ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

ছাত্রদের নৈতিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে: আনু মুহাম্মদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২৫, ২০ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৪৯, ২১ এপ্রিল ২০১৮

আনু মোহাম্মদ

আনু মোহাম্মদ

শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সর্বোচ্চ সনদ নিয়ে করতে হচ্ছে কোচিংও। তাতেও অনেকের চাকরি মিলছে না। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার মারপ্যাঁচে ধুঁকছে মেধাবীরা। কোটা সুবিধা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা ক্ষেত্রবিশেষে মেধাহীনরাও চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জোরালো হয়ে উঠছে কোটার সংস্কার ও চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার দাবি।              

অন্যদিকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরি পরীক্ষার সর্বত্র দেদারসে চলছে প্রশ্নফাঁস। এতে লেখাপড়া না করেও ফাঁকফোকরে সনদ পেয়ে যাচ্ছে মেধাহীনরা। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা কোথায়? শিক্ষার এ পরিস্থিতির মধ্যেই দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যবেক্ষণের তালিকায় উঠেছে। দেশের গৌরবময় এ অর্জনে চ্যালেঞ্জ ও তা টপকানোর উপায় কী হতে পারে? দেশের শিক্ষা ও অর্থনীতির এসব প্রশ্নের সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের দেশের মতো এতো শতাংশ কোটা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। এটা কী করে হতে পারে যে একশ’ জন পরীক্ষা দিবে তার মধ্যে ৫৫ জন চলে যাবে কোটায়। আর  সাধারণ প্রার্থী হবে ৪৫ জন। এটাতো খুবই অযৌক্তিক এবং অন্যায় একটা অবস্থা। আমি মনে করি শতকরা ২০ ভাগের বেশি কোটা থাকা উচিৎ নয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করছে। তাদের যুক্তি নিয়োগের ৫৬ ভাগ চলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন কোটার দখলে। যার কারণে মেধাবীরা চাকরি থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে। তাদের দাবি কোটা সংস্কারের মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করা হোক। আপনি তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক মনে করেন?

আনু মুহাম্মদ: আমাদের দেশের মতো এতো শতাংশ কোটা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। এটা কী করে হতে পারে যে একশ’ জন পরীক্ষা দিবে তার মধ্যে ৫৫ জন চলে যাবে কোটায়। আর  সাধারণ প্রার্থী হবে ৪৫ জন। এটাতো খুবই অযৌক্তিক এবং অন্যায় একটা অবস্থা। চাকরিতে শতকরা বিশ ভাগ যদি কোটা থাকে সেটা আমরা বিভিন্ন বিবেচনায় রাখতে পারি। এতে বাংলাদেশের জন্য যারা বিশেষ অবদান রেখেছে তাদের জন্য একটা অংশ রাখা যায়। আমি মনে করি শতকরা ২০ ভাগের বেশি কোটা থাকা উচিৎ নয়।

কিন্তু বেশিরভাগ অংশ যদি মেধা থেকে না আসে, তবে যে সমস্ত কাজের মধ্যে তারা যাবে তারা তো সে কাজ ঠিকমতো করতে পারবে না। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তো তারা পালন করতে পারবে না। এ দায়িত্ব যদি পালন না করতে পারে তবে প্রতিষ্ঠান তো আগাবে না। যা পুরো দেশের জন্য একটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যা জাতীয় লোকসান হিসেবে দেখা দিতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা সংস্কারের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিও উঠে আসছে চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রদের থেকে। তাদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক?

আনু মুহাম্মদ: চাকরির ক্ষেত্রে আসলে বয়সের কোন সীমারেখা থাকা ঠিক নয়। যেকোন ব্যক্তি যেকোন বয়সেই তার যদি যোগ্যতা থাকে সে চাকরি করবে। তবে চাকরির বয়সসীমা রাখা হয় চাকরির অভাবের কারণে। এছাড়া অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জট থাকে যার কারণে সময় মতো চাকরি নিতে পারে না ছাত্ররা। যার জন্য তারা বয়স বাড়ালে চাকরি হবে বলে মনে করে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে যদি এমন একটা নিয়ম তৈরি হয়ে যায় যে উৎকোচ না দিলেই চাকরি হবে না। তবে ৩৫ হলেও তো কিছু হলো না। আসলে চাকরির জন্য বয়সটা বড় কথা না। বেকারত্ব বাড়লে মানুষ বিভিন্ন পন্থায় এটার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে। বড় কথা হলো কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে তোলা। সে অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সম্প্রতি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে নানা মহল থেকে। ইতোমধ্যে ওপেন বুক এক্সামের প্রস্তাব করেছেন শিক্ষাসচিব। পরীক্ষা পদ্ধতিটা আসলে কেমন হওয়া উচিৎ?

আনু মুহাম্মদ: কোচিং সেন্টার থাকলে প্রশ্নফাঁস হবেই। এক কোচিং সেন্টার অন্য কোচিং সেন্টারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রতিযোগিতায় একজন অন্যজনের থেকে ভালো ফল করতে প্রশ্নফাঁস নামক অসদুপায় অবলম্বন করে। কোচিংয়ের ওপর শিক্ষা নির্ভর থাকলে প্রশ্নফাঁস রোধ করা যাবে না। কারণ কোচিং সেন্টারগুলোর অস্তিত্ব নির্ভর করে তার প্রতিষ্ঠান থেকে কে কত বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছে, তার ওপর। 

তবে এখানে একটা বিষয় হলো এতোদিন ধরে যারা বল্ল যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। এখন তারাই স্বীকার করছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তাহলে আগে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল তার দায় কে নিবে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এতো পরীক্ষা না নিয়ে শুধু ক্লাস এইটে একটা ও এইচএসসিতে একটা নিলেই হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে কোচিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে শিক্ষাকে কীভাবে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়?

আনু মুহাম্মদ: আমাদের দেশে ক্লাস ফাইভে, এইটে আবার এসএসসিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়। পৃথিবীর কোন দেশে এতো বেশি পরীক্ষা নেওয়া হয় না। শুধু পরীক্ষা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে সিলেবাসটাও জটিল করা হয়েছে। পরীক্ষা বেশি, সিলেবাস জটিল আবার পর্যাপ্ত শিক্ষক নাই। সবকিছু মিলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে ছেলে-মেয়েদের কোচিংয়ে যাওয়া ছাড়া উপয় থাকে না। ফলে কোচিং বন্ধ হবে এ প্রতিশ্রুতি ফাঁপা একটা প্রতিশ্রুতি। কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জন্য যে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘাটতি আছে। একদিকে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত এবং যারা গাইড বাণিজ্য করে তাদের সঙ্গে সক্ষতা বজায় রাখবেন। অন্যদিকে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করবেন এটা আদোও সম্ভব না।

তাই যদি পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হয়, ক্লাস সংখ্যা বাড়ানো হয়, সিলেবাসটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনা যায়, পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক স্কুলে দেওয়া যায়, কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে লেজুড় বৃত্তি বন্ধ করা যায়, তবেই কোচিংয়ের বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদ নির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক যদি নৈতিকতা বিবর্জিত হয়, আর ছাত্র যদি মনে করে যে অসৎপথে যেয়েও ভালো থাকা যায়, তবে সে অসৎপথই উভয়ের মধ্যে প্রিয় হয়ে উঠে। মূলত শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাওয়ার কারণে নৈতিকতা কমে যাচ্ছে। শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষা ছাড়া অন্যকিছু গুরুত্ব পেয়েছে। আর সেই গুরুত্বটা এতো বেশি মাত্রায় যে নীতি-নৈতিকতা সেখানে ঠুঙ্ক বিষয়। এ থেকে বের হতে শিক্ষক-ছাত্র উভয়কে অন্যমুখী না হয়ে শিক্ষামুখী, জনকল্যাণমুখী হতে হবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো যা খুশি তাই করছে। আবার ছাত্র সংগঠনগুলোকেও ব্যবহার করছে বড় কোন অপ রাজনৈতিক শক্তি। অপ-রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে ছাত্রদের মধ্যে নৈতিকতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

এসএইচ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি