ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

বিলুপ্তির পথে উপকারী কীটপতঙ্গ

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১৪:৫১, ১৫ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:২৫, ১৫ জুলাই ২০২১

রূপে ভরপুর প্রজাপতি থেকে বিরক্তিকর মশা, এই কীটপতঙ্গের জগতটা খুবই বৈচিত্র্যময়। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যতটা জানা গেছে তাতে কীটপতঙ্গের রয়েছে প্রায় দশলাখ প্রজাতি। এর বাইরেও নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, এসব কীটপতঙ্গের মধ্যে একটি বড় অংশ রয়েছে যারা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বেশ উপকারী। চিন্তার বিষয় হচ্ছে- বাসস্থানের ক্ষতি, কীটনাশকের ব্যবহার, বনাঞ্চল ধ্বংস, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পৃথিবীর আধুনিকায়নের ফলে বিলুপ্তির পথে অসংখ্য প্রজাতির কীটপতঙ্গ।

প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের বিচরণ। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের আগমন ঘটে। এরপর বড় একটা সময়জুড়ে পৃথিবীর প্রায় সব প্রতিবেশেই এদের আধিপত্য ছিল। ওইসময় কীটপতঙ্গ আকারেও বেশ বড় ছিল, এক একটি গঙ্গাফড়িং ছিল গাঙচিল পাখির সমান। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় পৃথবীতে আবির্ভূত হয় পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। একসঙ্গে কমতে থাকে কীটপতঙ্গের প্রভাব।

তবে আকারে ছোট হয়ে গেলেও প্রজাতিবৈচিত্র্য ও সংখ্যাধিক্যে এদের জুড়ি নেই। বর্তমান সময়েও আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রজাতির কীটপতঙ্গ। প্রাণিজগতে সবচেয়ে বেশি প্রজাতি আছে কীটপতঙ্গ শ্রেণীতে, পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রাণিজগতের প্রায় ৮০ শতাংশই কীটপতঙ্গ। 

ছোট পিঁপড়া থেকে শুরু করে ঘরের কোণের আরশোলা এবং বাহারি প্রজাপতি ও ঘাসফড়িং সবই কীটপতঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। মাটি থেকে শুরু করে গাছপালা, জলাশয়, ফসলের মাঠ এমনকি আমাদের বসতবাড়িতেও এদের দেখা যায়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এ প্রাণীগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝে যে আন্তঃসম্পর্ক ও খাদ্যজাল গড়ে উঠেছে তা কীটপতঙ্গ ছাড়া ভাবাই যায় না।

শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে, পৃথিবীতে যদি পোকামাকড় না থাকে তবে খাদ্যাভাবে মরতে হবে মানবজাতিকে। সম্প্রতি বায়োলজিক্যাল কনজার্ভেশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, পোকামাকড়ের চল্লিশ শতাংশের বেশি প্রজাতি এখন হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি পোকামাকড়ের দশ শতাংশ প্রজাতি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে হারিয়ে যাবে।

বছরে বিশ্বের ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল। গমের মতো শষ্য পরাগায়নের জন্য বাতাসের উপর নির্ভরশীল হলেও অনেক খাদ্যশস্য আছে যেগুলো পরাগায়নের জন্য পোকামাকড়ের উপর নির্ভরশীল। ফলে তারা হারিয়ে গেলে কৃষকরা বিপাকে পড়বেন।

পরাগবাহী পোকামাকড় হারিয়ে গেলে অনেক শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপাদন আর সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের খাবার টেবিলে খাবারের পরিমাণ কমে আসবে। এমনকি চকলেট এবং কফির সংকটও দেখা দেবে।

গুবরে পোকার মতো অনেক পোকামাকড় মৃত গাছপালা, মরদেহ এবং মল পচতে সহায়তা করে। এই পোকামাকড় না থাকলে পচন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হবে, যা পরিবেশ এবং মানুষ - উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে।

বিভিন্ন উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মূল খাবার পোকামাকড়। ফলে পোকামাকড় কমলে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীও কমতে থাকবে।

জটিল এবং বৈচিত্র্যময় জীবনচক্র
পতঙ্গ ছোট আকারের প্রাণী হলেও এদের জীবনচক্র বেশ জটিল এবং বৈচিত্র্যময়। প্রায় সব ধরনের কীটপতঙ্গ এদের জীবনচক্রে ৩ বা ৪টি ধাপ অতিক্রম করে। প্রজাপতি তার জীবদ্দশায় ৪টি ধাপ সম্পন্ন করে। প্রথমে স্ত্রী প্রজাপতি ডিম দেয়, এরপর ডিম থেকে লার্ভা, লার্ভা থেকে পিউপা এবং পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়। 

ঘাসফড়িং জাতীয় পতঙ্গ জীবনে ডিম, নিম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ এ ৩টি ধাপ সম্পন্ন করে। কীটপতঙ্গের জীবনচক্রের এ ধরনের পরিবর্তনকে বলা হয় রূপান্তর। অনেক কীটপতঙ্গ এককভাবে জীবনযাপন করলেও কোনো কোনো পতঙ্গ দলবদ্ধ হয়ে সামাজিক জীবনযাপন করে। এদের দলবদ্ধ বসবাস অনেকটা মানুষের সামাজিক জীবনযাপনের মতোই। কীটপতঙ্গের সামাজিক জীবনে কাজের দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। প্রতিটি দলের মধ্যে থাকে একটা রানী, কয়েকটা পুরুষ আর থাকে অসংখ্য শ্রমিক। সামাজিক জীবনযাপনের ফলে এদের মধ্যে এক ধরনের শ্রমবিভাগ দেখা যায়। শ্রমিকরা খাবার সংগ্রহ এবং বাসস্থানের দেখাশুনাসহ সব ধরনের কাজ করে থাকে। রানী ও পুরুষ মূলত বংশবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

উপকারী কীটপতঙ্গ
কীটপতঙ্গকে আমরা সাধারণত ক্ষতিকর হিসেবে জানলেও প্রকৃতিতে রয়েছে এদের অপরিসীম উপকারী ভূমিকা। উদ্ভিদের পরাগায়ন থেকে শুরু করে প্রতিবেশে সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা পায় কীটপতঙ্গের মাধ্যমে। কোনো কোনো পতঙ্গ ক্ষতিকর হলেও অধিকাংশ প্রজাতিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের উপকার করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মৌমাছি, প্রজাপতি, রেশমকীট, ঘাসফড়িং ইত্যাদি। মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে এবং মৌচাকে জমা করে। এ মধু আর মোম অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এছাড়া মৌমাছি বিভিন্ন ফসলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

রেশমকীট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পতঙ্গ। রেশমকীট পালনের মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় রেশম সুতা যা থেকে মূল্যবান বস্ত্রসামগ্রী তৈরি হয়। কীটপতঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল প্রজাপতি ও ঘাসফড়িং। রঙ-বেরঙের প্রজাপতির ওড়াউড়ি নিমেষেই মুগ্ধ করে মানুষকে।

শুধু সৌন্দর্য আর বর্ণিল বাহার নয়, ফুলে ফুলে ঘুরে পরাগায়নের মাধ্যমে পরিবেশের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখতে এদের ভূমিকা অপরিসীম। পতঙ্গের আরেকটি সুপরিচিত দল পিঁপড়া। এরা মাটির গর্তে, গাছের কোটরে অথবা বিভিন্ন আসবাবপত্রের ফাঁকে বাসা বাঁধে। এরা খুবই সামাজিক। সারি বেঁধে চলাচল এবং খাদ্য সংগ্রহ করে। এদের বাড়ি ফেরা ও খাবার সংগ্রহের জন্য সূর্যালোকের কৌণিকতা নিরূপণ করে চলে। এরা আমাদের উচ্ছিষ্ট খাবার এবং অন্য মৃত পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশ সুন্দর রাখে।

কীটপতঙ্গের বিলুপ্তির কারণ
বর্তমান সময়ের মতো ভয়াবহ অবস্থায় কখনও পতঙ্গের দল ছিল না। মূলত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে পোকামাকড়ের এ ভয়াবহ দশা। কীটপতঙ্গের বিপন্ন হওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীরা চারটি প্রধান কারণ খুঁজে বের করেছেন। এগুলো হচ্ছে- 
১. আবাস্থল ধ্বংস, তৃণভূমি ও বনভূমি পরিবর্তন করে কৃষি জমি তৈরি করা। পাশাপাশি বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পতঙ্গকুল। কীটপতঙ্গের খাদ্য ও প্রজননের জন্য যে ধরনের আবাসস্থল প্রয়োজন তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 
২. পরিবেশদূষণ, অধিক হারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ত্বরান্বিত করছে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি। কৃষিতে অধিক উৎপাদনের আশায় ক্ষতিকর পতঙ্গের পাশাপাশি আমরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে উপকারী পতঙ্গও ধ্বংস করছি।
৩. জৈবিক সমস্যা, ভিনদেশি আগ্রাসী প্রজাতির দ্বারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কীটপতঙ্গ। এক প্রতিবেশের প্রাণী অন্য প্রতিবেশে স্থানান্তরের মাধ্যমে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে অসংখ্য পতঙ্গ। 
৪. বর্তমান সময়ে অন্যতম আলোচিত সমস্যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ুর পরিবর্তন। এ সমস্যার কারণে ভয়াবহ সংকটর মুখে গোটা পৃথিবী। জলবায়ুর পরিবর্তনে একদিকে যেমন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমনি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বেশি সংখ্যক পতঙ্গের প্রজাতি।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া অনেক পোকামাকড়ের জন্য কঠিন ব্যাপার। যেমন ভোমরা মূলত ঠান্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে অভ্যস্ত। ফলে অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আবার ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েও যেতে পারে, যা কৃষকের বিপদ বাড়াবেন।

বিলুপ্ত হচ্ছে মৌমাছি
মৌমাছি চাষাবাদের জন্য অপরিহার্য একটি পতঙ্গ। এই বিশেষ পতঙ্গটি একশোটির বেশি ফসলের মধ্যে সত্তরটিরও বেশিতে পরাগায়ন করে থাকে। এই বিবেচনায় মৌমাছি একটি অতি উপকারী পতঙ্গ। সেই হিসেবে মৌমাছি সারা পৃথিবীতে বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যে চাহিদা তা পূরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। আশঙ্কার কথা হলো বিশেষজ্ঞরা এই বিশেষ প্রাণিটি বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন।

তারা মনে করেন, আগামি ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন ছুঁয়ে যাবে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত খাদ্য চাহিদাও তৈরি হবে। বাড়তি এই চাহিদা পূরণে নির্ভর করতে হবে মৌমাছির মত ছোটখাটো কীটপতঙ্গের উপর, যারা শস্য উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মৌমাছিরা ৭০ শতাংশ উদ্ভিজের পরাগনিষিক্ত করে। কিন্তু ১৯৬০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে মৌমাছির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরও কিছু জায়গায় মৌমাছির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে যেখানে আগে এমনটি ঘটেনি।

চীন ও জাপানের বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করছেন ক্রমাগতভাবে বিশেষ এই পতঙ্গটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার মিশর, তানজানিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে প্রকৃতির বুক থেকে মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

আফ্রিকার নীলনদের তীরবর্তী দেশগুলিতেও মৌমাছি হ্রাস পাচ্ছে। মৌমাছির প্রজনন হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত। ২০১২ সালে উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতেও মৌমাছির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। 

রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ দপ্তর বা ইউনিপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৌমাছি একটি উপকারী পতঙ্গ। এটির বিলুপ্তি সারা পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।

ইউনিপের মুখপাত্র নিক নুট্টাল মনে করেন, মৌমাছি বিলুপ্তির পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। তাঁর মতে, মৌমাছির প্রধান খাবার বিভিন্ন ফুলের উৎস ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। বনবাদাড়ের এসব ফুল গাছ বন ধ্বংসের  কারনে হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীতে শিল্পায়ন ও আবাসনের প্রয়োজনে বনজঙ্গল ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। এতে মৌমাছির খাবারের উৎস সংকুচিত হচ্ছে।

কমে যাচ্ছে প্রজাপতি
নির্বিচারে বনের গাছ কর্তন, ঝোপঝাড় পরিষ্কার ইত্যাদি কারণে অন্যসব প্রাণীর মতো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বহু বর্ণিল, অপূর্ব সুন্দর রং ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পতঙ্গ প্রজাপতি। সারা পৃথিবীতে রয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি। আর বাংলাদেশে প্রায় এক দশক আগেও ৬ শতাধিক প্রজাতির প্রজাপতি দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে ঠিকে আছে মাত্র ৩০০ প্রজাতির প্রজাপতি।

দিনে দিনে বাংলাদেশের বনাঞ্চল যেন প্রজাপতি নিধনের ফাঁদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দেশের মোট ৩০০ প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে ইতোমধ্যে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে বর্ণচ্ছটা ‘গাউডি ব্যারণ’ এবং ‘কমন ভেলবেট বব’সহ অর্ধশতাধিক প্রজাতি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দেশের সৌন্দর্যময় নিরীহ প্রকৃতির পতঙ্গ প্রজাপতি ক্রমশ আবাস হারিয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে।

বাংলাদেশের বান্দরবান, উখিয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকার বনগুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্রজাপতির দেখা মেলে। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া বনে এবং সুন্দরবন ও মধুপুরে কিছু প্রজাতির প্রজাপতি দেখা যায়। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বনায়নের নামে ‘কুমারী লতা’, ‘আঙ্গুর লতা’, নির্বিচারে কর্তন করার ফলে প্রজাপতি তাদের আবাস হারিয়ে ফেলছে। এ ছাড়া বনতস্করদের হাতে বন ধ্বংস হওয়ার কারণেও অনেক প্রজাপতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

অথচ অসংখ্য উদ্ভিদের পরাগায়ন আর খাদ্যশৃঙ্খল তাদের উপর নির্ভরশীল।

কমছে ফড়িং
ফড়িং ওডোনাটা বর্গভুক্ত ও এপিপ্রোকটা উপবর্গের এক ধরনের বড় যৌগিক চোখবিশিষ্ট পতঙ্গ। এরা লাল, সবুজ, হলুদ, কমলাসহ অনেক মিশ্র রঙের হয়ে থাকে। রং ও সৌন্দর্যে অতুলনীয় বৈচিত্র্যময় ফড়িং আমাদের মনকে আকৃষ্ট করে। এরা মশা, পিঁপড়া, মাছি, মৌমাছিসহ অন্যান্য ছোট পোকা-মাকড় শিকার করে খায়।

গবেষকদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ প্রজাতির ফড়িং দেখা যায়। আমাদের দেশে একসময় শতাধিক প্রজাতির ফড়িং থাকলেও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ক্রমেই তা কমে আসছে। পরিবেশবান্ধব ছোট জীব ফড়িং এবং এর বাচ্চা জলাশয়ের পোকা-মাকড় ও মশার লার্ভা খেয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পরিবেশকে ভালো রাখতে সহায়তা করে। পূর্ণ বয়স্ক ফড়িং উড়ন্ত অবস্থায় শিকার করে। ফড়িং একাধারে বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষতিকর মশা দমন, ফসল ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পোকা-মাকড় দমনেও ভূমিকা রাখে। 
অথচ এই ফড়িং দিনে দিনে কমে আসছে।

নিভে যাচ্ছে জোনাকির আলো
ব্যাপক সংকটে আছে জোনাকি পোকা বা ফায়ারফ্লাই। বাসস্থানের ক্ষতি ও কীটনাশকের কারণে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পতঙ্গটি। সম্প্রতি বায়োসায়েন্স জার্নালে এ বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃত্রিম আলোর কারণে জোনাকি পোকারা সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে আছে। জোনাকি পোকাদের দুই হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। এরা বিশ্বজুড়ে জলাভূমি, তৃণভূমি, বনাঞ্চল ও নগর উদ্যানগুলো আলোকিত করে।

টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী সারা লুইসের মতে, ‘জোনাকি পোকারা যেকোনো স্থানে টিকে থাকতে পারে। তবে তাদের টিকে থাকার জন্য বিশেষায়িত পরিবেশের দরকার হয়। এ পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকির মুখে।’

টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী অ্যাভালন ওয়েনসের মতে, আলোর দূষণের কারণে জোনাকিদের প্রজননে সমস্যা হয়। আর প্রজননে বাধা পাওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই জোনাকিদের সংখ্যা বাড়ছে না। পুরুষ জোনাকিরা অধিক উজ্জ্বল আলো সৃষ্টির মাধ্যমে নারী জোনাকিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু কৃত্রিম আলোর কারণে পুরুষ জোনাকির আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি জোনাকির আয়ুষ্কাল মাত্র কয়েক দিন। জোনাকিদের লার্ভা অবস্থায় থাকার সময়টাই দীর্ঘ। কিন্তু লার্ভা-পরবর্তী পরিণত অবস্থায় খুব অল্পদিন বাঁচে এরা।

আলোর দূষণের পরেই জোনাকিদের সবচেয়ে বড় শত্রু কীটনাশক। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকে জোনাকির মতো অনেক প্রাণীও মারা যায়। যদিও কীটনাশক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বাজারজাতকরণের সময় এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয় না।

সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণও জোনাকিদের অস্তিত্বের সংকট তৈরির পেছনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ুর পরিবর্তিত বাস্তবতায় প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে জোনাকিরা।

বেড়ে যাবে কিছু প্রজাতি
কীটনাশক, অন্য আগ্রাসী প্রজাতি এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো কারণে পতঙ্গের বড় একটি অংশের বিলুপ্তি ঘটলেও তেলাপোকা, মশা-মাছির মতো পতঙ্গ এসব পরিবর্তনের মধ্যেও টিকে থাকার মতো প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। পাশাপাশি মাছি বা আরশোলার মতো কিছু পতঙ্গ মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এদের সংখ্যা বাড়ছে এবং আগামীতে আরও বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে।

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভ গুলসন বলেছেন, কিছু প্রজাতির কীটপতঙ্গের সংখ্যা হয়তো অনেক বেড়ে যাবে কিন্তু আমাদের যা দরকার সেই মৌমাছি, প্রজাপতি- এগুলো হারিয়ে যেতে থাকবে।

আমরা মারা যাবো
পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ কখনো কখনো খাবারে এসে পড়ে, কখনো শরীরে কামড়ে দেয়। বাসাবাড়িতে এমন অসংখ্য পোকা আছে যা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি বিরক্ত হয়ে আমরা এদের মারতে উদ্যত হই। কিন্তু এসব ধ্বংস করার আগে দু'বার ভাবতে হবে। কারণ পৃথিবী জুড়েই পতঙ্গের সংখ্যা খুব দ্রতগতিতে কমে যাচ্ছে এবং এটা এক বড় বিপদ।

লন্ডনে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর ড. এরিকা ম্যাকএ্যালিস্টার বলেছিলেন- ‘পৃথিবীর সব কীটপতঙ্গকে আমরা যদি মেরে ফেলি, তাহলে আমরাও মারা যাবো।’

পোকামাকড় রক্ষায় করণীয়
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই দুনিয়ার ছোট-বড় প্রতিটি জীবেরই সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা জরুরি। যে কোনও জীবের অস্তিত্বের সংকটই এই দুনিয়ার জন্য বিপদের ইঙ্গিত। তাই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে কীট-পতঙ্গদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে একফসলী চাষের পোকামাকড়বান্ধব কৃষি নীতি গ্রহণ করলে পোকামাকড় রক্ষা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বাগানে এবং শহুরে অঞ্চলে ফুল গাছ লাগিয়ে পোকামাকড় টিকিয়ে রাখায় ভূমিকা রাখা সম্ভব।

ড. ম্যাক এ্যালিস্টার বলছেন, কীটপতঙ্গের যৌনমিলন ও বংশবৃদ্ধির জন্য বড় গাছের ছায়া ও পঁচা পাতা দরকার - যাতে তাদের ডিম ও শূককীট বাস করে। চাষাবাদের কারণে এই পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে।

গবেষক ফ্রান্সিসকো সানচেজ-বেয়ো বলেছেন, কীটপতঙ্গ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে, গাছ লাগাতে হবে, ঝোপঝাড় বাড়াতে হবে, মাঠের আশপাশে ফুলগাছ লাগাতে হবে। বিপজ্জনক কীটনাশক বাজার থেকে দূর করতে হবে। কার্যকর পন্থা নিতে হবে যাতে কার্বন নির্গমন কমানো যায়। 

কীটপতঙ্গের পাশাপাশি মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পায়ন, নগরায়ন বা কৃষি কাজের মাধ্যমে পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা মাথায় রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। পরিবেশদূষণ কমিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য না রাখলে কীটপতঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বিদায় ঘণ্টা বেজে যাবে। কীটপতঙ্গ নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করে এদের সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিলে একদিকে যেমন অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তেমনি জীববৈচিত্র্যও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
এসএ/


 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি