ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

মৃত্যু ও আশাবাদের কথা

সাইফুল ইসলাম

প্রকাশিত : ২২:০৮, ৪ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২২:৩১, ৪ এপ্রিল ২০২০

করোনা ও চিকিৎসা

করোনা ও চিকিৎসা

মহামারীর এ সময়ে আমরা নিরাপদে থাকতে বাসায় সময় কাটাচ্ছি। অনেকেই বাসায় থাকার এই সময়টাকে সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছি। কেউ আমরা পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, আবার কেউ কাটাচ্ছি নানাভাবে মানুষের সহযোগিতা করে। শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেকেই আবার এই সময়টাকে ব্যয় করেছি- অহেতুক দুশ্চিন্তা করে, ভয় পেয়ে, নেতিবাচক কথা বা ভাবের আদান-প্রদান করে। অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভার্চুয়াল জগতে কাটানোর মাধ্যমে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, নিজেকে আরও ভয় এবং আতঙ্কে ভাসিয়ে।

আসলে গুজবের যেমন হাত-পা নাই, তেমনি আতঙ্কেরও হাত-পা নাই। ভুতের অস্তিত্ব যেরকম কল্পনায়, তেমনি ভয়ের অস্তিত্বও বিস্তার করে কল্পনার জগতে। কল্পনা থেকে মনোরাজ্যে এবং মনোরাজ্য থেকে দেহে এসবের বিস্তার হয়। ভয় সবসময়ই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, নষ্ট করে দেয়, দুর্বল করে দেয়।

ভয় যেরকম বিশ্লেষণের আলো সহ্য করতে পারে না; করোনা-আতঙ্কও এই বিশ্লেষণের আলোয় উধাও হয়ে যাবে। কারো কারো মনের অবস্থা এখন এরকম যে, ‘করোনা’ যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে- পাওয়া মাত্রই খেয়ে ফেলবে। এই ভয়কে জয় করতে আসুন বিশ্লেষণের আলো ফেলি বাস্তবতার ওপর।

বাস্তব সত্য হচ্ছে- করোনা ভাইরাসে যারা আক্রান্ত হন, তাদের ৮১ শতাংশই মাইল্ড বা সাধারণ অসুস্থ হন। যেটার জন্যে হাসপাতালে যাওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না! ১৪ শতাংশ অসুস্থ হন, যাদেরকে হাসপাতালে নিতে হয়। বাকি ৫ শতাংশ ক্রিটিকেল বা জটিল। ইনটেনসিভ কেয়ারে নিতে হয়। তাদের অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে। এটা হচ্ছে নিউইয়র্ক টাইমসের ১৮ মার্চের রিপোর্ট। তাহলে যেই রোগের ৮১ শতাংশের জন্যে হাসপাতালেও নেয়ার প্রয়োজন হয় না; সেটাকে সর্দি-কাশি-জ্বর মানে ফ্লু বলা যায়!

বিশিষ্ট চিকিৎসকদের মতে, শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত যে শুদ্ধাচার, সেটা যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে সংকট আমাদেরকে তেমন কিছুই করতে পারবে না। যে কারণে আমাদের এখানে করোনার সুযোগ করতে পারার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। যদি আমরা একটু সচেতন হই এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। চিকিৎসকরা বলছেন, মানে সরকার বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছেন যে, হাতটাকে ভালোভাবে ধোয়া এবং কারো হাঁচি-কাশি বা এই জাতীয় কোনোকিছু দেখলে তার থেকে দুই ফিট/তিন ফিট দূরত্ব মেইনটেইন করা। তার বডি-টাচের মধ্যে না যাওয়া। এটা একটা সুন্দর পদক্ষেপ।

বাস্তব তথ্য হলো- করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ জানুয়ারি থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা হচ্ছে ৫৯ হাজার ১৬৫ জন। অর্থাৎ যদি আমরা গড় করি- ৭২ দিনে গড়ে মৃত্যুর হার হচ্ছে প্রতিদিন ৮২১ জন। আর প্রত্যেকদিন সারা পৃথিবীতে মারা যাচ্ছেন গড়ে প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার মানুষ। এর মাঝে শুধু হৃদপিণ্ডের সাথে সম্পর্কিত রোগে ও স্ট্রোকে মারা যান প্রতিদিন প্রায় ৪১ হাজার ৬৪৩ জন (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী)। প্রতিদিন বিশ্বে যে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয় তার জন্য তেমন কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে না বা হৃদরোগে যে প্রতিদিন ৪১ হাজার মৃত্যু হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু এই আটশ মৃত্যু আতঙ্ক সৃষ্টি করছে! 

এবার একটা ঘটনার চিত্র তুলে ধরি। ‘ডায়মন্ড প্রিন্সেস’-একটা লাক্সারি ক্রুজ শিপ। এই ক্রুজ শিপ জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরে পৌঁছায় ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে। জাপানিজ কর্তৃপক্ষ যখন খবর পান যে, এখানে করোনার রোগী আছে; তাৎক্ষণিক তারা পুরো জাহাজটাকে কোয়ারেন্টাইন ঘোষণা করেন। অর্থাৎ সেখানে কেউ যেতেও পারবে না; বেরুতেও পারবে না। ১৬ মার্চ পর্যন্ত জাপানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ৭১১ জন প্যাসেঞ্জার এবং ক্রু'র সবাইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সেখানে ৭১২ জনকে পাওয়া গেল, যাদের শরীরে করোনার জীবাণু রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ৩৩৪ জনের ভেতর রোগের কোনো লক্ষণই পাওয়া যায় নি। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় ৩৭৮ জনের শরীরে। অর্থাৎ মোট যাত্রী ও ক্রুর মধ্যে অসুস্থতার হার হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ! একসাথে এক জায়গায় একমাস থাকার পরও আক্রান্তের হার মাত্র ১০ শতাংশ! আর ২৪ মার্চ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০ জন। যাদের প্রত্যেকের বয়সই ছিলো ৭০ বা তার ওপরে। 

মৃত্যু- করোনায়, নাকি অন্য কারণে?: করোনায় মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়ে যাচ্ছে। বয়স্ক যারা মারা যাচ্ছেন এই ‘ফ্লু’র সময়ে; তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, নাকি অন্য রোগ তাদের মৃত্যুর কারণ- এটা নিয়ে যুক্তরাজ্য, ইটালি এবং বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সংশয় রয়েছে, সন্দেহ রয়েছে। ইটালিতে যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, ৯৯ শতাংশ আগে কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন (সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার ২৩ মার্চ ২০২০)। ইটালিতে যারা মারা যান ‘করোনা-আক্রান্ত’ বলে কথিত তাদের মাত্র ১২ শতাংশের ডেথ সার্টিফিকেট হচ্ছে যে, তারা সরাসরি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন (সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ৩০ মার্চ ২০২০)। অতএব এ থেকে বোঝা যায় যে, যারা মারা গেছেন তারা অধিকাংশই বয়স্ক এবং তারা আগে থেকেই নানান রকম জটিলতায় ভুগছিলেন।

এ ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর গ্লোবাল ইনফেকশাস ডিজিজ এনালাইসিস-এর প্রফেসর নীল ফার্গুসন খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, “আসলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেছেন যুক্তরাজ্যে এটা বলা মুশকিল। কারণ যারা এ সময় মারা গেছেন তাদের দুই-তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে অর্ধেকের বয়স এতটাই ছিল যে, তারা যেকোনোভাবেই এসময়ে মারা যেতে পারতেন। অর্থাৎ ‘করোনা’ না হলেও তারা মারা যেতে পারতেন। এদের বয়স ৭০-এর ওপরে।” যুক্তরাজ্য, স্পেন এবং ইটালির মৃত্যুর হার ও কারণ খুব সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনায় তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, যারা আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন। বয়সের কারণে যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছিল।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস কাউকে আক্রমণ করবে কি করবে না- এটা সবসময় নির্ভর করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরে। আমাদের চারপাশে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস-এলার্জেন-ফাঙ্গি এগুলো রয়েছে এবং প্রতিদিন আমরা এই কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস-এলার্জেন-ফাঙ্গির সাথে লড়াই করেই আমরা বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, ভালো আছি। কারণ একটাই, আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম। এটা যদি ঠিক থাকে, তাহলে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের আক্রমণ খুব সহজেই ঠেকানো সম্ভব। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাশ্চাত্যের যে-কোনো মানুষের চেয়ে, যে-কোনো জাতির চেয়ে অনেক বেশি! এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমরা অধিকাংশই প্রতিদিন স্বাভাবিক পানি, ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করি ছোটবেলা থেকে। যার ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রবল। আমাদের দেশে করোনার অবস্থান দেখেও আমরা বুঝতে পারি এ কথার সত্যতা। এতদিনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ৬১ জন।

করোনা-আক্রান্ত রোগীর ভবনে থাকলেই আপনি আক্রান্ত হবেন- এই ভয় করার কোনো কারণ নাই। কারণ একটি জাহাজের মধ্যে চার হাজার মানুষ থাকার পরও মাত্র ১০ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনাতে যত লোক আক্রান্ত হয়ে যতজন মারা গেছেন, তার চেয়ে আরও অনেক অনেক বেশি পরিমাণ মানুষ সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। অতএব করোনাকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। প্রয়োজন সতর্ক হওয়া, সাবধান হওয়া।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবার উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু যে-কোনো রোগ থাকুক, খারাপ জিনিস থাকুক, অসুস্থতা থাকুক সেটার ব্যাপারে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। বাসায় থেকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের সবচেয়ে বেশি উপকার করা সম্ভব এখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্যে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন যোগ ব্যয়াম, প্রার্থনা, ধ্যান বা মেডিটেশন, ভয়ের বদলে সেবার মনোভাব, ইতিবাচক চিন্তা কথা ও কাজ, সব সময় আশাবাদী ও সাহসী থাকা, সুন্দর ঘুম, সুষম প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস। সুস্থ থাকার জন্য এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খেতে হবে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। আমাদের গণমাধ্যম, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসব নিয়মিতই বলছেন। 

আমেরিকানদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। কারণ তাদের খাদ্যাভাসে রয়েছে ফাস্টফুড, চিনিজাত খাবার এবং সফট ড্রিংকস, এলকোহল, সিগারেট ইত্যাদি। এই জিনিসগুলো একজন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। নানান রকম জটিল রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে। সেখানেও দেখা গেছে যে, যিনি ধ্যান করেন না তিনি যে সময়ে ডাক্তারের কাছে চারবার যান, সে সময়ে একজন ধ্যানী যান মাত্র একবার। কাজেই, যারা ধ্যান করেন, তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। এটা যদি আমেরিকার প্রেক্ষাপটে হয়ে থাকে তো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই বেশি এবং যারা যোগ ব্যায়াম, বা যে কোনো ব্যায়াম বা ধ্যান করেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও অনেক বেশি। যারা নিয়ম মানেন, যোগ ব্যায়াম, ধ্যান করেন তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম, যদি তারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি সুন্দরভাবে পালন করেন। এখন যেহেতু বাসায় পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেছে, এই সময়টাকে নিজের ইমিউন সিস্টেমটাকে আরও শক্তিশালী করার জন্যে কাজে লাগাতে হবে।

চেষ্টা করতে হবে সবাই যেন গুজব ও বাস্তবতা, আতঙ্ক ও সত্য, রটনা ও তথ্যের গভীরে ঢুকতে পারি। সত্যকে উপলব্ধি করে সবাই যেন সাহসী হয়ে উঠতে পারি। আমাদের যে জাতিগত সাহস এবং বীরত্বের পরিচয় আমরা যুগে যুগে দিয়েছি; সেই সাহস সমমর্মিতা এবং বীরত্ব নিয়েই আমরা জেগে উঠতে পারব বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস, আশাবাদ, সাহস ও সমমর্মিতা অটুট থাকুক, অব্যহত থাকুক সবার মাঝে। এই প্রত্যাশা ও শুভ কামনা করি।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি