ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

মানবদরদি একজন মহাত্মা গান্ধী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৫২, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৯:২৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মহাত্মা গান্ধী। ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা। ভারতবর্ষে যে কয়জন মহামানবের জন্ম হয়েছে তাঁর মধ্যে মহাত্মা গান্ধী অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক দাঙ্গা সৃষ্টি হলে তিনি সমাধানের প্রস্তাব দেন। একই সাথে তিনি আজীবন অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে পুরো ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।

মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম করমচাঁদ গান্ধী। তার নাম ছিল মোহনদাস। গুজরাটি প্রথা অনুযায়ী তার পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তার মায়ের নাম পুতলীবাঈ। গান্ধী ছেলেবেলা থেকে বাবা মায়ের সাথে পোরবন্দরে ছিলেন। সেখানে তিনি পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়।

যখন তাঁর সাত বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা রাজকোটের বিচারপতি হয়ে গেলেন। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। গান্ধীর কাছে সে সময় জীবনসঙ্গী কন্তুরীবাঈ বা কন্তুরা ছিলেন তার খেলার সাথী। বিবাহের তিন বছরের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। ১৮৮৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলেন।

এই সময় তাঁর বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বার প্রবল ইচ্ছা হয়। তাঁর পরিবারের সকলে ছিলেন নিরামিষভোজী এবং রক্ষণশীল মনোভাবের।ছেলে বিলাতে গিয়ে বংশের নিয়ম কানুন সম্পূর্ণভাবে ভূলে যাবে এই আশংঙকায় তাকে কেউ যাবার অনুমতি দিতে চায় না। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর বড় ভাই তাকে ব্যারিস্টারি পড়বার অনুমতি দিলেন। ১৮৮৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের পথে রওনা হলেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি নিজ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।

১৮৯১ সালে গান্ধী ব্যারিস্টারি পাস করে ফিরে এলেন। কয়েকমাস পরিবারের সাথে রাজকোটে থাকার পর বুম্বাই গেলেন। উদ্দেশ্য ব্যারিস্টারি করা। কিন্তু চার মাসের মধ্যে অর্থ উপার্জনে তিনি সুবিধা করতে পারলেন না।

সারাবিশ্বের সব নেতার অনুপ্রেরণার ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলায় খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। তিনি স্কুল শেষ হলে কোনও রকমে দৌড়ে বাড়ি চলে আসতেন। কেননা সহপাঠীদের সঙ্গে একেবারেই মিশতে পারতেন না। লজ্জায় মুখে কথাই আসতো না গান্ধীর, আর বন্ধুই বা বানাবেন কিভাবে। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও গান্ধী সেই মুখচোরাই ছিলেন। ব্যবসায় প্রসার ছিল না। প্রসার হবেই বা কিভাবে? আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে তার যে পা কাঁপত। বিপক্ষের উকিল কিছু বললে তিনি আমতা আমতা করে কোনও উত্তরই দিতে পারতেন না। এমন উকিলকে কে চাইবে? অগত্যা দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিলেন গান্ধী।

এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আবদুল্লা কোম্পানির একটি মামলা পরিচালনা করার জন্যে তিনি সেদেশে রওনা হলেন। এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার একটি ঘোষণায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার থেকে দূরে রাখতে হুকুম জারি করে। এই অবিচারের বিরুদ্ধে গান্ধী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি স্থির করলেন এই অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করব। গান্ধীর এই আন্দোলন সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সৃষ্টি করল এবং প্রায় দশ হাজার ভারতীয়দের স্বাক্ষর দেওয়ার এক দরখাস্ত উপনিবেশ মন্ত্রী লর্ড রিপনের কাছে পাঠানো হলো। মূলত তার চেষ্টায় ১৮৯৪ সালের ২২ শে মে জন্ম হল নাটাল ভারতীয় কংগ্রেসের। গান্ধী হলেন তার প্রথম সম্পাদক।

এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য ভারতবর্ষে ফিরে এসে নিজের পরিবারের লোকজনকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রওনা হলেন। আফ্রিকায় টান্সভাল অরেন্জিয়া প্রদেশে বুয়র সম্প্রদায়েরর প্রভূত্ব ছিল। এই বুয়রদের সাথে সোনারখনির কর্তৃত্ব নিয়ে ১৮৯৯ সালে ইংরেজদের যুদ্ধ হল। গান্ধী বুয়রদের সমর্থন না করে রাজভক্ত প্রজা হিসাবে ইংরেজদের সেবা করবার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি করলেন। এই বাহিনী আহত ইংরেজ সৈন্যদের সেবা করে যথেষ্ট প্রশংসা করেছিল।

যুদ্ধ পরবর্তীতে গান্ধীর জীবনে এক পরিবর্তন দেখা দিল। তিনি সাদাসিদা জীবনযাপন করতে আরম্ভ করলেন। ১৯০৬ সাল টান্সভালে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে আট বছরের উপরে সব ভারতীয় নারী পুরুষকে নাম রেজিস্ট্রি করার আদেশ দেওয়া হয় এবং সবাইকে দশ আঙুলের ছাপ দিতে হবে বলে নতুন আইনে ঘোষণা করা হয়। এতে গান্ধী তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন। এবং এর বিরুদ্বে প্রতিকার করার জন্য ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। গান্ধী আরো বহু ভারতীয়দের সঙ্গে বন্দী হলেন।বিচারে তার দুমাস কারাদন্ড হল। এই প্রথম কারাবরণ করলেন গান্ধী। ১৫ দিন পর সরকার কিছুটা নরম হলেন।

গান্ধীর সাথে চুক্তি হল যে ভারতীয়রা যদি স্বেচ্ছায় নাম রেজিষ্ট্রি করে তবে এই আইন তুলে নেওয়া হবে। অনেক সম্প্রদায় এই আইনে মেনে নিলেও পাঠানেরা তা মেনে নিল না, তাদের ধারণা হল গান্ধীজি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। গান্ধীর আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁর কোন দাবি মেনে নেয় না। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ক্রমশই বেড়ে চলে। গান্ধী সত্যাগ্রহ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন।

গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের ভার অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে প্রথমে ইংল্যান্ডে যান কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভারতে ফিরে এলেন।

১৯১৫ সালে আহমেদাবাদের কাছে কোচরার নামে এক জায়গায় সত্যাগ্রহ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেই সময় ভারত থেকে প্রচুর পরিমানে শ্রমিক দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হত। এর তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন গান্ধী। কিছু দিনের মধ্যে তিনি এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এর ফলে ১৯১৭ সালের ৩১ জুলাই ভারত থেকে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ঘোষণা করা হল। ১৯১৮ সাল, ইউরোপ জুড়ে তখন চলছে বিশ্বযুদ্ধ। ইংরেজরা ও এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বড় লাট লর্ড চেমস ফোর্ড দিল্লীতে গান্ধীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এই যুদ্ধে ভারতীয়দের ইংরেজদের সমর্থন দিতে অনুরোধ করেলেন। গান্ধীর ধারনা হয়েছিল ভারতবাসী যদি ইংরেজদের সাহায্য করে আচিরেই সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। ইংরেজদের প্রতি তাঁর এক মোহ ছিল যা থেকে তিনি কোনোদিনই মুক্ত হতে পারেননি। যুদ্ধের পর সকলে আশা করেছিল ভারতবাসি শায়ত্বশাসন পাবে। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে বড় লাট আইন নামে এক দমনমূলক আইন পাস করলেন। এতে বলা হল কেউ সামান্য সরকার বিরুধী কাজ করলে তাকে বিনা বিচারে বন্ধী করা হবে।

১৩ এপ্রিল রামনবমির মেলা উপলক্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক জায়গায় কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হলে ডায়ারের আদেশে নিরীহ জনগণের উপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেকে হতাহত হয়। এই ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ফলে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। গান্ধীর সত্যাগ্রহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল, তিনি নিজেই তাঁর ভুল স্বীকার করলেন। নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে ১৯২০ সালে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব সমর্থিত হল। গান্ধী ইংরেজ সরকারকে সহযোগিতা করতে নিষেধ করলেন। তিনি বলেন সব সরকারি স্কুল কলেজ, আইন আদালতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তিনি বিদেশি পণ্য বর্জন করতে বলেন। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য চরকা ও তাঁত প্রচলন করতে হবে।

গান্ধীর এই ডাকে দেশজুড়ে মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিদেশি পণ্য পোড়ানো শুরু হল। লোকজন চরকায় বোনা কাপড় পরতে শুরু করল। ১৯২২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা নামক স্থানে উত্তেজিত জনতা কিছু পুলিশকে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে তিনি আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন। গান্ধীকে গ্রেফতার করা হল। দেশব্যাপী আন্দোলনের দায় গান্ধীর উপর পরল। আন্দোলনের দায় নিজে স্বীকার করলেন। বিচারে তাঁর ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হল। জেলে তিনি চরকা কাটতে চাইলেন। কিন্তু তাকে সেই অনুমতি দেওয়া হল না। তিনি উপবাস শুরু করলেন।শেষ পর্যন্ত তাঁর দাবি মেনে নেওয়া হল, কিন্তু কিছু দিন পর তিনি অসুস্থ হয়ে পরলেন, এই অসুস্থতার জন্য তাকে ১৯২৪ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি আতকে মুক্তি দেওয়া হল। ১৯২৫, ২৬, ২৭ সালে গান্ধীজি কংগ্রেসের আধিবেশনে উপস্থিত থাকলেও তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি।

সুবাস চন্দ্র ও জওহরলাল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে একটি প্রস্তাব আনতে চান। এতে গান্ধী ক্ষুদ্ধ হন। তিনি চেয়েছিলেন আপোষ আলোচনার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন। তখন নিয়ম ছিল ভারতবাসী লবণ তৈরি করতে পারবে না। সবাইকে ব্রিটিশ সরকারের লবণ কিনতে হবে। অল্প দিনের মধ্যে অনেক মানুষকে বন্দি করা হল। দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের উপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। সেই সময় কমবেশি এক লক্ষ সত্যাগ্রহ কারারুদ্ধ হল। বাধ্য হয়ে লর্ড ডারউইন, গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন এবং তাদের মধ্যে চুক্তি হল সমুদ্র পাড়ের মানুষ লবণ তৈরি করতে পারবে এবং বিক্রি করতে পারবে। দেশের সমস্থ বন্ধীদের মুক্তি দিতে গান্ধী আহবান জানালেন। ১৯৩১ সালের ১৫ অগাস্ট তিনি বিলাত যাত্রা করলেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী, সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞীর সাথে তিনি আলোচনা করলেন। পরনে অর্ধনগ্ন ফকিরের পোশাক ছিল। সেই সময় ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী লোকজন দেখা করতে আসেন।

এরপর গান্ধী যখন দেশে ফিরলেন তখন দেশজুড়ে নিপীড়ন আর অত্যাচার চলছিল। অনেক নেতাই তখন জেলেবন্দি। গান্ধী বুঝতে পারলেন কংগ্রেস এর অধিকাংশ সদস্য তাকে শ্রদ্ধা করলেও তাঁর নীতি আদর্শ অনেকে মেনে চলেন না। সুতা কাটে না, সত্যাগ্রহের আদর্শ অনুসরণ করে না। তাই তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করলেন। ১৯৪০ সালে গান্ধিজি শান্তি নিকেতনে এলেন। কবিগুরুর সাথে তাঁর মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। শান্তি নিকেতনের কাজে গান্ধী নানা ভাবে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছিলেন। সে বছরই রামগড়ে কংগ্রেস অধিবেশন বসে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। এই অধিবেশনে ঘোষণা করা হল পূর্ণ স্বাধীনতা ভারতবাসীর কাম্য। গান্ধীকে পুনরায় নেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। শুরু হল সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

৯ অগাস্ট নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির সভায় ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। গান্ধীসহ কিছু নেতাকে বন্ধী করা হল। সমগ্র ভারত উত্তাল হয়ে গেল। শুরু হল গণবিক্ষোভ। পুলিশের হাতে এক হাজারের উপরে মানুষ নিহত হল। এই দিকে গান্ধীর শরীর ক্রমশ খারাপ হতে লাগলো। কারাগারে যদি গান্ধীর কিছু হয় তবে সব দায়িত্ব জন্য বিশ্ববাসীর কাছে জবাব দিতে হবে সেই ভয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। ইংল্যান্ড বুঝতে পেরেছিল ভারতের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এদিকে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে গেল। এই দাঙ্গায় গান্ধী খুব মর্মাহত হলেন। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু মুসলমানের ঐক্য। দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেল।

দেশজুড়ে দাঙ্গা, মন্ত্রীসভায় মতানৈক্য খাদ্য বস্ত্র নিয়ে সমস্যা শুরু হলে গান্ধী নিয়মিত প্রার্থনা সভায় যোগ দিতেন। ৩০ জানুয়ারি তিনি প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে এলে এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে সামনে এগিয়ে এল এক যুবক। সবাই ভেবেছিল গান্ধীকে প্রণাম করবে। কিন্তু কাছে গিয়ে সামনে ঝুঁকে পরে তিনবার পিস্তলের গুলি চালায়। দুটি গুলি পেটে একটি বুকে বিধল গান্ধীর। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পরেন তিনি। তাঁর মুখ থেকে শুধু দুটি শব্দ বের হল ‘হে রাম’।

তাঁর এই হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এল। পরদিন যমুনার তীরে চিতার আগুনে তার পার্থিব দেহ দাহ করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে বিশ্বনেতারা শ্রদ্বা ভক্তি নিয়ে ছুটে এলেন ভারতে। তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন সাড়া জীবন তিনি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর মহৎ আদর্শের জন্য তিনি আজও সকলের কাছে পূজনীয় এক প্রবাদ পুরুষ।

এ কথা বলা যায় যে- ভারতীয় উপমহাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনেনি।

অজানা তথ্য
শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সেনাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। ভাগ্যের ফেরে গান্ধী একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে দেনা আদায়কারীর চাকরি পেয়ে যান। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিটিশ এবং ডাচ শাসনাধীন। ভারতীয়রা সংখ্যালঘু হওয়ায় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হত। গান্ধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং সত্যাগ্রহের ধারণা সেখান থেকেই শুরু। যে ঘটনাটি গান্ধীর ভেতরকার নেতৃত্বের আগুনটি জ্বালিয়ে দেয়।

ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে কালো এবং ভারতীয় বলে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বসতে তো দেয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে বিবাদ করায় তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি গান্ধীর মনে দাগ কেটেছিল।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় সব বিদেশি পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সব ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। তিনি সব ভারতীয় পুরুষ ও নারী, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে নারীদের যুক্ত করে, এ সময়ে নারীদের করা এ সব কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত।

লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধী হাজার হাজার ভারতীয়দের সঙ্গে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশে রওনা দেন। ইতিহাস একে সল্ট মার্চ বলে থাকে। শুধু নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইল। সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০ হাজার ভারতীয়কে গ্রেফতার করে।

হাঁটা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গান্ধী জীবনে এত হেঁটেছেন যে তাতে পুরো পৃথিবী দুইবার চক্কর দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৮ কিলোমিটার করে হাঁটতেন তিনি।

গান্ধী তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে সব মিলিয়ে ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সাজার আদেশ পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী আর্টিকেল লেখার জন্য তাকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ১৯২৪ সালেই মুক্তি দেয়া হয়।

গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রে যাননি কখনও। তিনি মনে করতেন, তিনি যেহেতু জাতির পিতা, জাতির অধিকাংশ মানুষই গরিব, সেই গরিবের পিতা হয়ে তিনি কিভাবে বিমান ভ্রমণ করবেন? দেশ বিদেশে গান্ধীর অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হেনরি ফোরড ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম গান্ধী যাকে নিজের সাক্ষরযুক্ত একটি চরকা উপহার দিয়েছিলেন।

গান্ধী নিয়মিত তলস্তয়কে চিঠি লিখতেন। হিটলারের সঙ্গেও বেশ চিঠি চালাচালি দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ করে গান্ধী হিটলারকে একটি চিঠি লিখলেও তা আর হিটলারের কাছে পৌঁছায়নি। কারণ ব্রিটিশ সরকার এতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

আমরা ভালো কাজকে পুরস্কৃত করে থাকি। কিন্তু কিছু কিছু কর্ম থাকে, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সব পুরস্কারের ঊর্ধ্বে, বরং পুরষ্কার তাদের মহৎ কর্মকে খাটো করে। গান্ধী হলেন তেমনি পুরস্কারের ঊর্ধ্বের মানুষ। যাকে নোবেল কমিটি ৫ বার নোবেল মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭ সালে মনোনয়ন দিলেও ১৯৪৮ সালে শান্তিতে নোবেল গান্ধিরই পাবার কথা ছিল। কিন্তু ২ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীকে পুরস্কার দিয়ে খাটো করা যায়নি।

যে দেশের বিরুদ্ধে গান্ধী সারাজীবন যুদ্ধ করেছিলেন সেই গ্রেট ব্রিটেন তার মৃত্যুর ২১ বছর পর তার সম্মানার্থে  স্ট্যাম্পে গান্ধীর ছবি ছাপায়।

মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে ভারতে ৫৩টি বড় রাস্তা এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ৪৮ টি রাস্তার নামকরণ করা হয় গান্ধীর নামে। শুধু তাই নয়, টাইম ম্যাগাজিন এর ম্যান অব দ্য ইয়ার ১৯৩০ হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।

গান্ধীর শেষকৃত্যে ১০ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল যা প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছিল। কেন মানুষ ভালবাসবে না এমন মানুষকে?

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর পোরবন্দরের হিন্দু মোধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান (প্রধানমন্ত্রী)। মা পুতলিবা করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন। পুতলিবা প্রনামী বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ছিলেন। করমচাঁদের প্রথম দুই স্ত্রীর প্রত্যেকেই একটি করে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। অজানা কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগেও কয়েকবার তার ওপর হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের ৩০ জানুয়ারির লক্ষ্য ছিল নির্ভুল। সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা সভা করতেন তিনি। সেখানে সব ধর্মের কথা বলা হত, প্রতিদিন অংশ নিতেন কয়েকশ’ মানুষ। সেদিন সন্ধ্যার প্রার্থনা সভার জন্য গান্ধী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই নাথুরাম গডসে খুব কাছ থেকে পিস্তলের তিনটি গুলি ছুঁড়েন তার বুক লক্ষ করে।

ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমী বলেন, গুলি ছোড়ার আগে গডসে গান্ধীর দিকে ঝুঁকে প্রণাম করেন। স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ১৭ মিনিটে মৃত্যু হয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর। হাশমী বলেন, গুলির পরে তাকে ঘরে নিয়ে আসা হলেও ধারণা করা হয় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছিল।

গান্ধী হত্যার দায়ে গডসেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। দিল্লির লালকেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দেশভাগের জন্য গান্ধীকেই দায়ী বলে মনে করতেন।

আদালতে নাথুরাম গডসে বলেছিলেন, গান্ধীজী দেশের জন্য যা করেছেন, আমি তাকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নিচু করে তাকে প্রণামও করেছিলাম। তার এক সহযোগী নারায়ন আপ্তেরও ফাঁসি হয়েছিল একই সঙ্গে।

গান্ধী ভারতে এবং বিশ্ব জুড়ে মহাত্মা (মহান আত্মা) এবং বাপু (বাবা) নামে পরিচিত। ভারত সরকার সম্মানার্থে তাকে ভারতের জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করে।

গান্ধীজীর কিছু বিশেষ বাণী
জীবন দর্শন : জীবন দর্শন সম্পর্কে গান্ধীজীর একটি অমর উক্তি হল- ‘জীবন নশ্বর, তাকে অমর করতে শেখো।’ এই উক্তি যুগে যুগে তারুণ্যকে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে।

মানবিক গঠন : মানবিক গঠন কেমন হওয়া উচিত? মানসিক বিকাশই বা কেমন হওয়া উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে গান্ধীজীর আরও একটি বাণী। সেটি হলো- ‘একজন মানুষ তার চিন্তার দ্বারা পরিচালিত, তার ভাবনার মতোই তার ভবিষ্যতের চেহারা হয়।’

ক্ষমতার ব্যবহার : ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার হতে পারে? এই কৌতূহল নিরসন করে গান্ধীজীর বক্তব্য, ‘দুর্বল মানুষ ক্ষমাশীল হতে পারে না, ক্ষমা শক্তিমানের ধর্ম।’

মনোবল : মনোবল কী রকম হওয়া প্রয়োজন? শক্তির উৎস আর মনোবলের মধ্যে সম্পর্ক কী, এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগতে পারে। এক্ষেত্রে গান্ধীজীর একটি বাণী উল্লেখ্য, ‘শক্তি দেহের ক্ষমতা থেকে আসে না, আসে মনের বলের মাধ্যমে।’

মানসিক নিয়ন্ত্রণ : নিজেকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখবার জন্য কীরকম মনোভাবের প্রয়োজন? উত্তর দিচ্ছে গান্ধীজীর আরও একটি উক্তি- ‘নিজেকে পালটাও, নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’

অহিংসা : অহিংসার পাঠ তিনি আজীবন সারা বিশ্বকে পড়িয়ে এসেছেন। আফ্রিকা থেকে ভারত, তাঁর দেখান রাস্তায় চলে শিখেছে হিংসা আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা। গান্ধীজী বলেছেন, ‘অহিংসভাবে তুমি গোটা বিশ্বকে আন্দোলিত করতে পার।’ ‘গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে ..’ ‘গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে ..’ অহিংসার নজরে সবাইকে দেখা উচিত। এমনই শিক্ষা দিয়েছে গান্ধীজীর আরও এক বাণী- ‘চোখের বদলে চোখ গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে।’

বিপ্লব : বিপ্লব নিয়ে গান্ধীর উল্লেখ্যযোগ উক্তি হচ্ছে- ‘পৃথিবীটাকে যেভাবে বদলাতে চাও, ঠিক সেই পরিবর্তনটা তোমার নিজের মধ্যে আনো।’

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি