ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

দেশে পরিণত অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে: আনু মুহাম্মদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১০, ২৮ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২১:৪০, ৩ মে ২০১৮

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে বাংলাদেশের প্রবেশ, বিশাল এ অর্জনের পেছনে চ্যালেঞ্জ ও তা টপকানোর উপায়, জনসংখ্যার বোনাসকাল, বেকারত্ম, কর্মসংস্থান, ব্যাংকের ক্ষেলাপি ঋণসহ অর্থনীতির আরো সব অনুসঙ্গ নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার আর একটা অর্থ হচ্ছে আমরা অপরিণত একটা অবস্থা থেকে পরিণত অবস্থার দিকে যাচ্ছি। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করছে, বড় বড় প্রকল্প যেভাবে বাঁছাই করছে, যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করাচ্ছে, তাতে পরিণত একটা অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে ৬ বছর পর্য্যবেক্ষণে রাখবে জাতিসংঘ। পর্য্যবেক্ষণকালে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে গিয়ে আমাদের কি ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা লাগতে পারে?

আনু মুহাম্মদ: স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার আর একটা অর্থ হচ্ছে আমরা অপরিণত একটা অবস্থা থেকে পরিণত অবস্থার দিকে যাচ্ছি। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করছে, বড় বড় প্রকল্প যেভাবে বাছাই করছে, যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করাচ্ছে, তাতে পরিণত একটা অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে।

পরিণত অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানে এমন একটি উন্নয়ন ধারা, যেটা দীর্ঘ্ মেয়াদে উন্নতির কথা চিন্তা করে। দীর্ঘ্ মেয়াদে এটা কতটা টেকসই হবে সেটা বিবেচনা করে প্রকল্প বাঁছাই করে। দীর্ঘ মেয়াদে দেশের মানুষের কী হবে, সেটা মাথায় রেখে পরিবেশের কথা চিন্তা করে। দীর্ঘ্ মেয়াদে মানুষের অধিকারের বিষয় কী হবে? সেটা চিন্তা করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জনশক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা চিন্তা করে।

এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখে আগামী ২০২৪ ও ২০২৭ সালে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাব, সেটা মোকাবেলা করতে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসায় জনগণের যে প্রয়োজন, তার যে চাহিদা ও অধিকার সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের নির্বাচন থেকে শুরু করে আইন-বিচার বিভাগসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটা স্বাধীন জায়গাতে আনতে হবে।

প্রকল্প বাঁছায়ের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা থাকতে হবে, জবাবদিহি থাকতে হবে। এখন আমাদের দেশে রাস্তা ও সেতু যেটা নির্মাণ হচ্ছে, সেটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এতো ব্যয়বহুর প্রকল্প হাতে নেওয়ার অর্থ বিশ্বে আমাদের ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করা।যে কাজ ভারত ১২ কোটি টাকা দিয়ে করে, চীন ৯ কোটি টাকা দিয়ে করে, আমেরিকা ১২ কোটি টাকা দিয়ে করে, সেই কাজ যদি বাংলাদেশ ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে, তবে বুঝতে হবে এখানে ফাঁক-ফোকর আছে। এ ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিশ্বের অন্য যেসব দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হয়েছে, তাদের কোনো অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে কি না ?

আনু মুহাম্মদ: আমাদের প্রথমে জিডিপির পেছনে না দৌঁড়ানোর শিক্ষা নিতে হবে।মনে রাখতে হবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন না। প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে কী না? সে বিশুদ্ধ বাতাস পাচ্ছে কী না? সে শিক্ষা ও চিকিৎসা পাচ্ছে কী না? সে নিরাপদে জীবন-যাপন করে কী না? নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে কী না? তার খেলার জায়গাটা বা বিনোদনের ক্ষেত্র ঠিক আছে কী না? সেগুলো নিশ্চিত হওয়া। কেননা এগুলো উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি। এখন আমাদের জিডিপি বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তার মানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও তার সুফল আসছে না বা গুণগত মান মিলছে না।এ ক্ষেত্রে যদি আমরা ভুটানের কথা বলি তারা কিন্তু এলডিসি থেকে বের হয়েছে।তবে তারা শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে জোর দেয়নি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাস যুগ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অতিবাহিত করছে দেশ। এ সুযোগ বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?

আনু মুহাম্মদ: তরুণ জনসংখ্যা আমাদের অনেক বেশি। এটা আমাদের জন্য একটা আশির্বাদ। পৃথিবীর অনেক দেশে এ সুযোগ নেই। যেমন যাপান। যাপানে বয়স্ক লোক বেশি। তারা তরুণদের পাচ্ছে না।ইউরোপের বহুদেশ আছে তারা বিপদের মধ্যে আছে।তাদের তরুণ জনসংখ্যার পরিমান খুব কম। তারা এখন বিদেশ থেকে মাইগ্রেশন অনুমোদন করে। ভিন্ন দেশের তরুণদের আমন্ত্রণ জানায় কাজের জন্য। এ ঘটনা কানাডা ও আমেরিকাতেও। পৃথিবীর এতোগুলো দেশ যেখানে তরুণ জনগোষ্ঠির অভাবে আছে সেখানে বাংলাদেশ নিজেরই অনেক তরুণ জনসংখ্যা আছে। এ জনসংখ্যা কাজে লাগাতে হলে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।স্বাস্থ্য ও বিনোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া তাদের যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য প্রাথিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও বাড়াতে হবে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারত নাগরিক কাজ করে। এর পাশাপাশি শৃলঙ্কার লোকজনও কাজ করে। ইউরোপ ও আমেরিকার লোকও কাজ করে। কেন তারা কাজ করে? বাংলাদেশে যোগ্য লোক পাচ্ছে না, তাই তারা কাজ করে। তবে তো এতো তরুণ থাকাটা বোঝা হয়ে যাচ্ছে। বোঝা এ তরুণদের বেশিরভাগ আবার সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তবে বাংলাদেশের তরুণরা কেন কাজের যোগ্য হচ্ছে না? সহজেই বুঝে নিতে হবে আমাদের শিক্ষায় ঘাটতি আছে।আমাদের তরুণদের শিক্ষা দিলেও কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে না। তরুণরা আবার চিকিৎসা দূর্বলতায় সঠিকভাবে কার্য সম্পাদনে সক্ষম হচ্ছে না।

এছাড়া কর্মসংস্থান না হওয়ার কারণে সমাজে চিন্তার বিষয়টি প্রকট হচ্ছে। শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি মানুষ এখন ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে। এটাকে বলা যায় কোন রকমে কিছু না কিছু করে বেঁচে থাকা। এ পরিস্থিতিতে বেকারদের মধ্যে একটা ক্ষোভও সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সে কাজ করেই খেতে চাচ্ছে অথচ পাচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানে তরুণদের যোগ্য করে তোলার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তাকে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে এতো শিক্ষিত যোগ্য লোক, অথচ পোশাক শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বিদেশি এক্সপার্টদের বেশি বেতনে আনা হচ্ছে। কেন আমরা সে জায়গাটা নিতে পারছি না?

আনু মুহাম্মদ: আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশীদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ দেয়।কারণ তারা বিদেশেীদের ওপর বেশি আস্থাবোধ করে।এখন আমাদের সে আস্থার জায়গাতে যেতে হলে আমাদেরও দক্ষতা বাড়াতে হবে। আবার যারা ভাবে বিদেশিরাই ভালো পারে, তারাও হয়তো সবক্ষেত্রে ঠিক ভাবেন না। সে ক্ষেত্রে তাদের ধারণা বা দর্শনে পরিবর্তন আনতে হবে।সরকারকেও প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশি তরুণদের নিয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় রশদ জোগাতে হবে।যদি বিদেশি নিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবণতা খুব বেশি হয়।তবে সেখানে সরকার প্রণোদনা দিতে পারে যে দেশী চাকরিজীবি হলে কোম্পানিকে এই এই সুযোগ দেওযা হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে আরও ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?

আনু মুহাম্মদ: আমদের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রত্যেক খাতে ট্রেনিং থাকা দরকার আছে।যেমন আমাদের দেশে গাড়ীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।কিন্তু গাড়ী চালকের প্রশিক্ষণের কোন ইনস্টিটিউট সেভাবে তৈরি হয়নি।গাড়ী চালকরা অর্ধশিক্ষিত এবং নিজে নিজে কোন রকমে শিখে চালক হচ্ছে।যার কারণে দেখা যাচ্ছে দূর্ঘটনার মাত্রাও বাড়ছে।তার মানে হচ্ছে, যে ধরণের কর্মসংস্থানের চাহিদা তৈরি হচ্ছে, সে চাহিদা অনুযায়ী যে ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, যে ধরণের প্রণোদনা দরকার, সেটা নেই।যার কারণে আমাদের দেশে অনেক প্রকৌশলী বেকার থাকে।তাদের কাজের সুযোগ বা প্রণোদনা নেই।কাজেই কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে, সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে জনশক্তির দক্ষতা বাড়াতে হবে।তবেই বেকারত্ম কাটবে। এক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি খাতকে কাজের ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে কোন কোন খাতে কি পরিমান লোক লাগবে তার হিসেব বের করার দায়িত্ব দিতে পারে।এরপর সরকার সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।আবার তরুণদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনাও রাখতে পারে। অর্থাৎ সরকার ও বেসরকারী খাতের মধ্যে সমন্বয় করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বোঝা- এ খাতটির জন্য যেন একটি অভিশাপ। যা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আসলে এ থেকে বেরিয়ে আসতে করণীয় কি হতে পারে?

আনু মুহাম্মদ: ব্যাংক খাতে বড় বড় ঋণ খেলাপী যারা, তাদের তৎপরতা বন্ধ করতে সরকারকে আরো বেশি কঠোর হতে হবে।এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।যারা ঋণ খেলাপি তাদের বাড়তি সুবিধা না দিয়ে তাদের কাছ থেকে খেলাপির অর্থ আদায় করতে হবে।অধিকতর ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।যে সমস্ত ব্যাংকগুলো দুষ্ট লোকদের দ্বারা পরিচালিত সে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।ব্যাংকিং খাতে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি হয় সেজন্য ব্যাংকিং রীতি-নীতিগুলো যথাযথ পরিপালনে জোর দিতে হবে।

/ এআর /

     


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি