ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

‘আমৃত্যু বাংলার মানুষকে সেবা দিয়ে যাবো’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:২০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১২:০২, ৮ মার্চ ২০১৮

ভ্যালেরি টেইলর

ভ্যালেরি টেইলর

বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবায় এক অনন্য নাম ভ্যালেরি টেইলর। যিনি জন্ম সূত্রে ব্রিটিশ হয়েও এ দেশের মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবন। মানুষের প্রতি সেবা ও ভালোবাসা দিতে গিয়ে জীবনের ৭৪টি বসন্ত কেটে গেছে। মানব সেবা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দুরে সরিয়ে রেখেছেন। বিয়েটাও করা হয়নি।

রাতদিন ভেবেছেন শুধু এদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের সেবা ও পুনর্বাসন নিয়ে। আর এ ভাবনা থেকেই ১৯৯০ সালে ঢাকার অদূরে সাভারে ১৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন চিকিৎসা কেন্দ্র। যার নাম দিয়েছেন ‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড’ (সিআরপি)। যার কলেবর বেড়ে ক্রমান্বয়ে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়ার গণকবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও পুরান ঢাকাসহ ১৩ জেলার ১১৫টি উপজেলায় এর কার্যক্রম বিস্তৃত।

সমাজসেবা অধিদফতরের সহযোগিতা ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে এসব এলাকার প্রতিবন্ধীদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে তার প্রতিষ্ঠান সিআরপি। সম্প্রতি এ প্রতিষ্ঠানের সমস্যা, সম্ভাবনাসহ আদ্যপান্ত এবং তার নিজের জীবনের নানাবিধ বিষয়ে খোলামেলা আলাপ হয় একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে। ভ্যালেরি টেলর বলেন, আজকের সিআরপি হঠাৎ করেই এত বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়নি। আমার স্বপ্ন, আগ্রহ ও একাগ্রতার ফলে সিআরপি এ পর্যায়ে এসেছে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের মানুষ সিআরপি থেকে বহুমুখী সেবা পাচ্ছে। যতদিন আমি বাঁচি বাংলার মানুষকে সেবা দিয়ে যাবো। কারণ এটাই আমার জীবন। এটাই আমার ধ্যান। এটাই আমার সম্মান ও ভালোলাগা, ভালোবাসা। সাক্ষাতকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পক্ষাঘাতগ্রস্তদের সেবায় এ ধরণের অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার শুরুটা যদি বলতেন?

ভ্যালেরি টেইলর: আমি তরুণ বয়সেই ১৯৬৯ সালে ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) নামে একটি স্বেচ্চাসেবী সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম। মাত্র ১৫ মাসের জন্য আমি এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এসে কাজ করতে গিয়ে দেখি এখানে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করার মতো তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সামান্য চিকিৎসা সেবার অভাবে অনেক লোক জীবনভর কষ্ট পেয়ে যাচ্ছেন। দুর্বিসহ এক কষ্ট নিয়ে মানুষ জীবন পার করছে। অথচ একটু চিকিৎসা পেলেই তারা সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। সে সময় আমার চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ্য হওয়া অনেকে প্রাণ খুলে আমার জন্য দোয়া করেছেন। তাদের চোখে মুখে আমি যেন এক দেবদূত হিসেবে আবির্ভূত হলাম। তাদের সেই সুস্থ্ হওয়া এবং আমাকে নিয়ে তাদের প্রশংসা অসম্ভব ভালো লেগেছিল। সেই ভালোলাগা থেকেই আমি পথ চলার অনুপ্রেরণা পাই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমানে সিআরপির কর্মপরিধি সম্পর্কে যদি বলতেন?

ভ্যালেরি টেইলর: সিআরপি আজ একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। মানব সেবার এক বিশেষ মাইলফলক সিআরপি। সমাজের অগণিত প্রতিবন্ধী ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের জীবন সাজাতে নিবিড়ভাবে কাজ করে চলেছে দুঃখী মানুষের এই প্রতিষ্ঠানটি। সিআরপিতে রয়েছে দেশি-বিদেশি কর্মীবাহিনী, তাদের মেধা, শ্রম ও আন্তরিকতার ফলে প্রতিদিন সুস্থ হয়ে নিজ ঘরে ফিরছেন মানুষ।

সাভারে সিআরপির প্রধান কার্যালয়ে প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার রোগী ফিজিওথেরাপি এবং ১ হাজার রোগী অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা নিয়ে থাকে। মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের জন্য রয়েছে ১০০ শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল।মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে একটি শিশু ইউনিট।

প্রতিবন্ধী শিশুদের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মকাণ্ডের সহায়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এখানে। আছে একটি স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি ইউনিট। বিভিন্ন প্রকার স্নায়ুবিক সমস্যা স্ট্রোক, মস্তিষ্কের আঘাত, প্যারালাইসিস ও ব্যথার জন্য এখানে রয়েছে বিশ্বমানের ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি। এখানে শেখানো হয় কম্পিউটার, ইলেট্রনিক্স মেরামত, টেইলারিং, এমব্রয়ডারি, সপ ম্যানেজমেন্ট, নার্সারি, পোলট্রি ও সেলুনের কাজসহ নানা কিছু। এখানে লেখাপড়ার জন্যও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্পেশাল নিডস স্কুল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন প্রক্ষাগাতগ্রস্ত কীভাবে এখান থেকে সেবা নিতে পারবেন?

ভ্যালেরি টেইলর: দেখুন, সিআরপির রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, তার বেশির ভাগই আসে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। তবে রোগীদের আর্থিক অবস্থা বুঝে আনুপাতিক হারে চিকিৎসার জন্য অর্থ নেওয়া হয়। আমাদের বৈদেশিক যোগাযোগের কারণে সিআরপির ফান্ড পেতে তেমন অসুবিধা হয় না। দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও ব্যক্তি প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।সেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সহযোগিতায় দীর্ঘদিন থেকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সিআরপি। তবে একজন প্রতিবন্ধী সেবা নিতে আসলে আমাদের সেবা কল্যাণ ফান্ড নামক ইউনিটটি নতুন আসা প্রতিবন্ধীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই অর্থ নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ৬টি ধাপে একজন প্রতিবন্ধীকে বিচার বিশ্নেষণ করে।যদি একেবারেই অর্থহীন হয় তবে আমরা বিনামূল্যেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।

মনে রাখবেন আমরা কোন কোন রোগীর কাছ থেকে বাধ্য হয়েই কিছু অর্থ নিচ্ছি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ওপর ভিত্তি করে। কারণ শুধু দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর একটা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। তাই যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, তাদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের ডোনাররা একপর্যায়ে বলেই ফেলেছেন, ভ্যালেরি চিরকাল তো এটা চলতে পারে না। আর দিন দিন খরচ তো বাড়ছেই। তাই একপর্যায়ে রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতেই হয়েছে। থাইল্যান্ড বা অন্য কোথাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা ভাবাই যায় না। রাজধানীর প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে তাকান। তারা কী করছে?

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পাঁচ দশক ধরে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সমাজের কোন দিকটি প্রতিবন্ধক মনে হয়েছে?

ভ্যালেরি টেইলর: সমাজে একটা নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে। তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়। করুণা করা হয়। মনে করা হয়, তারা কোনো কাজেরই নয়। বিপুলসংখ্যক সুস্থ-সবল মানুষের মানসিক এ হীনমন্যতায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এই মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সেক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা বিশাল। কেননা প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাপারে আমাদের আচরণেরও পরিবর্তন প্রয়োজন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মী বা সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণে বাংলাদেশের মানুষকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ভ্যালেরি টেইলর: বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব এখানে পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। পরিবারের একজন স্ট্রোক করলে তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার লোকের অভাব পড়ে না।এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ খুবই আন্তরিক। তবে অন্যের প্রতিবন্ধী সন্তানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা দেখা যায় না। আর আন্তরিকতা না থাকার জন্য প্রথমতো অসচেতনাই দায়ী। তাই প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজটি এগিয়ে নিতে হবে। সচেতন না করে কারো কাছ থেকে তো সত্যিকারের সহযোগিতা আশা করা যায় না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সিআরপির সেবার দুটো দিক আছে। একটি চিকিৎসা, অপরটি পুনর্বাসন। পুনর্বাসন সম্পর্কে যদি বলতেন?

ভ্যালেরি টেইলর: প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রথমে তাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ রাখাই বেশি প্রয়োজন। তারপর ধীরে ধীরে তাকে কর্মক্ষম করে তোলা। এ লক্ষ্যে সিআরপি ও বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর ফলে দেশের ৫৪টি জেলায় যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে পশুপালন, মৎস্য চাষ, মুরগী পালন, গাভী পালন ও মোটাতাজাকরণ, নার্সারি ও বাগান ব্যবস্থাপনা, মাশরুম উৎপাদন ও বিপণন এবং আরও কিছু বিষয়ের ওপর ১ মাস থেকে ৬ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ। সরকার ভকেশনাল ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করেছে।তবে শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এ ধরণের প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসলে সত্যিকার অর্থে প্রতিবন্ধীরা সমাজে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাবেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সিআরপির অগ্রযাত্রায় প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?

ভ্যালেরি টেইলর: গত ৪৭ বছর ধরে আমরা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছি। যাদের নিয়ে আমাদের কাজ তাদের ভেতর বেশিরভাগ মানুষই মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার বা চলনশক্তিতে সমস্যাগ্রস্ত। সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্যান্য দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মেরুদন্ডে আঘাত পেয়ে তারা চলনশক্তি খুইয়েছেন। তা ছাড়া অনেকে স্ট্রোক করার পর হাঁটা-চলার সক্ষমতা হারান। উভয় ধরণের রোগীই পরে হুইল চেয়ারের মাধ্যমে চলাফেরায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সিআরপি তৈরি হয়েছে গরীব প্রতিবন্ধীদের কথা চিন্তা করে।এটা কোন বাণিজ্যিক বা লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। এটাকে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকিয়ে রাখাটাই আমাদের প্রধান ও সার্বক্ষণিক চ্যালেঞ্জ।                       

এছাড়া সিআরপি ঢাকায় রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। তাই দেশের অন্যান্য জায়গাতে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপিত হলে প্যারালাইজড রোগীরা কম খরচে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা পাবেন। তাই এ সেবা দেশের জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েও আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি গত ১৯৯৯ সাল থেকে সিআরপিতে যে ফিজিওথেরাপি এবং অকুপেশনাল থেরাপির ওপর অনার্স ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়েছে। সিআরপি পরিচালিত তিন বছরমেয়াদি ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি কোর্সগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে।এ বিষয়ে সঠিক শিক্ষার ব্যাপ্তি ঘটনাও আমাদের চ্যালেঞ্জ।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রতিবন্ধী মেয়েদের খুব কাছ থেকেই আপনি দেখেছেন। তাদের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে যদি বলতেন?

ভ্যালেরি টেইলর: প্রতিবন্ধী মেয়েদের সমস্যা ও সঙ্কট অনেক বেশি। এমনিতেই মেয়ে হিসেবে সমাজে তাদের প্রতিবন্ধিতা আছে। তারওপর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে সেই প্রতিবন্ধিত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সংসারজীবনে কোনো অল্পবয়সী নারী দুর্ঘটনা থেকে প্রতিবন্ধী হলে তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে। এ রকম বহু নারী আমি দেখেছি। স্বামী হারা এসব নারীগুলো খুবই একা হয়ে পড়ে। কারণ সন্তানও তার কাছে থাকে না। বাবা নিয়ে যায়। অথচ যদি একজন প্রতিবন্ধী নারী পুনর্বাসিত হয়, সে কাজ পায় তাহলে তার স্বামী বুঝতে পারবে যে প্রতিবন্ধী হওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। আমি দেখেছি অনেক প্রতিবন্ধী নারী অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, পরিবারের প্রতি তারা ভীষণভাবে দায়বদ্ধ। তারা নিজেদের কর্মক্ষম করে তোলার জন্য একনিষ্ঠ থাকেন। নানা ধরণের প্রশিক্ষণ তারা নিয়ে থাকেন এবং নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে দাঁড় করান। এরা প্রেরণা জোগান অন্যদের। তাদের স্বামীরাও তখন স্ত্রীদের পরিবারের জন্য সম্পদ মনে করেন।তবে নিজেকে পরিবারের বোঝা না এটা প্রমান করতে একজন প্রতিবন্ধীকে দিনরাত কঠোর সাধনা করতে হয়।  

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আসেন।বাংলাদেশের মহান মুক্তিযু্দ্ধকালের স্মৃতি কিছু মনে আছে কী?

ভ্যালেরি টেইলর : নিশ্চয়ই। তারও আগের সাইক্লোনের কথাও আমার মনে পড়ে। আমি তখন চন্দ্রঘোনায়। সাইক্লোনের সময় পিঠে নৌকার আঘাতে এক লোকের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। কত মানুষ সে সময় মারা গেছেন। কিন্তু চেনা মানুষের কথা আমরা ভুলতে পারি না।

একাত্তরে এক অল্পবয়সী বস্তিবাসীর চিকিৎসা আমি করেছিলাম। পাকিস্তানি আর্মি যখন ওদের বস্তি আক্রমণ করে তখন সবাই পালিয়ে গেলেও চলনশক্তিহীন ওই ছেলেটি সরে যেতে পারেনি। সে মারা যায়। মনে পড়লে খুব কষ্ট লাগে। ১৯৭২ সালে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হসপিটালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ড. আর জে গাস্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। তখন অধিকাংশ রোগীই ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।নিজের শরীরে শক্তি ছিল তখন আমার। রাতদিন তাদের সেবাই কাজ করেছি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ঢাকার এ যান্ত্রিক জীবনে প্রয়োজনের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক কম। তারপরও মানবাধিকারের কথা ভেবে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ আসন রাখা হয়েছে। কিন্তু নগরীর বেশিরভাগ বহুতল ভবনের ক্ষেত্রেই বিল্ডিং কোড মেনে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুযোগ রাখা হয়নি। ফুটপাতেরও একই অবস্থা। এ অবস্থায় প্রতিবন্ধীর মানবাধিকার কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে?

ভ্যালেরি টেইলর : এটা আমারও প্রশ্ন। আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের অবতারণা করলেন। এ বিষয়ে আমরা কথা বলে থাকি সভা-সেমিনারে। কোনো ভবনে, সেটা আবাসিক হোক বা বাণিজ্যিকই হোক, মার্কেটও হতে পারে-যদি ভবনের নীতিমালা না মানা হয়; যদি প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য কোনো ব্যবস্থা না রাখা হয় তাহলে তো বলব তার কোনো প্রবেশাধিকারই থাকছে না। ফুটপাতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এ বিষয়ে আমরা সচেতন না হলে, সভ্য নীতিমালা অনুসরণ না করলে প্রতিবন্ধীদের পৃথিবীকে আমরা সীমাবদ্ধ করেই রাখব, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। মানবাধিকার এখানে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সবশেষে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি বলতেন?

ভ্যালেরি টেইলর: আগামী পাঁচ বছরে মৌলভীবাজার, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালে শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।এখানকার মতো বিরাট আকারে না হলেও মোটামুটি বিভাগীয় সেবা দিতে সক্ষম এমন শাখা খোলা হবে। সেসব জায়গায় প্রধানত ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি দেওয়া হবে।আর আমি তো জীবনের বেশির ভাগ সময় দিলাম এ সিআরপিকে।বাকী সময়ও দেওয়ার ইচ্চা আছে।আমি আমার জীবদ্দশায় সিআরপিকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চাই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বাংলাদেশ সরকারেকে আপনার কিছু বলার আছে কী না?

ভ্যালেরি টেইলর: সরকার সহযোগিতা ও সমর্থন দিচ্ছে বলেই সিআরপি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে।এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। তবে  সরকারের কাছে আমার সুস্পষ্ট পরামর্শ হল, দেশব্যাপী সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্তত তিনটি বেডের ব্যবস্থা করা হোক প্রতিবন্ধীদের জন্য। যেটা ৫, ৭ বা ১০ বেডে উন্নীত করা যাবে ধীরেসুস্থে। সেখানে অর্থোপেডিক বোর্ড থাকতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ভ্যালেরি টেইলর : আপনাকে ও একুশে পরিবারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, শুভ কামনা।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি