ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

শুভ সত্তর পীযূষ দা

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

প্রকাশিত : ১১:০০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

সময়টা ছিল সম্ভবত ২০১৭ সালের শেষের দিকে। ঢাকা ক্লাবের একটা লাঞ্চে সমবেত বাংলাদেশের অনেকগুলো মেধাবী মানুষ। পেশায় একেকজনের অবস্থান একেকখানে, কিন্তু চেতনায় সবার অসাম্প্রদায়িকতা আর একাত্তর। পীযূষ দা-র আমন্ত্রণে সমবেত গুণীদের সেই আসরে ডাক পেয়ে উপস্থিতির সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। এর আগে-পরে পীযূষ দা-র উদ্যোগে এমনিভাবে জড়ো হয়েছেন অনেকেই। আর এমনি করে অনেক মানুষের সাথে মত-বিনিময়ের পর যে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’- এর একদিন আনুষ্ঠানিক পথচলার শুরু তার অল্প কিছুদিন আগে বনানী ক্লাবে এমনি আরেকটি সভায় গঠিত হয় সংগঠনটির আহ্বায়ক কমিটির একটি অবয়ব। সেই সভায় কালের কণ্ঠের সাংবাদিক আলী হাবিবের সহসা প্রস্তাব আর সভায় উপস্থিতির অকুণ্ঠ সমর্থনে আমি সহসাই সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব। আলী হাবিব প্রস্তাবটি উপস্থাপনের আগের মুহুর্তটি পর্যন্ত আমার এ সম্বন্ধে কোনও প্রস্তুতি ছিল না, আর সবার অমন সরব সমর্থনে নিরবে সম্মতি জানানোর বিকল্পটাও ওই মুহূর্তে ছিল আমার কাছে অজানা।

সেই থেকে পীযূষ দা-র সাথে টানা তিনটি বছরের যে পথ চলার শুরু তা এখনও চলমান। পীযূষ দা-র সাথে আমার প্রথম পরিচয়টা কবে সেটি আমার মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে এদেশের অধিকাংশ মানুষের মতই তার সাথে আমার পরিচয়টা ইথারে-ইথারে। মিডিয়ার এই জনপ্রিয়তম ব্যক্তিটির সাথে শারীরিক পরিচয় আমার হবে এমনটি আমার প্রত্যাশায় ছিল না। আর এখন বুঝি সেটি না হলে একটা বড় ধরনের অন্যায় হতো। কারণ বহুমাত্রিক এই পীযূষ দা-কে আমি হয়তো রূপালি পর্দার একজন মানুষ হিসেবেই চিনে যেতাম, ছাত্রলীগের পীযূষ দা কিংবা যুব সংগঠক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার আর চেনা হয়ে ওঠা হতো না। অচেনা থেকে যেতেন আমার কাছে বহু ওস্তাদ সাংবাদিকের ওস্তাদ পীযূষ দা, সুলেখক পীযূস দা আর মুক্তিযোদ্ধা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সবচেয়ে বড় কথা একজন মানবিক, অসাম্প্রদায়িক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়তো অচেনা রয়ে যেতেন আমার কাছে।

সম্প্রীতি বাংলাদেশের তিন বছরের পথ চলায় পীযূষ দা-র সাথে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি তাকে। জমা হয়েছে অনেক গল্প, কতো অভিজ্ঞতা। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে-আগে উত্তরবঙ্গের একটি বিভাগীয় শহরে অসাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষে সম্প্রীতি বাংলাদেশের পথ সভাটির কথা মনে পড়ছে। সভা শেষে গম্ভীরা গানের আসর। শেষ হতে-হতে সাঁঝের আঁধার। যেতে হবে তখন উত্তরেরই অন্য আরেক জনপদে। কারণ পরদিন সকালেই সেখানে আরেকটি সুধী সমাবেশ। আয়োজনেও আমাদের সম্প্রীতি বাংলাদেশ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তারপরও হঠাৎ আয়োজনে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সাথে একটি ঘরোয়া বসার আয়োজন। সম্প্রীতি বাংলাদেশের স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষিদের মধ্যে কেমন যেন একটু অস্থিরতা। তাদের আগ্রহ দ্রুত শহর ছেড়ে রওয়ানা হয়ে যাক সম্প্রীতির কাফেলা। কারণটা অবশ্য অন্য কিছু না, পথে কিছু-কিছু জায়গায় আছে ’৭১ অবিশ্বাসীদের উপস্থিতি। দুশ্চিন্তিত তারা তাদের প্রিয় পীযূষ দা-র নিরাপত্তার কথা ভেবে। অথচ নির্বিকার পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রীতির একটি বাংলাদেশের তাগিদে এইটুকু ঝুঁকি নিতে তার আপত্তি সামান্যই।

আবার গত বছর বন্যার সময়টায়, বানে ভাসছে যখন বাংলার গ্রাম, উদ্যোমী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখলাম বিপুল উদ্যোমে সম্প্রীতি বাংলাদেশ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে চাদা তুলে বহর নিয়ে রওয়া হতে টাঙ্গাইলের পথে। ট্রাক বোঝাই ত্রাণ সামগ্রী টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরে সে কি তৃপ্তি তার! ফিরতি পথে, পথের ধারের চায়ের দোকানে এই ত্রাণ অভিযাত্রার ইতি-উতি বিশ্লেষণে পীযূষ দা-র যে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস, তাই বলে দেয় বানভাসী অসহায় মানব সন্তানগুলোর জন্য তার মমতার প্রগাঢ়তা।

আবার গত বছরের এই সময়টার কাছাকাছি কোন একটা সময়েই হবে বোধহয়- এইডিস নামক ছোট্ট প্রাণীটির তাণ্ডবে বিপর্যস্ত যখন মহানগরী আর মহানগরীর সীমানা পেরিয়ে সারাদেশ, তখন পীযূষ দা-কেই দেখেছি মানুষকে আরেকটু সচেতন করায় সবটুকু উজাড় করে দিতে। কখনো মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের টি স্টলে আর বাস থেকে বাসে তো কখনো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাঁচাবাজারে দোকানিদের মাঝে লিফলেট বিতরণে ছুটে বেড়িয়েছেন অক্লান্তভাবে। একদিকে ভাঙ্গা পা নিয়ে হুইল চেয়ারে একজন মেয়র মহোদয় আর অন্যদিকে সত্তর ছুঁই-ছুঁই পীযূষ দা- এইডিসকে ঝেটিয়ে বিদায় করায় কোমড় কষে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যেন দুইজন!

একজন মানবিক পীযূষ দার এমনি অনেক গল্প গত তিন বছরে আমার ঝুলিতে জমেছে। গত নির্বাচনের আগে ঢাকায় সিরডাপের এসি অডিটোরিয়াম থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত উপজেলার মিলনায়তনে ছুটেছেন অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিজয় নিশ্চিত করার তাগিদে। শতাধিক অনুষ্ঠানে। সাথে পাকড়াও করে কখনো নিয়ে গেছেন আমাকে, তো কখনো তাকে। কোথাও আমি গিয়েছি, তো কোথাও গিয়েছে সে। কিন্তু সবখানেই গিয়েছেন তিনি। একই ছুটে চলা তার জাতীয় নির্বাচনের পর মুজিব শতবর্ষের প্রাক্কালে ‘শতবর্ষের পথে বঙ্গবন্ধু’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে আর মুজিব আদর্শকে মফস্বলের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ার অক্লান্ত তাগিদ থেকে কিংবা ‘বোরহানউদ্দিন কান্ডের’ পর সুযোগ খুজতে থাকা সাম্প্রদায়িকতাকে উল্টো আছাড় দেয়ার বাসনায় ‘সম্প্রীতি সংলাপ’ নিয়ে দেশের একের পর এক জনপদে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতাটা এই যে গত তিনটি বছরে এই একজন সত্তর ছুঁই-ছুঁই পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় যে কয়টি জনসভা আর পথসভা কিংবা সেমিনার আর সংলাপের আয়োজন করেছেন আমাদের সম্প্রীতি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, সেই সংখ্যাটিকে সত্তরকে তিন দিয়ে গুণ দিয়েও ছোঁয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি পীযূষ দা-র যে শর্তহীন আনুগত্য আর প্রগাঢ় ভালবাসা, আমার মতে সেটিও আজকের এই বাংলাদেশের অনেকের জন্যই শিক্ষণীয়। একজন শেখ কামালকে আমার চেনাটা কখনোই সম্পূর্ণ হতো না পীযূষ দা-র সংস্পর্শে না আসলে। আমি বিশ্বাস করি আজকে যারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের জানতে-বুঝতে চেষ্টা করছেন তাদের অনেক কিছুই শেখার আছে এই মানুষটির কাছ থেকে। এবছর জাতীয়ভাবে প্রথমবারের মত উদযাপিত হলো শেখ কামালের জন্মদিন। তবে বাংলাদেশের যে দুঃখ কখনোই ঘুচবার নয় তা হলো বাংলাদেশ তার এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানটিকে সম্মান দিতে এতটা সময় নিল। প্রতি বছর ৫ অগাস্ট শেখ কামালের জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে স্মরণ করার সূচনাটা এদেশে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। তার সান্নিধ্যে এসেই প্রতি বছর অগাস্টের এই বিশেষ দিনটিতে আরো অনেকের মতই আমিও শেখ কামালকে চিনেছি-জেনেছি তার সুহৃদদের জবানিতে। আমার কাছে এটি একটি বড় প্রাপ্তির জায়গা।

আমরা যারা নব্বই-এর দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম, আমি নিশ্চিত সেই কঠিন সময়ের সেইসব ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কাছেও শেখ কামাল ছিলেন অনেকখানি অচেনা। পঁচাত্তর পরবর্তী শত অপপ্রচার আমাদেরকেও কোথায় যেন, কেমন একটা বিভ্রান্তির গোলক ধাঁধাঁয় ছেড়ে দিয়েছিল। আজকের প্রজন্ম বিশেষ সৌভাগ্যবান কারণ তারা শেখ কামালকে তার জায়গা থেকে চেনার সুযোগ পাচ্ছে, আর এখনতো পাচ্ছে একেবারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। একদিন যখন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন না, দেশের মানুষ তখন তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন জানিনা, কিন্তু সাতটি স্বর্গের দরজার ওপারে বসে তার প্রিয় বন্ধু শেখ কামাল এজন্য তাকে একটিবার জন্য হলেও যে ধন্যবাদ জানাবেন এ নিয়ে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। একইভাবে বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল আর আমাদের প্রিয় দুই আপাকেও আমরা আমাদের সম্প্রীতির বাংলাদেশের জায়গা থেকে শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় আলোচনায় তুলে আনি তাদের বিশেষ দিনগুলোতে।

শুধু বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবারের প্রতিই নয়, পীযূষ দা-র কাছ থেকে আরেকটু ভালভাবে শিখেছি কিভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হয়, বিনম্র চিত্তে স্মরণ করতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের শুভানুধ্যায়ীদেরও। করোনাপূর্ব বাংলাদেশে কোন একজন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা প্রগতিশীল মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন আর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেনি সম্প্রীতি বাংলাদেশ, এমনটি নজিরবীহিন। আর এই করোনাকালেও প্রণব মুখার্জী থেকে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম আর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী থেকে মেজর জেনারেল সি আর দত্ত কিংবা কর্ণেল আবু ওসমান চৌধুরী আর সাংবাদিক রাহাত খান, প্রত্যেকের প্রতি স্মরণে আর শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

আজকের এই করোনা দিনে সহসা থমকে যাওয়া বৈশ্বিক বাস্তবতায় থেমে নেই উদ্যোমী পীযূষ দা এবং তার সম্প্রীতি বাংলাদেশ। এই করোনাকালেও ভার্চুয়াল আঙ্গিনায় সম্প্রীতি চর্চার আসর সাজিয়ে বসছেন তিনি নিয়মিতই। তার উপস্থাপনায় আয়োজিত হচ্ছে প্রতি শনিবার রাত ১০টায় সম্প্রীতি সংলাপ। সাথে আছে করোনাকালে মানবিক পীযূষ দার উদ্যোগে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আরেকটি মানবিক উদ্যোগ ‘টেলি-মেডিসিন’। হিসেব-নিকেশ কষে দেখা যাচ্ছে সম্প্রীতি বাংলাদেশের এই ভার্চুয়াল উদ্যোগগুলো এ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে দশ লাখ মানুষের কাছে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপে-আমেরিকায়।

করোনাকালে মাস্ক আর ভ্যাকসিন নিয়ে যখন সব আলোচনা আর লেখালেখি, হঠাৎ পীযূষ দা-কে নিয়ে আমার এই লিখতে বসাটা অনেকের কাছেই প্রশ্নবোধক হতেই পারে, বিশেষ করে জীবদ্দশায় কাউকে স্মরণ করা থেকে সরে আসার কালচারে আমরা যখন ক্রমাগতই অভ্যস্ত হয়ে পরছি। এর কারণ অবশ্য একটা আছে – আজ সত্তরে পা রাখলেন পীযূষ দা। অবশ্য এইদিনটাতে তাকে ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা জানিয়েই অনায়াসে দায়িত্বটা সারতে পারতাম আমি। লেখার ডালি খুলে বসার প্রয়োজন ছিল সামান্যই। কিন্তু কেমন যেন একটা তাগিদ অনুভব করলাম আর সাথে আলী হাবিব ভাইয়ের একটু প্রণোদনা।

কয়েকদিন আগে আমার নিজের হয়েছে পঞ্চাশ। এই বয়সটায় বেশিরভাগ মানুষের কাছে আমিই এখন ভাইয়ের জায়গায় আংকেল। তারপরও মাথার উপর কেমন একটা শুন্যতা মাঝে-সাঝেই অনুভূত হয়। ২০১৬-তে আব্বার মৃত্যুর পর থেকে আমার এই যে শুন্যতাটা, একজন পীযূষ দা কেন যেন সেটা কিছুটা হলেও পূরণ করেন, যদিও ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাটা থেকে আমরা দু’জন দুই মেরুতে। এটাই বোধ করি সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত শক্তি। শুভ সত্তর পীযূষ দা।

লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।

এমবি//
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি