ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

জামানত বাতিলের আশায় দিন গুনছে কোরিয়া প্রবাসীরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৪৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৯:৩৮, ১৯ জানুয়ারি ২০২১

দক্ষিণ কোরিয়ায় এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) কোটা চালুর কয়েক বছর পর সাবেক রাষ্ট্রদূত মোস্তফা কামালের প্রচেষ্টায় ও সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ইপিএস সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশ ২০০৮ সালে ইপিএস সিস্টেমে কর্মী পাঠায়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি ইপিএস কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে কোরিয়া সরকারের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে এক সফরে যান। প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণ কোরিয়া সফরের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যথেষ্ট ইপিএস কর্মী দেশটিতে যায়। কয়েক বছর ধরে নানা জটিলতায় দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারে দেশভিত্তিক কোটা পূরণ করতে পারছেই না বরং পিছিয়ে পড়ছে। অন্যান্য দেশের কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও দিনে দিনে বাংলাদেশের হ্রাস পাচ্ছে।

দুই বছর আগেও ইপিএস কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইপিএস কর্মী হিসেবে যারা কাজ করছেন তারা এমনিতেই নানা সমস্যায় রয়েছেন। পূর্বের তুলনায় মানসিক যন্ত্রণায় প্রবাসীদের মৃত্যু জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। কিন্তু একটি বিষয় তাদেরকে ব্যথিত করেছে, তা হলো ‘জামানত’ ইস্যু।

কিছুদিন আগে বোয়েসেলের জামানত নির্দেশনা প্রক্রিয়া দেখে পুরো কোরিয়া প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ হন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের শ্রম বাজার ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে জামানত ইস্যু বিলুপ্ত করতে হবে বলে বারবার প্রবাসীরা জানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ মোট ১৬টি দেশ থেকে কর্মী নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশ জামানত ইস্যু রাখেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম।

করোনার এই সময় রি-এন্ট্রি কমিটেড বন্ধ রেখেছে দেশটি। তাছাড়া ছুটিতে এবং রিলিজে থাকা অনেকেই দেশে আটকা পড়েছেন। দূতাবাস, বোয়েসেল, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশে আটকেপড়া ৫৮৮ জন কর্মী দেশটিতে ফিরেছেন।

সূত্র জানায়, দেশে আটকেপড়া বাকি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের ফেরাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত। আটকেপড়াদের কোরিয়ায় ফেরাতে ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে কথা হয়েছে। আটকেপড়াদের ফেরাতে অনুরোধ জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদও কোরিয়ার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছেন।

এরপরেও আলোর মুখ দেখেনি তারা। হতাশায় দিন কাটছে আটকেপড়াদের। যে কোনো শর্তে তারা কোরিয়ায় ফিরতে চান। গত দুই মাস আগে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল জামানত ইস্যুর বিষয়টি। বোয়েসেলের দেয়া এই সিদ্ধান্তেই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা ব্যথিত।

জামানত বিষয়ে কোরিয়ায় বসবাসরত ইপিএস কর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ দুষছেন দূতাবাসের শ্রম উইংকে, কেউবা বোয়েসেলকে। কোরিয়ায় প্রবাসীদের অধিকাংশ ইপিএস কর্মী জামানতের বিলুপ্তি চান। এমনিতে করোনার কারণে বাংলাদেশি ইপিএস কর্মীর সংখ্যা দিনেদিনে কমছে। অনেকে মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে যাচ্ছেন।

দক্ষিণ কোরিয়া থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১২তম। বাংলাদেশি শ্রমবাজারে যেখানে ইপিএস কর্মী বাড়ানো দরকার, সেখানে জামানতের বোঝা চাপিয়ে বাংলাদেশের বাজার হারানোর আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) দক্ষিণ কোরিয়াগামী ইপিএস কর্মী থেকে প্রাপ্ত জামানত বিষয়ক নির্দেশিকার সংশোধন কোরিয়াবাসীরা আজও পাইনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কন্টেট লেখক কোরিয়া প্রবাসী মিজান জাহিদ বলেন, ইপিএস কর্মীদের জামানত ফেরতের শতভাগ গ্যারান্টি থাকা সত্ত্বেও কোরিয়ান সরকারের শ্রম আইন বহির্ভূত শর্তারোপ প্রয়োগ। যেমন- কোম্পানি পরিবর্তন করা যাবে না। যেটা কোরিয়ান আইনে কোম্পানি পরিবর্তন করার অধিকার রয়েছে।

দ্বিতীয়ত: দেশে গিয়ে জামানত ফেরতের ওয়ান স্টপ সার্ভিসের নিশ্চয়তা পেলেই কর্মীরা এ প্রথাকে অবশ্যই গ্রহণ করবে বলে অনেক ইপিএস কর্মী মত দিয়েছেন।

যেমন হতে পারে কোরিয়া থেকে ফেরত বিমার টাকা পাওয়া ক্ষেত্রে দেশটি থেকে প্রস্থানের সময় কোরিয়ান এয়ারপোর্টে প্রত্যেকটা ইপিএস কর্মীর ফেরত বিমার টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়। সে রকম যদি বাংলাদেশ কোনো কর্মী কোরিয়া থেকে তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে দেশে গিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টের মধ্যে যে নির্দিষ্ট ব্যাংকগুলো আছে ওই সমস্ত ব্যাংকের কোনো ব্রাঞ্চ-এর মাধ্যমে জামানতের টাকা প্রাপ্তির গ্যারান্টি দেয়া হতে পারে।

তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে হয়রানিমূলক এবং সন্দেহজনক প্রবণতা থেকে মুক্তি পাবে প্রত্যেকটা ইপিএস কর্মী এবং বোয়েসেল ও সরকার। এতে করে বোয়েসেল এবং ইপিএস কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাসের বন্ধন আরো দৃঢ় হবে বলে অনেক ইপিএস কর্মী মতামত প্রকাশ করেছেন।

ইপিএস কর্মী মিজানুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসীবান্ধব। তিনি অনেকদিন বিদেশে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের সুখ-দু:খ সম্পর্কে জানেন। শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর করা গেলেই জামানত প্রথা বাতিল হবে। প্রবাসীদের প্রতি এটি অবিচার বলে যোগ করেন মিজানুর রহমান।

করোনাকালে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতে দাঁড় করিয়েছে। ইপিএস কর্মীরা চাই, জামানত প্রথা চিরতরে বাতিল হোক।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার আরও জনপ্রিয় করতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। কাজ করতে হবে সমন্বিতভাবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়, বোয়েসেল, দূতাবাস চাইলে জামানত প্রথা এক নিমিষেই বাতিল করতে পারে।

উল্লেখ্য, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছিলেন। তিনদিনের সেই সফর দুই দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শেখ হাসিনা দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশ্যে ২০১০ সালের ১৫ মে রাজধানী সিউলের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। সিউলে প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি মিয়ং বাকেরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। উভয় দেশের মধ্যে ঢাকা ও সিউলের মধ্যে অর্থনীতি, জ্বালানি ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল কোরিয়ার বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিটিং এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচলা। সে আলোচলায় লি মিয়ং বাক বাংলাদেশি কর্মীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন বলে জানা যায়।

দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি নাক ইয়ং বাংলাদেশ সফর করেন।

ইপিএস চালুর আগে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে যেসব কর্মী কোরিয়ায় আসতেন তারা অনেকেই দুর্দশায় জীবন যাপন করতেন। এই সব কর্মীরা বিপদে পড়লে, সে সময় কোরিয়ার মানবাধিকার সংস্থা ও চার্চসমূহের দ্বারস্থ হতেন। পরবর্তীতে ইপিএসে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তিতে কোরিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়ার সাবেক সেক্রেটারি এম এন ইসলাম জানান, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোস্তফা কামাল, কোরিয়ার ইপিএস সিস্টেমে বাংলাদেশকে অন্তভূক্তি করতে যে ভূমিকা রেখেছেন তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

একই কথা উল্লেখ করেন দক্ষিণ কোরিয়া আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা, চট্টগ্রাম অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি আবু সুফিয়ান।

উল্লেখ্য, বোয়েসেল দক্ষিণ কোরিয়াগামী বাংলাদেশি ইপিএস কর্মী থেকে প্রাপ্ত জামানত বিষয়ক নির্দেশিকা ২০২০ জারি করে। তাতে দেখা যায়, কোরিয়াগামী বাংলাদেশি ইপিএস সাধারণ কর্মীদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা এবং দক্ষিণ কোরিয়াগামী বাংলাদেশি রি-এন্ট্রি কর্মীদের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা জামানত হিসেবে পে-অর্ডার বোয়েসেল বরাবরে দিতে হয়।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি