ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

বিজ্ঞানের চোখে মেডিটেশন   

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫২, ১৭ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১০:১১, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

মেডিটেশন এর মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের গতি পথ পাল্টে দিতে পারে। অর্জন করতে পারে অনেক কিছু। গড়তে পারে সুস্থ জীবন। মেডিটেশন হচ্ছে বিজ্ঞান। এটা অলৌকিক কিছু নয় বা নয় কোনো আশ্রম, খানকা বা শ্রেণি সম্প্রদায়ের বিষয়। বরং মেডিটেশন হলো এক সার্বজনীন কল্যাণ প্রক্রিয়া। মেডিটেশন চর্চা করে নারী-পুরুষ, কিশোর-বৃদ্ধ, পাপী-পুণ্যাত্মা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক কল্যাণ লাভ করতে পারেন। গত ৬০ বছরের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটা এখন এক প্রমাণিত সত্য।   

নিউসায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে ৮ জানুয়ারি, ২০১১ সংখ্যায় মেডিটেশনের ওপর একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘এভরিবডি সে ওম’ শিরোনামের এ প্রচ্ছদ নিবন্ধে মেডিটেশন নিয়ে এ যাবৎকালের সবচেয়ে ব্যাপক গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। নিবন্ধে বলা হয়- মেডিটেশন শুধু সাধকদের জন্যে নয় বা এ থেকে উপকার লাভের জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে-কেউ মেডিটেশন করে উপকৃত হতে পারে। মেডিটেশনে সময় ব্যয় করা হচ্ছে ফলপ্রসূ সময় ব্যয়।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর মাইন্ড এন্ড ব্রেন’-এর বিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড স্যারনের নেতৃত্বে একদল গবেষক অনেকদিন ধরে মেডিটেশন করছেন এমন ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর তিন মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।

প্রথম পরীক্ষাটি ছিল মনোযোগ নিয়ে। কম্পিউটার স্ক্রিনে অনেকগুলো খাড়া খাড়া দাগ দেখিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের বলা হয়, এগুলোর মধ্যে যখনই বাকিগুলোর চেয়ে ছোট কোনো দাগ তাদের চোখে পড়বে তৎক্ষণাৎ মাউস ক্লিক করে তারা যাতে সেটাকে চিহ্নিত করে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, যত বেশি সময় গড়াচ্ছে ধ্যানীরা তত নির্ভুলভাবে ছোট দাগগুলোকে শনাক্ত করতে পারছেন।

মেডিটেশন যে মনোযোগ বাড়ায় তা অবশ্য আগের আরো বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকেও প্রমাণিত। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের পরীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত মেডিটেশন করে স্বেচ্ছাসেবীরা বিভিন্ন স্বরের পার্থক্যকে খুব সহজে বুঝতে পারছে। জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে এ গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়।

সামাথা প্রকল্পের দ্বিতীয় গবেষণাটি ছিল আবেগ-অনুভূতির ওপর মেডিটেশনের প্রভাব নিয়ে। যে প্রক্রিয়ায় গবেষণাটি চালানো হয় তা-ও খুব মজার। এর আগে স্বেচ্ছাসেবীদের যে-রকম ছোট দাগ দেখলে মাউসে ক্লিক করতে বলা হয়েছিল, এবার তাদের বলা হলো লম্বা দাগগুলোকে ক্লিক করতে।

কাজটা একাধারে একঘেয়ে, বিরক্তিকর এবং বেশ ধৈর্যসাপেক্ষও। কারণ অনেকক্ষণ ধরে আসা লম্বা দাগগুলোর পরে হঠাৎ হঠাৎ আসত ছোট দাগগুলো। একদিকে দীর্ঘ সময় ধরে লম্বা দাগে ক্লিক করা এবং ছোট দাগগুলোকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকা- মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে চাচ্ছিলেন বিরক্তি বা একঘেয়েমিজনিত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা তাদের কতটা বেড়েছে।

গবেষকদলের নেতা বালজিন্ডার সাহাদ্রা বলেন, আমরা দেখলাম, মেডিটেশন চর্চার ফলে স্বেচ্ছাসেবীদের টেনশন করার প্রবণতা কমেছে; বেড়েছে নেতিবাচক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা। মেডিটেশন একজন মানুষের রি-একটিভিটি বা মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা কমায়।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, মেডিটেশন ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তির আবেগকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এটিও প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের জার্নালে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, মেডিটেশনের ফলে সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতায়। কিছু অসুস্থতা যেমন- ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম, মাদকাসক্তি, দুরারোগ্য চর্মরোগ সোরিয়াসিস, ডিপ্রেশন এবং ক্রনিক ব্যথা সারাতে মেডিটেশনের কার্যকর ভূমিকা দেখা গেছে।

মেডিটেশন বার্ধক্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। সামাথা প্রকল্পের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশনের ফলে দেহে টেলোমেরেজ নামে একটি এনজাইমের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা কোষের বুড়িয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ-সংক্রান্ত লেখাটি এসেছে জার্নাল ‘সাইকো-নিউরো-এনডোক্রাইনোলজি’-তে।

সামাথা প্রকল্পের সবচেয়ে আলোচিত গবেষণাটি হচ্ছে, মেডিটেশন অন্যের প্রতি আবেগ-অনুভূতিকে বাড়ায় কিনা। দীর্ঘদিন মেডিটেশন করেছেন এমন ব্যক্তিদের ব্রেনের ফাংশনাল MRI করে গবেষক লাজ এবং তার সহযোগীরা দেখেন, ইনসুলা বা এন্টেরিওর সিংগুলেট করটেক্সের মতো মস্তিষ্কের যে অংশগুলো মমতা, অন্যদের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি অনুভূতিকে জাগ্রত করে, তাদের মস্তিষ্কে তা অনেক বেশি সক্রিয়। নিউরো-ইমেজ জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে।  

২০০৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে খোলা হয় সেন্টার ফর কমপ্যাশন এন্ড আলট্রুয়িজম রিসার্চ এন্ড এডুকেশন। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এই ইনস্টিটিউটের কাজ হলো মমতা সহানুভূতি সমমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক আবেগগুলোর নিউরোবায়োলজিকেল যোগসূত্র বোঝা, গবেষণা করা। এই ইনস্টিটিউটের সাথে নিউরোসায়েন্টিস্টরা যেমন আছেন, আছেন সিলিকন ভ্যালির বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এবং আছেন তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাইলামা। তাদের সবার একটাই উদ্দেশ্য। আর তা হলো, মেডিটেশন চর্চা করে কীভাবে একজন মানুষ অন্যের প্রতি তার নিঃস্বার্থ মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা সৃষ্টি করতে পারে।

আর এসব উদ্যোগের ফলেই বোধ হয় মেন্টাল ট্রেনিং জিমনেসিয়ামের মতো ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, যেখানে গিয়ে একজন মানুষ তার আবেগকে জাগ্রত করার অনুশীলন করবে, বাড়াবে তার সহমর্মিতার অনুভূতি যে-রকম সে জিমে গিয়ে বাড়াতে পারে তার পেশির কার্যকারিতা।

এসব গবেষণার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, আপনি যে-ই হোন বা যেখানেই থাকুন, মেডিটেশন থেকে আপনি উপকৃত হবেনই। আপনাকে এজন্যে মেডিটেশনে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না, দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে অনুশীলন করতে হবে না, ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলেও যেতে হবে না।

মেডিটেশনের ব্যথানিরোধক ক্ষমতার ওপর মনোবিজ্ঞানী ফিদেল জাইদানের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২০ মিনিট করে মাত্র তিন দিন অনুশীলন করেই উপকার পেতে শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। তার দ্বিতীয় গবেষণায়ও দেখা গেছে, অল্পসময়ের জন্যে একটুখানি মেডিটেশন করেই বেড়ে গেছে তাদের মনোযোগের ক্ষমতা, বেড়েছে বড় বড় সংখ্যা মনে রাখা ও বলতে পারার দক্ষতা। তার এই গবেষণালব্ধ তথ্য বেরিয়েছে কনশাসনেস এন্ড কগনিশন জার্নালে।   

প্রখ্যাত মেডিটেশন গবেষক রিচার্ড ডেভিডসন এজন্যেই বলেন, দেহ-মনের ওপর মেডিটেশনের প্রভাব এত তাড়াতাড়ি পড়ে যে, আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি, একদল নতুন মানুষ মেডিটেশন শেখার পর মাত্র দুই সপ্তাহ প্রতিদিন ৩০ মিনিট অনুশীলন করেই তার মস্তিষ্কের কর্মকাঠামোয় ঘটাতে পেরেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন।

তাই বলা যায়, মন ও মস্তিষ্কের বিশাল কর্মক্ষমতা নিয়ে এখন যে লাগাতার গবেষণা চলছে, তা থেকে প্রতিনিয়তই বেরিয়ে আসছে মেডিটেশনের ইতিবাচক ফলাফলের নতুন নতুন তথ্য।  

আমরা জানি বিশ্রাম, তন্দ্রা বা নিদ্রাকালীন সময়ে অবচেতন মন সবচেয়ে সৃজনশীল থাকে ও ভালোভাবে কাজ করে। আর বিশ্রাম বা তন্দ্রাকালীন সময় দেহ-মন পুরোপুরি শিথিল হয়ে গিয়ে ব্রেন ওয়েভ নেমে যায় প্রতি সেকেন্ডে ১৩ থেকে ৪ সাইকেলে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় আলফা/থিটা লেভেলে।

আসলে সক্রিয় অবস্থায় ব্রেন থেকে প্রতিনিয়ত খুব মৃদু বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিকিরিত হয়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ব্রেন ওয়েভ। ১৯২৯ সালে ডা. হ্যান্স বার্জার ইলেকক্ট্রো এনসেফেলোগ্রাফ (ইইজি) যন্ত্র দ্বারা এই ওয়েভ বা তরঙ্গ মাপেন। মানসিক চাপ, সতর্কতা, তৎপরতামূলক পরিস্থিতিতে ব্রেনের বৈদ্যুতিক বিকিরণ বেড়ে যায়। তখন ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ডে ১৪ সাইকেল থেকে ২৬ সাইকেল পর্যন্ত। একে বলা হয় বিটা ব্রেন ওয়েভ।

চোখ বন্ধ করে বিশ্রামকালে একটু তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব সৃষ্টি হলে ব্রেনের বৈদ্যুতিক তৎপরতা কমে যায়। এ অবস্থায় ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ডে ৮ থেকে ১৩ সাইকেল। একে বলা হয়, আলফা ব্রেন ওয়েভ। থিটা ব্রেন ওয়েভ আলফার চেয়ে ধীর। এর ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে ৭ সাইকেল।

এরপর রয়েছে গভীর নিদ্রাকালীন ব্রেন ওয়েভ। এর ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ০.৫ থেকে ৩ সাইকেল। একে বলা হয় ডেল্টা ব্রেন ওয়েভ। ব্রেন ওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ২৭ বা তার ওপরে উঠে যেতে পারে হঠাৎ উত্তেজিত অবস্থার ফলে। একে বলা হয় গামা ব্রেন ওয়েভ।

এখন যদি আমরা কৃত্রিমভাবে শিথিলায়নের মাধ্যমে শরীর-মনে বিশ্রাম ও তন্দ্রাকালীন আবহ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলেও ব্রেন ওয়েভ নেমে আসবে আলফা/থিটা লেভেলে। আর ব্রেন ওয়েভকে আলফা/থিটা লেভেলে নামিয়ে আনতে পারলেই ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি হবে। অবচেতন মনের গভীরের শক্তিকে কাজে লাগানোর পথ হবে মুক্ত। আপনি প্রবেশ করতে পারবেন মনের আরও গভীরে। সচেতন মন যেমন অবচেতনকে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করতে ও সৃজনশীলভাবে কাজে লাগাতে পারবে, তেমনি পারবে অচেতন বলয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে। আর অবচেতন তখন সেই নির্দেশকে বা ধারণাকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুকূল ব্রেন ফ্রিকোয়েন্সিতে নিরলস কাজে নেমে পড়বে।   

শরীর-মনকে শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টিই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, মন নিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন বা পরিকল্পিত ধ্যানের প্রথম ধাপ। আর ধ্যান বা মেডিটেশনের প্রয়োজনীয়তাও এখানেই।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি