ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

রবীন্দ্র-অনুভবে লোকসাহিত্যবিহীন সাহিত্য প্রাণহীন

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ০০:৩৭, ৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ০০:৩৯, ৬ আগস্ট ২০২০

ড. রকিবুল হাসান

ড. রকিবুল হাসান

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের মহান এক ঋষিপুরুষ। যে কানো দেশের সাহিত্যের চূড়ান্ত বিকাশের জন্যে এ রকম একজন রবীন্দ্রনাথই যথেষ্ট। বাংলা সাহিত্য সেই বিচারে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ বাংলা আর বাঙালির কবি। নানা অভিধায় তিনি অভিহিত। কোন অভিধাই তাঁর জন্যে যথেষ্ট নয়। তিনি বিরল এক প্রতিভা বাংলার সাহিত্যাকাশে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সকল শাখাতেই স্বর্ণ-ফসল ফলিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্যরকম এক প্রতিভা তো বটেই, প্রায় একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্ব আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সামগ্রিক অবদান মূল্যায়ন না করে শুধু যদি যে কোন একটা বিশেষ শাখাতেও যদি তাঁর অবদান বিবেচনা করা হয়, সেখানেও তিনি সুনিশ্চিতভাবে অমর এবং কালজয়ী। 

আমাদের লোকসাহিত্য যখন গাঁও-গেরামের পথে পথে উড়ছে, অশিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে ভাসছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয়, এ গুলো যে আমাদের প্রাণের জিনিস, সাহিত্যের শেকড়-রস, রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সেই তা অনুভব করেন। শুধু অনুভবই করেন নি সেগুলো নিজে সংগ্রহও করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল প্রতিভা অনায়াসে তা পাশ কাটিয়ে সাহিত্যের আরো অন্য বিষয় নিয়ে অধিক মনোযোগী হতে পারতেন, কিন্তু প্রাণের যে মূল রস সেটিকে তিনি অস্বীকার করেন নি, বরং তা ধারণ করেই তিনি সাহিত্যসাধনা করেছেন। অথচ সে-সময় আমাদের সাহিত্যেও ভিনদেশি নানামাত্রিক সাহিত্যের একটা ঝড়োবাতাস এসে লেগেছিল, রবীন্দ্রনাথ সেদিকে ত্ধাসঢ়;কাননি, এক তরুণঋষীকবি গভীর মগ্নতায় যেন মাটির শেকড় থেকে রস উৎসারনেই বেশি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। সে কারণেই আমাদের লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে আজ উজ্জ্বলতর হয়ে বেঁচে থাকতে পেরেছে, আমরাও আমাদের সত্যিকারের শেকড়টির স্বরূপটি চিনে নিতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথ এখানেও অনন্য, অসাধারণ এবং অবশ্যই সকলের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা অগ্রগামী এক সাহিত্যসাধক। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকসাহিত্য সংগ্রহ করলেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শিলাইদহ-পতিসর- শাহজাদপুর। এসব অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি থাকায় তাঁর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

এসব অঞ্চলের নদী-প্রকৃতি, লোকসাহিত্য আর বাউল গান তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সব শাখাতে বিচরণ না করেও যে কোন একটি শাখাতেই বিচরণ করে অমরত্ব অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু অসীম জ্ঞানপিপাসী ও সাধকপুরুষ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সকল শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন এবং তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন এবং বিশ্বসম্মানে স্বীকৃত হয়েছেন। অথচ তিনি যৌবনেই শুরুতেই মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলা লোকসাহিত্যের ছড়ার ‘সহজ-সরল-স্বাভাবিক কাব্যরসে’। তিনি মনে করতেন এ ছড়াগুলোর মধ্যেই রয়েছে আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস নির্ণয়ের উপাদান। এ ছড়াগুলোকে তিনি জাতীয় সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণের উপভোগ্য ও আয়ত্ত্বগম্য; সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না।’ রবীন্দ্রনাথের এ ভাবনা ও বোধ তরুণ বয়সেই। নিজের দেশের মাটির শেকড় থেকে যে সাহিত্য জন্মগ্রহণ করে, যে সাহিত্যের মধ্যে দেশের মানুষের প্রাণের কথা ও আনন্দ নিহিত থাকে, সেটিই যে আসল,  রবীন্দ্রনাথ এ-সত্য অনুধাবন করেছিলেন সাহিত্যজীবনের প্রায় শুরুতেই। তিনি নিজেও গ্রামবাংলার মাটি থেকে উঠে আসা ছড়া-গানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মুগ্ধ হয়েছিলেন। সে-কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন, শুধু স্বীকারই করেন নি, সেগুলো সংগ্রহ করেছেন, প্রকাশ করেছেন, প্রচার করেছেন, বিচার-বিশ্লেষণে করেছেন, মূল্যায়ণ করেছেন। কারণ তিনি তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের সাহিত্যের প্রাণের আনন্দ এসব গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেই লুকায়িত রয়েছে। সেটিকেই তিনি বের করে এনেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন এটিই আমাদের সাহিত্যের মূল শেকড়। যা গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবনের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত। যুগ যুগ ধরে যা নদীর স্রোতের মতোই যেন গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে একইভাবে প্রবাহিত হয়ে আসছে। যেখানে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আর লোকগান-ছড়া অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের উক্তি ‘গ্রামের জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনযাত্রার সঙ্গী সাহিত্য, বহুকাল বিনা পরিবর্তনে একই ধারায় চলিয়া আসে।’ বাংলা জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব ছড়া গান সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলা সাহিত্যের প্রাণের সত্যিকারের আনন্দ আবিষ্কার করে সাহিত্যের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। সাহিত্যের মূল শেকড় যে লোকসংস্কৃতি তা তিনি ধরেন বাউল-বীক্ষণে :

আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে,
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।

অথবা,
আমি কে তাই আমি জানলেম না,
আমি আমি করি কিন্তু,
আমি আমার ঠিক হইল না

বাউলের এসব গান ও সুর রবীন্দ্রমানসে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। লোকছড়া-গান আর বাউলের সুর তখন এ অঞ্চলগুলোতে বিশেষ এক আবহ তৈরি করেছিল, যেখানে ছিল প্রাণের গভীরে আনন্দরস, রবীন্দ্রনাথ সেটি সহজেই ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর সাহিত্যে এর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। 

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন : শিলাইদহে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, গোঁসাই রামলাল, গোঁসাই গেপাাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী ও লালনের শিষ্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-পরিচয় হয়েছে। শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া-অঞ্চল থেকে সংগৃহীত লালন ফকির ও গগন হরকরার গান তিনি সুধীসমাজে প্রচার করেন। শিলাইদহ-অঞ্চল থেকে লোকসাহিত্য এবং লোকশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ ও নিদর্শনও সংগ্রহ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনার সূত্রে শিলাইদহে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় কাটিয়েছেন। শিলাইদহে অবস্থানকালে তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা বাঁক ঘটেছিল। বিভিন্ন বাউল-ফকির ও বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর সংস্পর্শে যেমন তিনি এসেছিলেন, তেমনি এসব এলাকার ছড়া-গানও তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর সাহিত্যে যা ব্যাপকভাবে প্রভাব-বিস্তার করেছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউলদের সঙ্গে আমার সর্ব্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ- আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউলসুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন্ধসঢ়; একসময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে লোকগান ও বাউলগানের প্রভাব ব্যাপক। এবং তিনি এসব শুধু সংগ্রহই করেন নি, তিনি এগুলোকে নানাভাবে সুধীসমাজের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে এসব গানের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর আগে আর কেউ আমাদের লোকসাহিত্য নিয়ে এভাবে ভাবেন নি, এভাবে সংগ্রাহকের ভূমিকায়ও আবির্ভূত হন নি। 

এ প্রসঙ্গে লোকবিজ্ঞানী মযহারুল ইসলামের মন্তব্য স্মরণযোগ্য :
রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম আমাদের লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন, আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেন। তিনি লোকসাহিত্যের অন্তর্নিহিত রসতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করে বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমর অধ্যায় যুক্ত করেছেন। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি আজও একটি একক আসনের অধিকারী, তিনিই এ ধারার সূত্রপাত করে আমাদের পথিকৃত হয়ে আছেন।

রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকছড়া-গান সংগ্রহ করে অসাধারণ এক দায়িত্বশীলতা মমত্ববোধের পরিচয় রেখে গেছেন। সাহিত্যের এ ধারাটিও সেখান থেকেই এক নতুন প্রাণ পেয়ে যায়। যদিও এর আগে প্রবাদের কিছু সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছিল। সে প্রবাদগুলো তত্ত্বপ্রধান রচনা হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তত্ত্ব অপেক্ষা রসকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং রসের আবেদনই তাঁর কাছে বেশি ছিল। সেকারণেই তিনি প্রবাদ সংগ্রহের গতানুগতিক ধারায় অগ্রসর না হয়ে বাংলা লোকসাহিত্যের নিজস্ব যে ছড়া তার অনুসন্ধানে নামেন। যেগুলোকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জাতীয় সম্পত্তি বলেও অভিহিত করেছেন। এদেশের ইংরেজি- শিক্ষিত মানুষ যখন বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আভিজাত্যবোধের অহংবোধে নিজেদের উচুঁস্তরের মানুষ ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথ তখন মাটির শেকড়েই আপনস্বরূপ সন্ধানে নিবৃত্ত থেকেছেন। 

এ প্রসঙ্গে প্রসূন মুখোপাধ্যায় বলেছেন :
আমাদের ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টি যখন পাশ্চাত্যের পাহাড়-পর্বতমালায় স্খাপিত হয়েছে, তারুণ্যের দুরন্ত উৎসাহে রবীন্দ্রনাথ তখন ধানের শীষের উপস্থাপিত শিশির বিন্দুসম দেশীয় লোকসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। শুধু আলোচনা বললে ভুল বলা হবে, বলা উচিত গবেষণা করেছেন। লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ কেমন করে, কোন পদ্ধতিতে করতে হয় এ
পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথই সেই অচলায়তনে মুক্তধারা বর্ষণ করলেন।

আমাদের লোকসাহিত্য নানামাত্রিকতা থেকেই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা লোকসাহিত্যের বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে যেমন, তেমনি এ সাহিত্য বৈত্র্যিপূর্ণ। ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ, লোকসাহিত্য, লোককাহিনি, লোকগীতিকা, ভাব সংগীত, বাউল মুর্শেদী গান লোকসাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের অংশ। এদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই ভাবুক প্রকৃতির, আবার জীবনসংগ্রামেও তারা প্রচ- রকমের কর্মমুখর। এদেশের প্রকৃতির সঙ্গেই তাদের জীবনকর্ম, আনন্দ-বেদনা আর উৎসবের রঙমাখা। এ সবের ভেতর থেকেই মাটি থেকে উৎসারিত রসের মতোই যেন তাদের মনের গহিন থেকে উঠে আসে ছড়া আর গান। যার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকে বাংলার ষড়ঋতুর চারিত্র্য। এসব ছড়া কিংবা গানের নানারকম নামও থাকে। যেমন: বৃষ্টির গান, সারি গান, নৌকা বাওয়ার গান, ধানকাটার গান, ধান ভানার গান, বিয়ের গান এ রকম অনেক নামের গান লোকসাহিত্যের বুক জুড়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সমাজের সুধীজনের কাছে আমাদের লোকসঙ্গীত বা লোক সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।কারণ এগুলোই আমাদের সাহিত্যের প্রাণের সত্যিকারের রস।

আমরা যদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ করি দেখা যাবে সব দেশের মহান কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তাঁদের স্বদেশানুরাগ ও স্বাজাত্যবোধই প্রেরণার প্রধান উৎস। অষ্টাদশ শতকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ প্রমুখ তাঁদের পুরনো ব্যালাডকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং তার পুনর্জাগরণের চেষ্টা করেন। সুইডিশ সংস্কৃতিবিদ লিনিয়াস বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রথম সংস্কৃতির লোকায়ত ধারার পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করেন। এ ধারার পথপ্রদর্শক নিঃসন্দেহে সুইডেন।এ ধারাটিকে অনুসরন করেন হিল্টেন-ক্যাভেলিয়াস। তিনি দেশীয় সংস্কৃতির নিদর্শন সংগ্রহে নিবেদিত এক প্রাণ ছিলেন। উনিশ শতকে এসে এ ধারাটি নতুন এক বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় রোমান্টিক চিন্তাস্রোতের সঙ্গে লোকসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের জন্যে এটি ছিল দারুণ এক প্রয়াস । যা প্রবাহিত হয় সমগ্র ইউরোপজুড়ে। আর এতে অনুপ্রাণিত হয়ে হেজেলিয়াস সুইডেনে লোকসংস্কৃতির মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি লোকসংস্কৃতির বিখ্যাত মিউজিয়াম হিসেবে বিশ্বখ্যাত। লোকসংস্কৃতির এ ধারা ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডের দিকে প্রসারিত হয় উনিশ শতকের চতুর্থ পর্বে। সেখানে ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোকলোর সোসাইটি। এখানে বড় ধরণের একটা কাল ব্যবধান ঘটে যায়। এর কারণ ইংল্যান্ডের যন্ত্রশিল্পের বিপ্লব। এ বিপ্লবের ফলে তারা এমনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, নিজেদের কৃত কীর্তির দিকে ফিরে তাকাবার সময় ছিল না। ১৮৭৮ সালে ফোকলোর সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৮৮৯-৯৩ সালের মধ্যে তিনবার আন্তর্জাতিক ফোকলোর কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এ ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডে লোকসংস্কৃতির ধারাটি বিকাশের পথে এগোয়। সিসিল শার্প এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাশ্চাত্য দেশের লোকসাহিত্যে চর্চা কিন্তু আমাদের দেশে কোন প্রভাব রাখতে পারে নি। রবীন্দ্রনাথসহ অন্য যাঁরা এই লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও চর্চায় নিবেদিত হয়েছেন, তাঁরা নিজস্ব উদ্যোগেই হয়েছিলেন। 
রবীন্দ্রনাথ- পরবর্তী যাঁরা এ পথে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রপ্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
কৃতি ও কীর্তি একেবারে তাঁর নিজের অর্জিত। একথা ঠিক, আমাদের উনিশ শতকের সাহিত্য পাশ্চাত্য সভ্যতা-শিক্ষা-সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, কিন্তু আমাদের লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিতে তা কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমাদের লোকসাহিত্য আপনতাগিদেই গভীর মমত্ববোধে জন্ম নিয়েছে। যার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। যে লোকছড়াগুলো আজো মুখে-মুখে ফেরে, একদিন এই ছড়াগুলো রবীন্দ্রনাথকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহিত করেছিল। ছড়াগুলোর সহজ-স্বাভাবিক কাব্যরস তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের উক্তি:
আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোজ্ঞ কোনো রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহোদবেলকের গন্ধ তাহাকে পুষ্পচন্দন গোলাপ-জল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণিতে ভুক্ত করা যায় না। সমস্ত সুগন্ধের অপেক্ষা তাহার মধ্যে যেমন একটি অপূর্ব আদিমতা আছে, ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসংগতিহীন।
রবীন্দ্রনাথ ছড়াগুলোর ভেতর তত্ত্ব বা তাত্ত্বিকতা খোঁজার চেষ্টা করেন নি। অর্থগত ব্যাপারটিও গুরুত্ব দেন নি। তিনি ছড়াগুলোকে দেখেছেন ‘শিশু’র সুন্দরের মতো। যেখানে রসটিই আসল। এবং যে রসটি চিরকালীন। যা একই সাথে নতুন, বহু বছর পরও নতুন অথচ সবচেয়ে পুরনো।

আমাদের লোকছড়াগুলোও ঠিক সেই একই চরিত্র ধারিত। তিনি লোকছড়ার মধ্যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজেকে হারিয়েছিলেন। ছড়া নিয়ে আলোচনা করা বা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সমালোচনার নিয়ম-নীতি মানেন নি। প্রথাসিদ্ধ পথও গ্রহণ করেন নি। তিনি গ্রহণ করেছিলেন আত্মকথনের পথ। তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের বিশেষ দিক এটি। লোকছড়াগুলো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি:
ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা-অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূবে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে; সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারম্বার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন, যেমন সুকুমার, যেমন মূঢ়, যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে। এই নবীন চিরত্বের কারণ এই যে, শিশু প্রকৃতির সৃজন; কিন্তু বয়স্ক মানুষ বহুল পরিমাণে মানুষের নিজকৃত রচনা। তেমনি ছড়াগুলিও শিশুসাহিত্য; তাহারা মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে। শিশুর মধ্যে যে সরলতা ও সুন্দরতা সেই সরলতা ও সুন্দরতার বুননেই তৈরি আমাদের লোকছড়া। যে কারণে ছড়াগুলো শিশুর মতোই চিরত্ব সুন্দরে বেঁচে থাকে। ছড়ার ভেতর সমাজ ও কালচেতনাও থাকে। ছড়ার ভেতর দিয়েই একটা সমাজকে যেমন চিনে নেয়া যায়, তেমনিভাবে বুঝে নেয়া যায় সেই সময়কালটা কেমন ছিল। শিশু যখন কোন ছড়া শোনে, তখন ছড়াটির রসই তার কাছে প্রধান, সমাজ বা সময়কালটি তার কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সমাজ বা সময়কাল বোঝার বয়স তার হয় নি। তার ভালো লাগা বা আনন্দই তার কাছে আসল। এমনকি অনেক ছড়াতে অসংগতি বা অসংলগ্নতাও থাকে সেসবও তার নির্মল আনন্দে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যেমন:

বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর নদে এল বান।
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যে দান।

এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন এক কন্যে খান।
এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান।

এ ছড়াটিতে একটি সমাজের ছবি আছে যেমন, তেমনি একটি সময়কালের ইতিহাসও লক্ষণীয়। আমাদের সমাজে একসময় বহু বিবাহের বিষয়টি স্বীকৃত ছিল। ব্রাহ্মণ-পাত্রের অভাবে দেখা যেতো এক ব্রাহ্মণ-পাত্রের সঙ্গেই অনেক ব্রাহ্মণ-কন্যার বিবাহ সম্পাদিত হতো। কারণ অবিবাহিত কন্যাকে পাত্রস্থ করাই তখন রীতি বা ধর্ম কিন্তু পাত্রটির আরো কতগুলি স্ত্রী আছে সেটি কোন বিবেচ্য বিষয় ছিল না। এ ছড়াটিতে সেটিকেই সেই আদলেই অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে বাল্যরসটি প্রধান হয়ে উঠেছে। এখানে শিব ঠাকুর আর কেউ নয়‘শিয়াল প-িত’। তিন কন্যেকে বিয়ে করার পর শিব ঠাকুর রূপী শিয়াল পন্ডিতের আর তার স্ত্রীদের যে অবস্থা তৈরি হলো সেটিই এ ছড়ার মূল আনন্দের জায়গা।স্ত্রীদের অশান্তিকর জীবন এবং শিব ঠাকুরের হৃদয়বিদারক যে জীবন তৈরি হলো শিশুমনে ওসবের কোন স্থান নেই। শিশুমন সেখান থেকে শুধু আনন্দরসটুকুই গ্রহণ করতে পারে এবং সেটিই করে। এ ছড়াটির প্রথম চরণটি রবীন্দ্রনাথকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করতো। এরকম অনেক ছড়ার উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। যেমন:
১. নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোঁটন বেঁধেছে।
রড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে।।
২. দোল দোল দুলুনি।
কানে দেব চৌদানি।
৩. আতা গাছে তোতা পাখি, দালিম গাছে মউ
কথা কও না কেন বউ।
৪. নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোঁটন বেঁধেছে।।
৫. ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি আমার বাড়ি যেয়ো।
সরু সুতোর কাপড় দেব, ভাত রেঁধে খেয়ো।
৬. হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম সীতারামের খেলা।
৭. ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি।
চাম কাটে মজুমদার।
৮. ও পারে তিল গাছটি
তিল র্ঝুধসঢ়; র্ঝুধসঢ়; করে।
৯. হরম বিবির খড়ম পায়
লাল বিবির জুতো পায়।
১০. আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
১১. খোকা খোকা ডাক পাড়ি।
খোকা গিয়েছে কার বাড়ি।
১২. এত টাকা নিলে বাবা ছাদ্ধসঢ়;নাতলায় বসে
এখন কেন কাঁদ বাবা গামছা মুখে দিয়ে।
এরকম অসংখ্য ছড়ার উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যাবে যেখানে সমাজের ছবি আছে, সময়কালের ছবি আছে মানবসভ্যতার ইতিহাস আছে। কিন্তু সরল মনের শিশুদের কাছে ছড়ার মধ্যে লুকানো আনন্দদানকারী প্রবল গতিটিই সেখানে প্রধান হয়ে। শিশুরা নির্মল সেই আনন্দকেই গ্রহণ করে। এসব ছড়াই শিশুদের মনোরঞ্জর করে। ছেলেভুলানো ছড়া, ঘুমপাড়ানি ছড়া, রূপকথার ছড়া এসব ছড়া আমাদের অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন জাতীয় সম্পদ। আমাদের লোকসাহিত্য তো এগুলোই। পৃথিবীর সব দেশেই এরকম ছড়া আছে। দেশ-কাল ভেদে বিষয়-চরিত্র হয়তো ভিন্ন। কিন্তু শিশুদের আনন্দের ব্যাপারটি সব ছড়াতেই একই রকম। কোন কোন ক্ষেত্রে একই ছড়ার ভিন্ন ভিন্ন পাঠ লক্ষণীয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ছড়া সংগ্রহ করেছেন। এ কারণে অনেক ছড়ার মধ্যে বাংলার উপভাষা চলে এসেছে। আবার একই ছড়ার নানারকম পাঠও লক্ষ করা যাবে। কিন্তু কোনটিকেই বর্জনীয় বা অবহেলা করার মতো ব্যাপার নয়। সবগুলো পাঠই আদরণীয়। ‘কারণ, ছড়ায় বিশুদ্ধ পাঠ বা আদিম পাঠ বলিয়া কিছু নির্ণয় করিবার উপায় অথবা প্রয়োজন নাই। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি এতই জড়িত মিশ্রিত এবং পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে যে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠের মধ্য হইতে কোনো একটি বিশেষ পাঠ নির্বাচিত করিয়া লওয়া সংগত হয় না। ’

উদাহরণস্বরূপ- ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’ ছড়াটির কথা যদি উল্লেখ করা যায় তাহলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এর ভিন্ন ভিন্ন পাঠ উদ্ধৃত করেছেন। নিম্নে একটি ছড়ার ভিন্ন ভিন্ন পাঠের অংশবিশেষ তুলে ধরা গেলো
ক. আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁকর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ডুলি।
ডুলি গেল সেই কমলাপুলি।।
খ. আগ্ধসঢ়;ডুম বাগ্ধসঢ়;ডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে।
বাজতে বাজতে প’ল ঠুলি
ঠুলি গেল কমলাফুলি।।
গ. আগ্ধসঢ়;ডুম বাগ্ধসঢ়;ডুম ঘোড়াডুম সাজে
লাল মিরগেল ঘাঘর বাজে।।
বাজতে বাজতে এল ডুলি
ডুলি গেল সেই কমলাপুলি।।
ঘ. আগ্ধসঢ়;ডুম বাগ্ধসঢ়;ডুম ঘোড়াডুম সাজে
ডান মেক্ধসঢ়;ড়া ঘাঘর বাজে।।
বাজতে বাজতে পড়ল টুরি
টুরি গেল সেই কমলাপুলি।।
সবগুলো পাঠকেই রবীন্দ্রনাথ আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। এর মূল পাঠটি নির্ণয় করা যেমন সম্ভ নয়, আবার পত্যেকটি পাঠেরই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। স্থান-পরিবেশ-সময়কালের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো এগুলির শব্দগত পরিবর্তন বা বিকৃত ঘটে থাকবে। তবে মূল বিষয়টি ঠিকই অক্ষুন্ন রয়েছে। এরূপ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ভাষার ক্রমশ পরিবর্তনের স্বরূপটিও সহজেই অনুধাবিত হয়। সাহিত্যের ক্রম বিকাশের ধারায় লোকছড়াগান যে বড় ধরণের একটি অনিবার্য দলিল তা মানতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ সেই দলিলটিই যেন আবিষ্কার করে আমাদের সাহিত্যের মূলসূত্রটিই তৈরি করে দিয়েছেন।
২.
রবীন্দ্রনাথের ছড়া সংগ্রহ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তিনি নিজেই ছড়া ছড়াগুলি সংগ্রহ করেছিলেন নাকি অন্যদের দিয়ে সংগ্রহ করিয়ে নিয়েছিলেন। কিছু ছড়াতো তাঁর পরিবারেরই অনেকের মুখে মুখে ভেসে বেড়াতো। এমনও প্রশ্ন আছে, যাঁদের কাছে থেকে ছড়াগুলি সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁদের কারো নাম-পরিচয় জানা সত্ত্বেও তা উল্লেখ করেন নি। আবার কোনো কোনো ছড়া কোন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয়েছে তাও তিনি জানতেন না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ অন্যদের দিয়ে নানাভাবে ছড়াগুলি সংগ্রহ করিয়ে নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ আব্দুল জলিলের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ :
তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ছড়া চারটি (‘ছেলেভুলানো ছড়া: ২ শীর্ষক প্রবন্ধের ৬১-৬৪ সংখ্যক ছড়া) যার নিকট থেকে পেয়েছিলেন নিশ্চয় তার নাম ও পরিচয় জানতেন। কিন্তু তিনি কোনোক্রমেই সেই পরিচয়টুকু উল্লেখের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নি। অহমিকা ও আভিজাত্যবোধে তাঁকে এই মহৎ চেতনা থেকে বঞ্চিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় প্রবন্ধের কোনো ছড়াই তিনি নিজে সংগ্রহ করেন নি সবই সংগ্রহ করেছিলেন অন্যের মাধ্যমে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো তিনি ছড়াগুলো কোন কোন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন তা উল্লেখ করেন নি। উল্লেখ না করার কারণ তিনি সংগ্রাহকদের যথার্থ পরিচয়ই জানতেন না।

সময় পরিক্রমায় এক্ষেত্রে এটিকে রবীন্দ্রনাথের ‘সীমাবদ্ধতা’ হিসেবে হয়তো ড. মুহম্মদ আবদুল জলিল উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এ কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) কাছে লোকসাহিত্যসেবীদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।’ ১১ (ড. মুহম্মদ আবদুল জলিল, লালন-রবীন্দ্রনাথ: বাংলার লোকসংস্কৃতি, সমাচার, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১২০) প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখনীয়, রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের অনেক শাখার পথপ্রদর্শক ও নির্মাতা তিনি নিজেই। পথ-নির্মাণের পর সে-পথ নিয়ে নানাভাবেই সমালোচনা করা সহজতর একটি বিষয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালেও সমালোচকদের তীরে কম বিদ্ধ হন নি। তিনি যখন ছোটগল্প লিখতে শুরু করেছেন, লিখছেন ‘‘তখন বুদ্ধদেব বসুর মতো শাণিত প্রতিভা তাঁর গল্প নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন‘গদ্যের ভাষা গড়তে হয়েছে আমার গল্প প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে। মোপাঁসার মতো যেসব বিদেশী লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বলো, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে হলে তাঁদের কী দশা হত জানি নে। ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে, আমি যে ছোট ছোট গল্পগুলো লিখছি বাঙালি সমাজের বাস্তব জীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে। ” রবীন্দ্রনাথ এভাবে সাহিত্যের যেখানে নতুন পথ তৈরি করেছেন, সেখানেই সমালোচনার তীব্র তীর তাঁর দিকে ধাবিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যদি লোকসাহিত্যকে সুধী সমাজের সম্মুখে তুলে না আনতেন, নিজে যদি সংগ্রাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতেন, নিজে যদি এসব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন না করতেন হয়তো এসব ছড়া গান এতোদিনে বিস্মৃত হয়ে যেতো। বাংলা সাহিত্য তার প্রাণের সত্যিকারের আনন্দই হারিয়ে ফেলতো।
৩.
রবীন্দ্রনাথ শুধু ছড়াগুলিকে নয়, ছড়াগানগুলিকেও লোকসাহিত্য বলে অভিহিত করেছেন। এসব লোকসাহিত্য গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। এই ছড়া-গান তো গ্রাম থেকেই উঠে আসা। গ্রামীণ জনপদে প্রতিদিন নতুন ধরণের সাহিত্য জন্ম নেয়। একসময় যা মুখে মুখে বেঁচে থাকতো। এগুলোর ভেতর হয়তো অনেক অসামঞ্জস্য ও অসংলগ্নতা থাকে। ভাবও হয়তো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত থাকে। তারপরও এর ভেতরও থাকে সমাজের ছবি অভাবতাড়িত পরিবারের ছবি আনন্দ-বেদনার ছবি। যে ছড়াগুলি হয়তো শিশুবয়স পেরুনো তরুণদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। যেখানে রাধা-কৃষ্ণ-র প্রেম, দাম্পত্যকলহ, অভাব-অনটন, বিরহ- বেদনা যেগুলো গ্রাম্যসাহিত্য হিসেবে পরিচিত। আর এ গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেই থাকে স্বদেশের মাটির গন্ধ। গ্রাম্যসাহিত্য বলে পরিচিত এসব ছড়াই সময়ের স্রোতে আভিজাত্য শ্রেণির কাছেও আদরণীয়তা লাভ করে। ‘গ্রাম্য ছড়াগুলি গ্রামের সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়েদেরও সাহিত্যরস-তৃষ্ণা মিটাইবার জন্য ভিখারিনী ও পিতামহীদের মুখে মুখে ঘরে ঘরে প্রচারিত হইত।’ কারণ এসবের ভেতর বাউলের একতারার ঘ্রাণ যুক্ত হয়ে যায়। অধ্যাত্মবাদ আত্মায় আসন গেড়ে নেয়। অর্থাৎ গ্রাম্যসাহিত্য বা গ্র্ধাসঢ়;ম্যছড়া বহুমাত্রিকতায় রূপ নেয়। যেমন:
যুবতী, ক্যান বা কর মন ভারী।
পাবন্য থ্যাহে আন্যে দিব ট্যাহা-দামের মোটরী।।

এ ছড়াটিতে আছে দারিদ্রক্লিষ্ট একটি পরিবারের করুণ ছবি। পরিবারে তরুণীবধু অভিমানে মন খারাপ করে আছে। তার অভিমান ভাঙাতে স্বামী পাবনা থেকে এক টাকা মূল্যের ‘মোটরী’ কিনে আনার আশ্বাস দেয়। যাতে অভিমানী যুবতী বউয়ের মলিনমুখে হাসি ফোটে। দরিদ্র একটি পরিবারের অভিমানী স্ত্রী আর গরিব স্বামীর আনন্দ-বেদনার নির্মল এক ছবি ফুটে উঠেছে। গ্রাম্যযুবতী মেয়েদের চাওয়া যে বেশি নয়, এক টাকার দামের মোটরীতেই যে তারা খুশি গ্রাম্যকবি সে ছবিটিই কোন রাখঢাক না করে সরাসরি তুলে ধরেছেন। সাহিত্যমূল্য এর কতোটুকু সেটি এখানে বিচার্য নয়, প্রধান বিষয় হলো গ্রামীণ জনপদের বুকের ভেতর থেকে তুলে আনা এ যেন এক অনবদ্য ছবি সেখানে অভাব অনটনের আগুন যতোই থাকুক, ভালোবাসার শান্তিই সেখানে বড়। আর এ শান্তি তারা সামান্য চাওয়া-পাওয়ার ভেতরই ধরে রাখে। 

এপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বলেছেন: জগতের একপ্রান্তে পাবনা জিলায় যে এমন একটা স্থান আছে যেখানে প্রতিকূল প্রণয়িনীর জন্য অসাধ্য সাধন করিতে হয় না, পাবনা অপেক্ষা দুর্গম স্থানে যাইতে এবং ‘মোটরী’ অপেক্ষা দুর্লভ পদার্থ সংগ্রহ করিতে হয় না, ইহা মনে করিলে ভবযন্ত্রণা অপেক্ষাকৃত সুসহ বলিয়া মনে বোধ হয়। কালিদাস, ভবভূতি প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির কবিরা এমন স্থলে নিশ্চয়ই মানব সরোবরের স্বর্ণপদ্ম, আকাশের তারা এবং নন্দনকাননের পারিজাত অম্লানমুখে হাঁকিয়া বসিতেন। এবং উজ্জয়িনীর প্রথম শ্রেণির যুবতীরা শিখরিণী ও মন্দাক্রান্তাছন্দে এমন দুঃসাধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তাবমাত্র শুনিলে প্রসন্ন না হইয়া থাকিতে পারিতেন না।

লোকসাহিত্যের মধ্যে হরগেীরী-বিষয়ক এবং রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গানই প্রধান। হরগৌরীর গান সমাজ-সংসারের গান, রাধাকৃষ্ণের গান তেমনি সৌন্দর্যের গান, অধ্যাত্ম প্রেমের গান। নারী ও পুরুষের প্রেমের আকর্ষণ সব দেশের সব সাহিত্যেই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রেমের সৌন্দর্য নানামাত্রিক। সেই সৌন্দর্যকে নানা রূপকের ভেতর দিয়ে ধরার চেষ্টা আছে। সেখানেই মূল সৌন্দর্য। ‘দুটি মনুষ্যের প্রেমের মধ্যেএমন একটি বিরাট বিশ্বব্যাপকতা আছে যে আধ্যাত্মিক ভাবুকদের মনে হয়, সেই প্রেমের সম্পূণৃ অথৃ সেই দুইট মনুষ্যের মধ্যেই পর্যাপ্ত নহে; তাহা ইঙ্গিতে জগৎ ও জগদীশ্বরের মধ্যবর্তী অনন্ত কালের সম্বন্ধ ও অপরিসীম ব্যাকুলতা জ্ঞাপন করিতেছে।

বাংলা লোকসাহিত্যেও নারী-পুরুষের প্রেমের আকর্ষণ বাস্তবের দাম্পত্যসঙ্কট ও দারিদ্রের নানারূপ এবং অধ্যাত্ম অপার্থিব সৌন্দর্যে বিকশিত হয়েছে। হরগৌরী বা রাধাকৃষ্ণের গানে নানাভাবে সেসব উঠে এসেছে। এসব গানে আছে দারিদ্রের ছবি, সেই দারিদ্রকে প্রতিহত করার ছবিও আছে। সংসারে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার ছবি সেই দারিদ্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে দারিদ্র কখনো স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে না। স্বামীর প্রতি সতীনারীর শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসাই দারিদ্রকে দূর করে দেয়। স্বামী বৃদ্ধ হোক বা দেখতে সুশ্রী কুশ্রী যেমনই হোক স্ত্রীর ভালোবাসা শ্রদ্ধা ভক্তিই সেখানে আসল স্ত্রী যতো রূপবতীই হোক আর
স্বামী যতোই দেখতে অসুন্দর হোক বা বয়সের যতোই অসমতা থাকুক সতীনারীর স্বামীর প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং মহত্ত্বকীর্তনই দারিদ্রকে প্রতিহত করে সংসারে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য ধরে রাখে। সমাজের এসব নিখাদ ছবি গ্রাম্য গানে রূপ লাভ করেছে। বৈষ্ণবগানে পরকীয়া প্রেম বিশেষ গৌরবের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে পরকীয়াই মূল। সমাজ-সংসারে যা অগ্রহণযোগ্য সমাজনীতি দ্বারা যা নিষিদ্ধ। রাধা সমাজের সেই কঠিন বিধিনিষেধ অমান্য করে দুর্বার হয়ে ওঠে কৃষ্ণের প্রেমে। সে কলঙ্ক-ধর্ম-সমাজ- সংসার কোন কিছুরই ভয় করে না। অপ্রতিরোধ্য এক হৃদয়বৃত্তিতে কৃষ্ণর জন্যে উন্মত্ত রাধা। বৈষ্ণব সাহিত্যের যা মূল শক্তি। বৈষ্ণব কবির উচ্চারণ:
মরম না জানে ধরম বাখানে

এমন আছএ যারা

কাজ নাই সখি তাদের কথায়

বাহিরে রহুন তারা।

গ্রাম্য কবিদের রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক ছড়াগুলো সমাজবাস্তবতা থেকে অতিক্রম অধ্যাত্মতা বা মানসিকতায় পর্যবসিত হয়। সেখানে সংসার-সমাজের বৃত্তে ছড়াগুলো বন্দি হয়ে থাকে না। সেখানে অধ্যাত্ম অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি করে। হরগৌরী-বিষয়ক ছড়াগুলো এক্ষেতে ভিন্ন ঘর-সমাজ-সংসারেই বৃত্তবন্দি হয়ে থাকে।প্রেম-পরকীয়া, নিন্দা-ভয়-লজ্জা শাসনকে তুচ্ছজ্ঞান করা, দুর্বোধ্য রহস্য-গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। সমাজ-নীতিই এখানে বড় হয়ে ওঠে, আধ্যাত্মিক প্রেম হিসেবে স্ধসঢ়;ভীকৃত হয় না। গ্রাম্যসাহিত্যে এসব ছড়া-গানের মধ্যে মানবহৃদয়ের চিরন্তন আবেগ-অনুভূতিই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অকৃত্রিম যে আনন্দ, তা এখানে চিরত্ব। লোকসাহিত্যে ঘর-সংসার-সমাজের চিত্র যেমন আছে, তেমনি মানবমনের অধ্যাত্মধ্যানও আছে, যেখানে আবেগ ও হৃদর্র্য়সৌন্দর্য আবি®কৃত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমাদের দেশে রাধাকৃষ্ণের কথায় সৌন্দর্যবৃত্তি এবং হরগৌরীর কথায় হৃদয়বৃত্তির চর্চা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে ধর্মবৃত্তির অবতারণা হয় নাই। তাহাতে বীরত্ব, মহত্ত্ব অবিচলিত ভক্তি কঠোর ত্যাগস্বীকারের আদর্শ নাই। রাম-সীতার দাম্পত্য আমাদের দেশে প্রচলিত হরগৌরীর দাম্পত্য অপেক্ষা বহুতরগুণে শ্রেষ্ঠ, উন্নত এবং বিশুদ্ধ; তাহা যেমন কঠোর গম্ভীর তেমনি স্নিগ্ধ কোমল। রামায়ণকথায় একদিকে কর্তব্যের দুরূহ কাঠিন্য, অপরদিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য্য, একত্র সম্মিলিত। তাহাতে দাম্পত্য, সৌভ্রাত্র, পিতৃভক্তি, প্রজাবাৎসল্য প্রভৃতি মানুষের যতপ্রকার উচ্চ অঙ্গের হৃদয়বন্ধন আছে তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ পরিস্ফুট হইয়াছে।... তাহাতে সর্বপ্রকার হৃদবৃত্তিকে মহৎ ধর্মনিয়মের দ্বারা পদে পদে সংযত করিবার কঠোর শাসন প্রচারিত। সর্বতোভাবে মানুষকে মানুষ করিবার উপযোগী এমন শিক্ষার আর কোন দেশে কোনো সাহিত্যে নাই।

রবীন্দ্রনাথ ছড়া-গান সংগ্রহ করে তা বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে লোকসাহিত্য নামক এ ধারাটিতে যে অসামান্যতা দান করেছেন তা অবিশ্বাস্য। বর্তমানে লোকসাহিত্য সাহিত্যের প্রধান একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত, যেখানে নিহিত আমাদের প্রাণের আনন্দ। যেটি রবীন্দ্রনাথ একেবারে তরুণ বয়সেই অনুভব করেছিলেন, যে কারণে সে-বয়সেই তিনি লোক-গান ছড়া সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। লোকসাহিত্যবিহীন আমাদের সাহিত্য আনন্দহীন প্রাণের মতো, রবীন্দ্রনাথ তা গভীরভাবেই অনুভব করেছিলেন। সেকারণেই তরুণ বয়সেই তিনি লোকসাহিত্য অর্থাৎ গ্রাম-বাংলার ছড়া-গান, বাউল-মুর্শেদী গান, বৈষ্ণবী গান প্রভৃতি সংগ্রহ করে, প্রচার করে, বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে সাহিত্যের প্রাণের আনন্দটিই যেন আবিষ্কার করে দিয়েছেন। রবীন্দ্র-পথেই পরবর্তীতে এ ধারায় আরো অনেক মনীষী অগ্রসর হয়ে লোকসাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধতর করেছেন।

(ড. রকিবুল হাসান: কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।)

আরকে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি