে আশ্রমের মাথার শূলের কথা, কিংবা আরেকটু এগিয়ে অধ্যক্ষ ভবনের সামনের মঠের কথা। একদিন বিভোর হয় প্রতিমা দেখছি, হঠাৎ পেছনে শুনি নারী কণ্ঠস্বর, ‘কি দেখছো, খোকা’? তাকিয়ে দেখি, কস্তা পেড়ে শাড়ী পরিহিতা, কপালে জ্বল জ্বল করা লাল বড় টিপ দেয়া, হাতে কাঁসার নৈবৈদ্যের থালা হাতে টকটকে ফর্সা রঙের এক অপরূপ নারী মূর্তি। খুব নরম গলায় বললেন, ‘বাড়ীতে যাও। মা চিন্তা করবেন’।

ব্রজমোহন কলেজের আদি দোতলা লাল বাড়ীটির নীচতলায় যেখানে অর্ধবৃত্তাকার খিলানের একদিকে ‘সত্য, প্রেম, পবিত্রতা’ লেখা, তার নীচে একটি আরামসই ফোকর ছিল। কৈশোরে সেটার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলাম আমি। ওখানে খুব আরামসে ‘দ’ হয়ে বসা যেতো। ওখানে বসেই আমি সামনের মাঠের ক্রিকেট খেলা দেখতাম, ওখানে বসেই ঝালমুড়ি খেতে খেতে আমি ‘দস্যু মোহন শেষ করেছি, ওখানে বসে বসেই আমি কলেজের খেলার কর্মচারী আনু ভা’য়ের সঙ্গে নানান গল্প করতাম। কেউ কিছু বলতে না, কিন্তু হানিফ ভাই (অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ) দেখলেই হতো বিপদ। সঙ্গে সঙ্গে বকা ঝকা শুরু হয়ে যেত, ‘এই ওখানে ঢুকেছিস, কেনো? বেরো, বেরো এক্ষুণি। দাঁড়া, আজ চাচী আম্মাকে যদি না বলেছি’ (আমার মা’কে তিনি চাচী বলতেন)। এ বছরের প্রথম দিকে বরিশালে গেলে প্রায় চার দশক পরে হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল।

আমার কৈশেরের শেষ ‘ভাবনা-স্থান’ ছিল ব্রজমোহন কলেজের হিন্দু হোস্টেলের পুকুর পাড়, সে সময়কার ১৬ নম্বর শ্রেণি কক্ষের পেছনে। প্রয়াত অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার লাগানো একটি রাধাচূড়া গাছের নীচে একটি ঘাসের আসন ছিল আমার। সেখান থকে সেই পাড় সংলগ্ন পাড়ের মাঝামাঝি কলেজ এলাকার ময়লা পরিস্কারক নারায়ন’দা আর নারায়নী’দির সংসার দেখতাম আমি। হেলে পড়া সোনা রোদে ঝকমক করতো তাঁদের খড়ের কুঁড়ে আর তার নিকেনো উঠেন। উঠেনের একদিকে ছিল এক বিরাট চালতা গাছ, পাড় ঘেঁসে। শেই গাছের বাদামী বাকলের পটভূমিতে নধর সবুজ চালতা পাতাগুলো চক চক করতো। দ্বিজেনদা’র লাগানো সব গাছের তুলনায় ঐ অর্বাচীন চালতা গাছ সবচেয়ে সুন্দর বলে মন খারাপ করে দিয়ে ছিলাম তাঁর। সেই গাছের নীচে নারান’দা আর নারানী’দি পেতলের মগে চা নিয়ে গল্প করতেন। কি যে ভালো লাগতো - সেই দৃশ্য, উল্টো পাড়ের বিশাল তেঁতুল গাছ, অদূরে বড়শী দিয়ে মাছ ধরার মাচায় উপবিষ্ট খালুজান (আব্বার নিকটতম বন্ধু ও সহকর্মী অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদের)। কেমন যেন মোহাবিষ্ট হয়ে যেতাম - কতক্ষণ যে কেটে যেত টেরই পেতাম না। ততক্ষণে ফিকে আঁধার নেমেছে চারদিকে,কেমন যেন মৌণ সারা পৃথিবী। তণ্ময়তা ভাঙ্গতো খালুজানের ডাকে। এক হাতে গোটানো ছিপ, অন্য হাতে একটি থলে। বকতেন না, খুব মৃদুস্বরে , ‘সন্ধ্যা নামছে। যা, বাড়ী যা’।

জানি আমার কৈশোরের সব ‘ভাবনা-স্থানের’ ‘মোর ভাবনারা কি হাওয়ায়’ মাতিয়েছে। সব জায়গায় সব্বাই বলেছে, ‘ভেবো না, বাড়ী যাও। এও জানি, কোন একদিন এক অমোঘ মুহূর্তে কেউ একজন আমার কাছে এসে বলবে, ‘এখানে আর বসে আছো কেন? চলো, বাড়ী চলো’।

লেখক- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি