ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

বুক রিভিউ: কাব্য বা কাব্য নয় 

নাইমুল হাসান

প্রকাশিত : ১৭:৩৭, ২৮ এপ্রিল ২০২১

প্রেমে পড়লে মানুষ নাকি কবি হয়, অথবা কবি হতে হলে প্রেমে পড়তে হয়। কোনটা ঠিক সেটা বলা কঠিন হলেও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমি একদিন দুম করেই মিলির প্রেমে পড়লাম। তারুণ্যের প্রথম দিকের ধুন্ধুমার টাইপের সেই প্রেম। শয়নে স্বপনে শুধুই মিলি। তবে আমার কচি মনে প্রেমিকার সার্বক্ষণিক সরব উপস্থিতি থাকলেও প্রেমিকার মন যেন আমার চেয়েও কচি। সেখানে তার বদরাগী বাবা ও পাড়ার উঠতি মুরুব্বি হতে চলা ভাইয়ের একচ্ছত্র দখল। ফলে বাবা ও ভাইয়ের কঠোর শাসনে তার হৃদয় রাজ্যে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। উথাল-পাতাল প্রেমের ঘোরে এই আমি হঠাৎ-ই একদিন নিজেকে কবি হিসেবে আবিষ্কার করলাম। মনের সমস্ত আবেগ মিশিয়ে লিখে ফেললাম দারুণ এক কবিতা। 

"মিলি তোমায় দেখলে চোখে পুরো পৃথিবী দোলে
নশ্বর পৃথিবীতে আমি যে কে সেটাই যাই ভুলে!
কাছে এসো প্রিয়তমা, ভালোবাসায় দাও সাড়া
তুমি বিনে আমি শেষ, বিষপানে যাবো মারা।"

আমার কবি প্রতিভায় আমি নিজেই বিমোহিত। সদ্য কেনা ভিউকার্ডের পিছনে গোটা গোটা হরফে সদ্যপ্রসূত কবিতাখানা লিখে অনেক কৌশলে সেটা মিলির হাতে গুজে দিলাম।

পরদিন বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মিলি প্রাইভেট পড়া শেষে এদিক দিয়েই বাড়ি ফিরবে। মিলি এলো এবং মুখ বাঁকা করে বললো," আমাকে দেখে যদি নিজেকেই ভুলে যাও তবে আমার বাবা ও ভাইকে আগে দেখে এসো। তাহলে আমাকেও ভুলে যাবে, ১১০% গ্যারান্টি। আর তারপরও যদি আমার কথা মনে থাকে, তবে এসো- আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।"

মিলির কথাগুলো বেশ গায়ে লাগলো। আমার মনে বাসা বাঁধা কবি কবি ভাব তখন তুঙ্গে। পরদিন আবারও চার লাইনের বিদ্রোহী টাইপের কবিতা লিখে ফেললাম।

"তোমার বাবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে
ভেঙে দিয়ে ভাইয়ের সন্ত্রাসী হাত,
তোমাকে ছিনিয়ে আনবোই ওগো প্রিয়ে
তোমার সাথে হবে প্রেমের বাজিমাত।"

মিলির হাতে নতুন আরেকটা ভিউকার্ড গুজে দিয়ে বললাম, "কাল বিকেলে জবাব চাই।"  

পরদিন বিকেল। ফুরফুরে ভাব নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বসে আছি। একটু পরেই এ পথ দিয়ে মিলি যাবার কথা।  হ্যাঁ, ওই যে দেখতে পাচ্ছি মিলি এগিয়ে আসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিলি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় একটা বাইক এসে আমার সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ালো। বাইক চালককে দেখেই চিনলাম- মিলির বড়ভাই মুন্না। বাইকের পেছনে তার সাগরেদ শিবলী। আমি সালাম দিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়ালাম। মুন্না পকেট খেকে একটা ভিউকার্ড বের করে বললো," এই দিওয়ানা কবি, এদিক্ আয়। এইটা তুই লেকছোস!"  

অতি পরিচিত ভিউকার্ডটা আমার চোখে তখন ঝাপসা হয়ে আসছে। নিজের হাতের লেখা নিজের কাছেই অচেনা ঠেকছে। প্রবল জোরে মাথা    নাড়িয়ে মুন্না ভাই বলতে গিয়ে দেখি আমার কণ্ঠে শুধু ম্যাঁ... ম্যাঁ টাইপের এক ধরনের আওয়াজ বের হচ্ছে। 

কি ম্যাঁ ম্যাঁ করোস?  এইডা কি তোর হাতের লেখা? মুন্না ধমক দিয়ে জানতে চাইলো। আমি আবারও ফুল স্পীডে মাথা ঝাঁকালাম। মুন্না ভাইয়ের পরিবর্তে এবার শুধু ভাই বলার চেষ্টা করতে দেখি মুখ দিয়ে ভ্যাঁ..... ভ্যাঁ শব্দ আসছে।  এরই মধ্যে খেয়াল করলাম মিলি মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে গেলো।  আমার অবস্থা দেখে সম্ভবত মুন্নার মায়া হলো। মুখ শক্ত করে বললো," এর পরে মিলির আশেপাশে দেখলে তোরে চক্ষু হাসপাতালে নিয়া চোখের ছানি অপারেশন কইরা কালা চশমা দিয়া চৌরাস্তার মোড়ে খাঁড়া করাযা রাখমু। যা, ভাগ এখন। আর কোনদিনও য্যান এই দিকে না দেখি।"

এরপরের কাহিনী আর না বলি। ভুল সময়ে ভুল কবিতা লেখার কারণে মিলির সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে অনেক বছর পেরিয়েছে। মিলি অপ্রাপ্তির এক দীর্ঘশ্বাস হিসেবে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কি ছিলো আমার অপরাধ সেটা আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

ইদানিংকালে মধ্য যুগীয় এক কবির কবিতা আমাকে নাড়া দেয়। আমি আবারও প্রেমে পড়ি। সে প্রেম কবিতার প্রতি, কাব্যের প্রতি। কী অপূর্ব শব্দ বিন্যাস!  কী অসাধারণ ছন্দ। আমি বিভোর হয়ে তাঁর কবিতা পড়ি-

"সকালের নরম রোদ যখন গাছের পাতার ফাঁক গলে
আপনার কোমল গালে খেলা করে,
মাফ করবেন মাশুকা...
আলতো ছুঁয়ে দেয়ার যে প্রবল কামনা মন গভীরে- 
শব্দ শিল্পীরা সেই অনন্য অনুভূতিকেই কি
এক শব্দে 'প্রেম' নামকরণ করেছেন ?"

আহা!  প্রেম প্রকাশের কি বিনয়ী উপস্থাপনা! বুকের মাঝে জোরালো এক কম্পন তুলে যায়। সে কম্পনের রেশ থাকে অনেকটা সময় জুড়ে। আমি বিমোহিত হয়ে আবারও পড়ি- 

"ভালোবেসেছি বলেই
উপহারে ঈশ্বর আমায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।  
প্রিয়তমা, 
কোন এক মধ্য দুপুরে 
যখন-ই তোমার কাজল টানা চোখে চোখ রেখেছি,
আমি জেনেছি আমার মৃত্যু হয়েছে।"

এমন একটি কবিতা যে নারীকে নিয়ে লেখা, তার কী সাধ্য আছে প্রেমের এমন আকুতি ফিরিয়ে দেবার!  আমি মধ্য যুগীয় এই কবির কবিতা পড়ি। কবিতা পড়ি আর উপলব্ধি করি- প্রেমিক হতে হলে নত হতে হয়। কবি হতে হলে বিনয়ী হতে হয়। প্রেম ও কবিতা শুধুই আত্মসমর্পণের। 

"মিলন উষ্ণতায় গলতে থাকা তুমি
আর, সুতীব্র আলিঙ্গনে 
পোড়া তোমার শরীরের কণা কণা 
ঘামের বিন্দুগুলো ফিসফিস করে যখন
বলতে থাকে, 'ভালোবাসি, ভালোবাসি!' 

আমার মুগ্ধ দুই চোখ, আর
ক্লান্ত শত সহস্র পেশি ওই দুই শব্দের মাঝেই 
খুঁজে নেয় প্রেম-পূর্ণতার অপার্থিব শান্তি; প্রেয়সী।"

প্রেমিকার সঙ্গ কাতর প্রেমিকের এই আকুলতা বলে দেয় ভালোবাসার কতোটা গভীরে গেলে এমন শব্দগুচ্ছ কবিতায় রুপান্তরিত হয়! এমন কবিতা বারেবারে পড়ায় কোন ক্লান্তি নেই। খুশির কথা, এবারের বইমেলায় মধ্য যুগীয় এই বিখ্যাত কবি মোহাম্মদ আনোয়ারের প্রথম কাব্য গ্রন্থ "কাব্য বা কাব্য নয়" প্রকাশিত হয়েছে পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে। বইটি ফুরিয়ে যাবার আগেই আপনার কপিটি সংগ্রহ করুন। হৃদয়ের গভীরে চেপে রাখা প্রেমকে উজ্জীবিত করুন। নিজেকে সমর্পিত করুন ভালোবাসার বেদীতে।

"যতটুকু জমিনে ছড়ানো শেকড় আমার,
সবটুকু তার; শুধুই তোমার অধিকার।"

#বইঃ কাব্য বা কাব্য নয়
#লেখকঃ মোহাম্মদ আনোয়ার 
#প্রকাশকঃ পেন্সিল পাবলিকেশান্স
#ধরনঃ কাব্যগ্রন্থ

আরকে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি